দোয়ার আশ্চর্য ফল : একটি বাস্তব উদাহরণ
দোয়ার আশ্চর্য ফল : একটি বাস্তব উদাহরণ - ছবি সংগৃহীত
শাইখ মুহাম্মদ আস সাউঈ খুতবা দিতে যাবেন আসওয়ানে (মিসরের দক্ষিণে একটি শহর)। তার ফ্লাইট ছিল ভোর সাড়ে ৫টায়। এখন তিনি যদি আলেকজান্দ্রিয়ায় (মিসরের আরেকটি শহর) ফজর সালাত আদায় করে বের হন তাহলে তিনি খুতবা দেয়ার জায়গায় যথাসময়ে পৌঁছতে পারবেন না। সুতরাং তিনি এয়ারপোর্টের সন্নিকটে একটি মসজিদের ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন মসজিদের মূল দরজাটি খুলে রাখেন।
ইমাম সাহেব জানতে চাইলেন, সব কিছু ঠিক আছে কি না? প্রত্যুত্তরে তিনি জানালেন- হ্যাঁ, সব কিছু ঠিকঠাক আছে। ভোর সাড়ে ৫টায় তার ফ্লাইট, রাত ২-৩টার দিকে তিনি মসজিদে আসতে চান, ছোট্ট একটা ঘুম দিয়ে, ফজর সালাত তার সাথে জামাতে আদায় করে এয়ারপোর্ট যাবেন। তাহলে, ফজর সালাত বা ফ্লাইট কোনোটিই মিস হবে না ইনশা আল্লাহ। ইমাম সাহেব তার এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করলেন।
শাইখ মুহাম্মদ কায়রোর উদ্দেশে রওনা দিলেন ১০টায় এবং রাত ২টায় তিনি এয়ারপোর্টের কাছে ওই মসজিদে পৌঁছে সদর দরজা খোলা ও সবগুলো বাতি জ্বালানো অবস্থায় পেলেন। মিহরাবের কাছে স্থানীয় এক ব্যক্তিকে সিজদারত অবস্থায় দেখতে পেলেন। লোকটি সিজদায় কাঁদছেন এবং মহান আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছেন এই বলে, ‘হে আমার রব! আমি আর নিতে পারছি না, আমার কেউ নেই তুমি ছাড়া। তুমি ছাড়া কার কাছে যাবো আমি?’
শাইখ লোকটির কথা শুনে বুঝলেন যে, তিনি কোনো পাপের প্রায়শ্চিত্ত করছেন না, বরং তার ভীষণ প্রয়োজনীয় কিছু মহান আল্লাহর কাছে চাইছেন আর সে জন্যই আল্লাহর দরবারে এই আকুতিভরা প্রার্থনা। তিনি লোকটির সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। একসময় তা শেষ হলো।
তিনি লোকটিকে সালাম দিলেন এবং পিঠে হাত বুলিয়ে তার কাছে জানতে চাইলেন- তার কী হয়েছে সেটা বলা যাবে কি? শাইখ লোকটিকে বললেন, আপনার দোয়া আমার হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। লোকটির কান্নার কারণ এবং কিসের জন্য এত অনুনয়-বিনয়সহকারে মহান রবের দুয়ারে হাত তুলেছেন তা জানতে চাইলেন। লোকটি শাইখের দিকে তাকালেন এবং তিনি কী বলবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না। তবুও তিনি বললেন, বিষয়টা হলো তার স্ত্রী খুব অসুস্থ। কাল সকাল ৯টায় অপারেশন হবে। হসপিটালের বিল ও অপারেশন বাবদ তার ১৫ হাজার ৪০০ পাউন্ড ভীষণ প্রয়োজন। অথচ তার কাছে এর কিছুই নেই।
সব শুনে শাইখ জানালেন, তাকে অর্থ সাহায্য করার মতো অবস্থা তার নেই। তবে তিনি লোকটিকে এই সুসংবাদ দিলেন যে, প্রিয়নবী মুহাম্মদ সা: আমাদের জানিয়েছেন- মহান আল্লাহ আমাদের মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। আল্লাহর কাছে যে চায় তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না। শাইখ লোকটিকে তার দোয়া চালিয়ে যেতে বললেন, আল্লাহর দরবারে কাঁদতে বললেন, কারণ মহান আল্লাহ বান্দার দোয়া শোনেন। শাইখ বিতর সালাত আদায় করে ঘুমাতে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর মুয়াজ্জিন এলেন আজান দিতে এবং শাইখকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে আজান দিলেন। তারা সুন্নত সালাত আদায় করলেন। ইমাম সাহেব শাইখকে ফজরের সালাতের ইমামতি করার জন্য অনুরোধ করলে তিনি জানালেন, তিনি সফরের কারণে খুবই ক্লান্ত। তথাপি তিনি পরে রাজি হলেন ইমামতি করার জন্য। যথাসময়ে সালাত শেষ হলো।
দ্বিতীয় কাতার থেকে এক ব্যক্তি হঠাৎ সামনে এগিয়ে এলেন। তিনি ছিলেন ওই এলাকার সবচেয়ে ধনী। তার পোশাক পরিচ্ছদে স্পষ্ট বোঝা যায়, তিনি যথেষ্ট সম্পদের মালিক। তিনি শাইখকে সালাম ও উষ্ণ অভিবাদন জানিয়ে বললেন, টেলিভিশনে শাইখের বক্তব্য তিনি নিয়মিত শোনেন। তিনি তাকে আরো জানালেন, সম্প্র্রতি এই মসজিদের ওপর তিনি একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। শাইখের গলা শুনে তিনি নিশ্চিত হতে তাকে দেখতে এসেছেন। তিনি আরো বললেন, প্লাস্টিকের একটি কারখানা দিয়েছেন তিনি এবং সেটির নতুন শাখা খুলেছেন।
আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহ তাকে অনেক সম্পদের মালিক করেছেন। শাইখকে তিনি জানালেন, তার ১৫ হাজার ৪০০ পাউন্ড জাকাত সংগৃহীত হয়েছে, এগুলো বিতরণ করতে হবে তাকে। তার কাছে পরামর্শ চাইলেন কিভাবে এগুলো বিতরণ করা যায়। শাইখের শরীরের লোমগুলো মহান আল্লাহর অলৌকিক ক্ষমতার কথা স্মরণে দাঁড়িয়ে গেল এবং শেষ পর্যন্ত তিনি কেঁদে ফেললেন। মানুষজন অবাক হয়ে তাকে দেখছে আর ভাবছে কেন তিনি কাঁদছেন।
শাইখ নিজের মনে মনে চিন্তা করে সুবহানাল্লাহ বললেন এবং ভাবলেন এই ধনী ব্যক্তিটি জানেও না যে তার বাড়ির নিচেই মসজিদে এক দরিদ্র ঠিক এই পরিমাণ টাকার জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইছেন! শাইখ লোকটিকে চার পাশে খুঁজতে লাগলেন। তাকে দেখামাত্র সামনের কাতারে আসতে বললেন। লোকটি তার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এলেন। তার চোখ এখনো অশ্রুসিক্ত, লাল হয়ে আছে কান্নার কারণে।
শাইখ দরিদ্র লোকটিকে ধনী ব্যক্তির সামনেই প্রশ্ন করলেন, কেন তিনি সারা রাত কেঁদেছেন? লোকটি বললেন, শাইখ আমি তো আপনাকে বলেছি যে, আমার স্ত্রীর আজ সকাল ৯টায় অপারেশন। হাসপাতালের বিল ও সার্জারি বাবদ ১৫ হাজার ৪০০ পাউন্ড আমার জরুরি প্রয়োজন। কিন্তু আমি হতদরিদ্র। এত টাকার কিছুই আমার নেই? তার এ কথা শোনামাত্র ধনী ব্যক্তিটি কেঁদে ফেললেন। মহান আল্লাহর কাছে বারবার শুকরিয়া জানালেন আর গরিব লোকটিকে জড়িয়ে ধরলেন।
ধনী ব্যক্তিটি শাইখকে বললেন, এক সপ্তাহ আগে জাকাতের এই টাকা তিনি আলমারিতে রেখেছেন। তার স্ত্রী প্রায় প্রতিদিন তাকে এই জাকাতের টাকা বিতরণ করে দিতে বলতেন, যেহেতু এটি আল্লাহর হক। প্রত্যুত্তরে তিনি বলতেন, একটু ধৈর্য ধরো। আশা করছি এমন কাউকে শিগগিরই পেয়ে যাবো ইনশা আল্লাহ, যার ভীষণ দরকার এই টাকাটা। আজ এখানে ৫০০ পাউন্ড কাল ওখানে ১০০০ পাউন্ড এভাবে ভেঙে ভেঙে টাকাটা না দিয়ে আমি আসলে এমন কাউকে খুঁজছি যার এই টাকা একত্রে পেলে অনেক উপকার হবে। কারো দুশ্চিন্তা, পেরেশানি আমি যদি আজ এতটুকু দূর করতে পারি তাহলে কাল কিয়ামতের দিন মহান আল্লাহ হয়তো আমার কষ্ট ও পেরেশানি দূর করে দেবেন।
ধনী লোকটি জাকাতের টাকাটা তার আলমারি থেকে নিয়ে এলেন এবং ওই লোকটিকে তার স্ত্রীর অপারেশনের জন্য দিয়ে দিলেন। দরিদ্র লোকটির জন্য অল্প সময়ে ঘটে যাওয়া এই ঘটনাবলি বিশ্বাস করা খুব কঠিন হয়ে পড়ল। তার চারপাশে কী আছে সব ভুলে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মহান আল্লাহর দিকে ফিরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা জানালেন, ‘হে আমার প্রভু! আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমি অনেক ভালোবাসি তোমাকে।’
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনুল কারিমে বলেছেন, ‘তাদের পার্শ্ব শয্যা থেকে আলাদা থাকে। তারা তাদের পালনকর্তাকে ডাকে ভয়ে ও আশায় এবং আমি তাদেরকে যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে ব্যয় করে। কেউ জানে না তার জন্য কৃতকর্মের কী কী নয়ন-প্রীতিকর প্রতিদান লুকায়িত আছে’ (সূরা সিজদাহ : ১৬ ও ১৭)।
সূত্র : শাইখ ইউনূস কাথারদা, ডেইলি ফাউয়াইদ