ইরান না তুরস্ক : কোন দিকে যাবে ফিলিস্তিন?
ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি ও তুরস্কের রজব তাইয়্যিপ এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
গত ২২ ডিসেম্বর ইসরাইলের সাথে এক চুক্তির মধ্য দিয়ে সর্বশেষ দেশ হিসেবে ‘ইব্রাহিমি ঐকমত্য’-এ প্রবেশ করেছে মরক্কো। এই নিয়ে ২০২০ সালে চারটি আরব দেশ ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করল। অবশ্য এদের মধ্যে শুধু সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়েছে, সুদান ও মরক্কোর সাথে সমঝোতা সম্পর্ক স্বাভাবিককরণেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এর আগেই অবশ্য মিসর ১৯৭৯-এ ও জর্দান ১৯৯৪-এ প্রথম ও দ্বিতীয় দেশ হিসেবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। তবে প্রায় সিকি শতাব্দী পর ডোনাল্ড ট্রাম্পের তত্ত্বাবধানে সম্পাদিত এই চুক্তির তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভিন্ন, এবং সেইসাথে সুদূরপ্রসারী। আর তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো এই রাজনৈতিক খেলায় ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য কতখানি বদলাবে সেই প্রশ্নের উত্তর।
বিশ্বের প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার অধিকারী ইহুদিদের দাবি অনুসারে, দু’হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশে দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব ইহুদিদের বেশির ভাগই প্রধানত ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেছে। এ সময়জুড়ে বিগত বা ধর্মীয় কারণে ইহুদিবিদ্বেষ ক্রমশ চরম আকার ধারণ করে। রোমান আমল থেকে ইউরোপে আগমণকারী ইহুদিরা প্রধানত ইবেরীয় উপদ্বীপ ও মধ্য ইউরোপে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু শত শত বছর ধরে চলমান ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব মাঝে মাঝেই সহিংস রূপ নিত, কখনো কখনো এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘রিকোনকিস্তা’-র পর ‘স্প্যানিশ ইনকুইজিশন’। ১৪৯২ সালে স্পেন মুর হাত থেকে স্পেনীয়দের হাতে চলে আসার পর স্পেন থেকে মুসলিম মুরদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও ব্যাপকভাবে বহিষ্কার ও ধর্মান্তরিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ খ্রিস্ট ধর্ম বিশুদ্ধতা রক্ষায় প্রায় সব মুসলিম ও ইহুদিদের বিতাড়িত করে। এসব ইহুদিরা দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় নতুন করে বসতি স্থাপন করে। একই ঘটনা ঘটে পর্তুগালেও। অন্যদিকে মধ্য ইউরোপে, বিশেষত জার্মানিতে বসতকারী ইহুদিরাও বারংবার নির্যাতনের শিকার হয়ে সে দেশ ছেড়ে প্রধানত পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু সেখানেও তারা নির্যাতিত হতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত সতের শ’ শতকে ইউরোপীয় জ্ঞানোদ্দীপন ইহুদিদের মধ্যে প্রসারিত হলে ইহুদি বুদ্ধিজীবিদের মনে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় মুক্তির চেতনা জাগ্রত হয়। তারা ইউরোপসহ বিশ্বের সব ইহুদির জন্য নিজস্ব আলাদা বাসভূমির দাবি তোলে। এরই মধ্যে ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ এমন চরম আকার ধারন করে যে, ইহুদিরা ইউরোপ ছেড়ে ব্যাপক হারে আমেরিকাসহ নতুন বিশ্বের দেশগুলোতে অভিবাসিত হতে থাকে। এতে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ আরো বৃদ্ধি পায়। এরই মধ্যে ইহুদি-হাঙ্গেরীয় এক নেতা থিওদোর হার্ত্জল জায়নবাদের উত্থাপন করেন। জেরুসালেমের অদূরবর্তী জায়ন পাহাড় থেকে এই নাম।
হার্ত্জল বলেন, ইহুদিদের জন্য শুধু আলাদা বাসভূমি নয়, তাদের পূর্বপুরুষের দেশ, অর্থাৎ তত্কালীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন অঞ্চলেই একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে দিতে হবে। এ মতবাদ ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইহুদি নেতাদের মাধ্যমে জায়নবাদ ইউরোপের নেতৃবৃন্দের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পায়। ইতিমধ্যে কিছু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য পরষ্পরের মুখোমুখি হলে ইহুদির বিষয়টি ব্রিটিশদের নজরে আসে। তাই যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনকে ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’-এ পরিণত করা হলে সেখানে ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে ব্যাপক হারে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। ফলে স্থানীয় আরব মুসলিমদের সাথে ইহুদি বসতকারী ও ব্রিটিশ প্রশাসনের সংঘাত শুরু হয়। অন্য দিকে ইহুদিরাও ব্রিটিশদের সহায়তায় নতুন দেশে এলেও আবারও ইউরোপীয়দের অধীনে বসবাস করতে অস্বীকার করে। ফলে তারাও ব্রিটিশবিরোধী এবং আরববিরোধী সহিংসতায় লিপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালে এই ত্রিমুখী সংঘাত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। জাতিসঙ্ঘ ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’-কে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। অন্য দিকে ইহুদিরা স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনের আরব মুসলিমরা তাদের দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। তারা জাতিসঙ্ঘ বরাদ্ধকৃত ফিলিস্তিনিদের ভূমির ৬০% দখল করে। এ সময় ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, মিসরসহ বিভিন্ন আরব দেশে উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই নেয়।
অন্য দিকে ইহুদি প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য আরব দেশও এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের নানাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই আরব দেশগুলোর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ইসরাইল। আরব মুসলিম ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করে পশ্চিমাদের তাঁবেদারি জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল গঠন করা হয়েছে - এই দাবিতে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ১৯৪৮ সালে আরব লীগের অধীনে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্দান, মিসর, সৌদি আরব ও ইয়েমেন একযোগে আক্রমণ করে সদ্য ভূমিষ্ট ইসরাইলি রাষ্ট্রকে। কিন্তু ইসরাইল এবারও বিজয়ী হয়।
বারবার পরাজিত হওয়ার পর এবার ফিলিস্তিনি গেরিলারা গাজা উপত্যাকাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে বাম ধারার সমাজতন্ত্রী সংগঠন ফাতাহ জন্ম নেয়। ১৯৬৪ সালে ফাতাহসহ আরো অনেক ফিলিস্তিনি সংগঠন একত্রে গঠন করে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পিএলও)। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ নিয়ে মিসরের সাথে ব্রিটিশ-ফরাসিদের দ্বন্দ্ব শুরু হলে তারা ইসরাইলকে সাথে নিয়ে এক যোগে মিসর আক্রমণ করে। ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ দখল করে বসে। কিন্তু মিসর যুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে এই প্রথম ইসরাইলকে সামরিকভাবে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয় কোনো আরব দেশ। এতে উৎসাহিত হয়ে ১৯৬৭ সালে মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও ইরাক একযোগে আক্রমণ করে ইসরাইলকে। কিন্তু তারা এবার ভীষণভাবে পরাজিত হয়। ইসরাইল মিসরের কাছ থেকে সিনাই ও গাজা, সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি, জর্দানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর কেড়ে নেয়। ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুরের দিন মিসর ও সিরিয়া একযোগে ইসরাইলকে আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও তারা পরাজিত হয়। এর মধ্য দিয়ে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সরাসরি যুদ্ধের দিন শেষ হয়। কিন্তু পিএলওসহ অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দক্ষিণ লেবাননে পিএলও-সহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর উপস্থিতি নিয়ে দেশটির মুসলিম-খ্রিস্টানদের মধ্যকার উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে ১৯৭৫ সালে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
এ সময় ফিলিস্তিনি গেরিলারা লেবানন থেকে ইসরাইলে ক্রমাগত হামলা চালালে ইসরাইলও লেবাননের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে তারা শিয়া প্রধান দক্ষিণ লেবাননের কিছু অংশ দখল করে। কিন্তু এবার ইসরাইলকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। লেবানীয় বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনিদের সাথে হাত মিলিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে থাকে। ১৯৮৫ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন ছাড়তে বাধ্য হলেও তাদের সহযোগী খ্রিস্টান সশস্ত্র গ্রুপগুলো দক্ষিণ লেবাননে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ অব্যহত রাখে।
একই বছর লেবাননে ইরানের মদদে শিয়া ইসলামপন্থী হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ১৯৮৭ সালে সৃষ্টি হয় মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সুন্নি ইসলামপন্থী হামাস। ফলে লেবাননে ইসরাইলবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়। ১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও দক্ষিণ লেবানন সঙ্কট চলতেই থাকে। হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরাইল ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হতে থাকে। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরে আসে ইসরাইল। কিন্তু হিজবুল্লাহ-হামাসসহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের পিছু ছাড়ে না। ২০০৬ সালে আবারও ইসরাইল লেবাননে হিজবুল্লাহের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে।
এ দিকে ২০০৫ সালে গাজা উপত্যাকা ইসরাইল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিলে ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব সরকার নির্বাচন করে। নির্বাচনে ফাতাহ পশ্চিম তীরে এবং হামাস গাজায় বিজয়ী হয়। এরপর হামাস গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। গাজা থেকে ইসরাইলবিরোধী হামলা চালাতে থাকে হামাস। ইসরাইল নতুন করে গাজার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২০০৮, ২০১২ ও ২০১৪ সালে হামাসের হামলার বিপরীতে গাজায় হামলা চালায় ইসরাইল।
এতসব সহিংসতার মধ্যেও কিন্তু ইসরাইল-ফিলিস্তিনি শান্তি আলোচনা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ১৯৮৭-৯৩ সালব্যাপী প্রথম ফিলিস্তিনি গণভ্যূত্থানের পর ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দ বুঝতে সক্ষম হয়, শান্তি প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৩ সালে অসলো ঐক্যমতের মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও পিএলও পরষ্পরকে স্বীকৃতি দেয়।১৯৯৪ সালে গাজা-জেরিকো সমঝোতায় ফিলিস্তিনি স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা নির্ধারিত হয়। কিন্তু এরপর নানা সম্মেলন ও আলাপ-আলোচনার পরও শান্তি প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং ২০০০-০৫ সাল ব্যাপী ফিলিস্তিনি গণভ্যূত্থান কঠোর ও নির্মমভাবে দমন করা হলে বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের বিক্ষোভ-সহিংসতা এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীরা ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ফিলিস্তিনিদের শান্তির চেয়ে সহিংসতার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। বিশেষত ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশ জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করা ও ২০১৯ সালের ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের নামমাত্র স্বাধীনতা দেয়ার প্রস্তাবের ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ফিলিস্তিনি জনতা ও নেতৃবৃন্দ এসব পদক্ষেপ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষত দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে।
অন্য দিকে আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাতও ভিন্ন মাত্রা লাভ করে গত কয়েক দশকে। পঞ্চাশের দশকে মিসরে সেনা অভূত্থানের পর জামাল আব্দেল নাসেরের ক্ষমতায় আহরণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। আরব জাতীয়তাবাদ, বৈশ্বিক আরববাদ ও আরব সমাজতন্ত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। একে একে ইরাক, সিরিয়া, উত্তর ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান, আলজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যূত্থান বা সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বামপন্থীরা। নাসের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সৃষ্টি করলেও মধ্যপ্রাচ্যের এই সব বামঘেঁষা সরকার ছিল সোভিয়েতদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফিলিস্তিনি সংগঠন পিএলও এবং এর অন্তর্গত ফাতাহ ও অন্যান্য সংগঠনগুলোও ছিল একই আদর্শে ব্রতী। অন্য দিকে সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, জর্দান, মরক্কোসহ রাজতান্ত্রিক দেশগুলো ছিল মার্কিনপন্থী ও ইসলামঘেঁষা। ফলে আরব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। পিএলওর ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা এর মূল ঘাঁটি জর্দানের সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৯৭০ সালে জর্দান ও পিএলও মুখোমুখি হয় এবং শেষ পর্যন্ত পিএলও পরাজিত হয়ে জর্দান ছাড়তে বাধ্য হয়।
মিসরে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন আনোয়ার সাদাত। ধীরে ধীরে বামাদর্শের পালে হাওয়া কমতে থাকে ও ইসলামতন্ত্রের পক্ষে মতামত বাড়তে থাকে। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় তৈলরাজ্যগুলো ইসলামবাদীদের প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইন্ধন জোগায়। বিশেষত মিসরীয় মুসলিম ব্রাদারহুড এসব সংগঠনের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এদিকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সাদাত ক্রমশ মার্কিনিদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬৭ সালে আরব লীগ খার্তুম শপথের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সাথে সব ধরনের সংস্পর্শ বন্ধের যে অঙ্গীকার করে ছিল, তা ভঙ্গ করে ১৯৭৯ সালে মিসর প্রথম আরব ও মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সাথে শান্তি চু্ক্তি করে। মিসরীয় জনগণ অবশ্য তা সহজে গ্রহণ করেনি। বিশেষত ইসলামবাদীরা এতে সাদাতের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়।
একই বছর আবার দু’টি বড় ঘটনা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে হতচকিত করে। মার্কিনপন্থী ইরানের শাহের পতন হয় গণ-অভ্যূত্থানে, ক্ষমতায় বসে খোমেইনির শিয়া ধর্মগুরু শাসিত সরকার। সোভিয়েত-সমর্থিত সাম্যবাদী আফগান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়, যা দমন করতে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়, ফলে শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধের। আফগান যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মনে ইসলামী জাতীয়বাদ তীব্র থেকে তীব্রতর করে, যা কাজে লাগায় সৌদিরা। কিন্তু ইরানের শিয়া ধর্মগুরুরাও একই কাজে নামে, কিন্তু প্রধানত সংখ্যালঘু শিয়াদের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সম্প্রাদয়কে সুন্নি নিপীড়ন থেকে রক্ষার জন্য বদ্ধ পরিকর ইরান লেবানন, বাহরাইন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে তৎপরতা শুরু করে। সিরিয়ায় বা’আস সরকারের নেতৃত্ব সংখ্যালঘু আলাউই শিয়া সম্প্রদায়ের হাতে থাকায় তারা ইরানের প্রধানতম মিত্রে পরিণত হয়। ইরানের শিয়া বিপ্লব প্রকল্প হয় দাঁড়ায় সুন্নি সৌদি আরবের প্রধান আশঙ্কার কারণ। ১৯৭৯ সালে শিয়া বিদ্রোহের ভয়ে সংখ্যালঘু সুন্নিদের প্রতিনিধি বা’আস পার্টির নেতা সাদ্দাম হুসেন ক্ষমতায় আসে ইরাকে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের বামশাসিত বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সৌদিদের ডিঙিয়ে স্থানীয় ইসলামবাদীদের সমর্থন আদায়ে অগ্রসর হয় ইরান। বিশেষত মার্কিনঘেঁষা রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামপন্থীদের সরকারবিরোধী কার্যক্রমে মদত দেয় ইরান।
সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও আল-কায়েদার সাথে সখ্য থাকে ইরানের। এর আগে সৌদি আরবও একই কাজ করে আসছিল মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলো জুড়ে, কিন্তু মার্কিনপন্থী হওয়ায় তাদের ইসলামবাদ সরাসরি মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যায়নি। ইরান সেই সুযোগটি নেয়। একই কারণে ইসরাইলের প্রতি সৌদিদের নমনীয় মনোভাব এবং ইরানের উগ্র বিরোধিতা প্রকাশিত হয় মুসলিম বিশ্বজুড়ে। এতে ইসরাইলবিরোধী ও মার্কিনবিরোধী মনোভাব ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তা বামপন্থী সমাজবাদ থেকে ক্রমশ ডানপন্থী ইসলামবাদে রূপ নেয়। ১৯৮১ সালে ইসলামবাদী উগ্রপন্থীরা সাদাতকে হত্যা করে। এতে ইরানের প্রচ্ছন্ন মদদ ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। একই সময়ে লেবানীয় গৃহযুদ্ধ ও ইসরাইলবিরোধী সংগ্রামে সিরিয়াকে সাথে নিয়ে ইরান হিজবুল্লাহসহ শিয়া লেবাননীয় সংগঠনগুলোকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা দিতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের অন্য সমাজবাদী দেশগুলোর মতো মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে এবং বামপন্থা থেকে অনেকাংশেই সরে আসে। এই সময় সৌদি আরব ও ইরান ইসলামপন্থীদের মদদ দিয়ে সরাসরি সরকার উত্খাতের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৯১-২০০২ পর্যন্ত আলজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ তার প্রমাণ। ৯/১১-এর পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হলে তা ‘দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ’-এ পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণের পর মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমাবিরোধিতা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে তুঙ্গে ওঠে।
ফলে সাধারণ মুসলিমদের মনেও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতও যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ইরান এই সুযোগ পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে। বিশেষত ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইল-সীমান্তবর্তী দেশ লেবানন ও সিরিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে ঢালাও সহযোগিতা করতে থাকে তারা। সৌদি আরব নিজেও এই সুযোগ গ্রহণ করে, কিন্তু পাশাপাশি মার্কিন সমর্থক হওয়ার কারণে এবং শিয়া ইরান সুন্নি সৌদিদের প্রভাবকে সব দিক থেকে খর্ব করার চেষ্টা চালাতে থাকায় তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে রাখে। এত দিন উপসাগরীয় দেশগুলো সৌদিদের পক্ষে থাকলেও কাতার শেষ পর্যন্ত দলত্যাগ করে। সৌদি রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে গাঁটছাড়া হয় মুসলিম ব্রাদারহুডও।
এবার কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দেওয়া শুরু করে। তুরস্কে সেনাবাহিনীর মদদে দীর্ঘদিন ইসলামবাদীদের দাবিয়ে রাখার হলেও শেষ পর্যন্ত ২০০২-এ ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। ২০১০-এ আরব বসন্ত শুরু হলে ইরান ও সৌদিরা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যথাক্রমে সরকার উত্খাত ও সরকার অধিষ্ঠানে ব্যস্ত হয়। তবে সিরিয়া ও লিবিয়াতে তাদের ভূমিকা ছিল উল্টো। ইরান ও সৌদি আরবের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করা। সেজন্য তারা নিজ আদর্শের বিপরীতমুখী অবস্থান নিতেও পিছপা হয়নি। আর নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তারা নিজ নিজ ধর্মীয় উপগোষ্ঠীর দিকে হাত বাড়ায়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যেও ‘দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ’ শুরু হয়, যাকে ‘ইসলামী শীতল যুদ্ধ’ বলা চলে। সুন্নি-শিয়াদের মধ্যকার এই যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্য তছনছ করে দিয়েছে। তবে এর ডামাডোলের মধ্যেই ফিলিস্তিনিরা অনবরত ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে।
কিন্তু সৌদি আরব ও তার মিত্ররা ইরান-সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তারা তা অগ্রাহ্য করে। উপরন্তু ইরান ও তার মিত্রদের কট্টর ইসরাইলবিদ্বেষকে পুঁজি করে ইসরায়েলের প্রতি উদ্বাহু হয়ে ওঠে তারা। ইসরাইলও এই আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই মৈত্রী প্রক্রিয়া জমে ওঠে, যার চরম পরিণতি হলো ‘ইব্রাহিম ঐকমত্য’। তবে শুধু ইরান ও তার প্রভাব বলয় থেকে নয়, সৌদি আরব তার নিজস্ব প্রভাব বলয়ের এক দলত্যাগী অংশ থেকেও তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। এই ইসরাইলবিরোধী বিদ্রোহী দল হল মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থক কাতার-তুরস্ক। সৌদিদের বিপক্ষে ইরানকে সমর্থন দিচ্ছে তারা। অন্য দিকে শিয়াশাসিত ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের অব্যহত সমর্থন এবং হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য শিয়া গোষ্ঠীর তৎপরতা মুসলিম বিশ্বে সুন্নি-শিয়া বিভেদকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
প্রায় সম্পূর্ণ সুন্নি মতবাদানুসারী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তাই ইরান-বলয়ের প্রতি অবিশ্বাস ও ক্রোধ বাড়ছে। অন্য দিকে মুসলিম ব্রাদারহুড ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কের সাথে আগে ইসরাইলের যে অস্বাভাবিক রকম সুসম্পর্ক ছিল তা সম্পূর্ণ উল্টে গেছে। ইরানের মতো তুরস্কও এখন কট্টর ইসরাইলবিরোধী, যদিও তা পুরোপুরি প্রকাশ্য নয়। ফিলিস্তিনের জন্য নিরঙ্কুশ সমর্থন পাওয়ার একমাত্র ভরসা তাই কাতার-তুরস্ক। কিন্তু কাতারও যেমন মার্কিনিদের সাথে মৈত্রী বন্ধনে আবদ্ধ, তেমনি তুরস্ক ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। তাই তাদের পক্ষেও ফিলিস্তিনকে কতখানি সমর্থন দেয়া সম্ভব, তা বলা কঠিন। ফলে নিজ জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ফিলিস্তিনিরা এই মিত্রহীন মধ্যপ্রাচ্যে কতটা সফল হবে, তাই এখন দেখবার বিষয়।