ইসরাইল যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো?
ইসরাইল যেভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো? - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বের প্রায় দুই কোটি জনসংখ্যার অধিকারী ইহুদিদের দাবি অনুসারে, দু’হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে দেশে দেশে উদ্বাস্তু হিসেবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব ইহুদিদের বেশির ভাগই প্রধানত ইউরোপ বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বসবাস করেছে। এ সময়জুড়ে বিগত বা ধর্মীয় কারণে ইহুদিবিদ্বেষ ক্রমশ চরম আকার ধারণ করে। রোমান আমল থেকে ইউরোপে আগমণকারী ইহুদিরা প্রধানত ইবেরীয় উপদ্বীপ ও মধ্য ইউরোপে বসতি স্থাপন করে। কিন্তু শত শত বছর ধরে চলমান ইহুদিবিদ্বেষী মনোভাব মাঝে মাঝেই সহিংস রূপ নিত, কখনো কখনো এমনকি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘রিকোনকিস্তা’-র পর ‘স্প্যানিশ ইনকুইজিশন’। ১৪৯২ সালে স্পেন মুর হাত থেকে স্পেনীয়দের হাতে চলে আসার পর স্পেন থেকে মুসলিম মুরদের পাশাপাশি ইহুদিদেরও ব্যাপকভাবে বহিষ্কার ও ধর্মান্তরিত করা হয়। শেষ পর্যন্ত ক্যাথলিক চার্চ খ্রিস্ট ধর্ম বিশুদ্ধতা রক্ষায় প্রায় সব মুসলিম ও ইহুদিদের বিতাড়িত করে। এসব ইহুদিরা দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় নতুন করে বসতি স্থাপন করে। একই ঘটনা ঘটে পর্তুগালেও। অন্যদিকে মধ্য ইউরোপে, বিশেষত জার্মানিতে বসতকারী ইহুদিরাও বারংবার নির্যাতনের শিকার হয়ে সে দেশ ছেড়ে প্রধানত পূর্ব ইউরোপের অন্যান্য দেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু সেখানেও তারা নির্যাতিত হতেই থাকে। শেষ পর্যন্ত সতের শ’ শতকে ইউরোপীয় জ্ঞানোদ্দীপন ইহুদিদের মধ্যে প্রসারিত হলে ইহুদি বুদ্ধিজীবিদের মনে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় মুক্তির চেতনা জাগ্রত হয়। তারা ইউরোপসহ বিশ্বের সব ইহুদির জন্য নিজস্ব আলাদা বাসভূমির দাবি তোলে। এরই মধ্যে ইউরোপে ইহুদিবিদ্বেষ এমন চরম আকার ধারন করে যে, ইহুদিরা ইউরোপ ছেড়ে ব্যাপক হারে আমেরিকাসহ নতুন বিশ্বের দেশগুলোতে অভিবাসিত হতে থাকে। এতে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদ আরো বৃদ্ধি পায়। এরই মধ্যে ইহুদি-হাঙ্গেরীয় এক নেতা থিওদোর হার্ত্জল জায়নবাদের উত্থাপন করেন। জেরুসালেমের অদূরবর্তী জায়ন পাহাড় থেকে এই নাম।
হার্ত্জল বলেন, ইহুদিদের জন্য শুধু আলাদা বাসভূমি নয়, তাদের পূর্বপুরুষের দেশ, অর্থাৎ তত্কালীন ওসমানীয় সাম্রাজ্যের ফিলিস্তিন অঞ্চলেই একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে দিতে হবে। এ মতবাদ ইহুদিদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। ইহুদি নেতাদের মাধ্যমে জায়নবাদ ইউরোপের নেতৃবৃন্দের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পায়। ইতিমধ্যে কিছু কিছু ইহুদি ফিলিস্তিনে পাড়ি জমাতে শুরু করে। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ও ওসমানীয় সাম্রাজ্য পরষ্পরের মুখোমুখি হলে ইহুদির বিষয়টি ব্রিটিশদের নজরে আসে। তাই যুদ্ধের পর ফিলিস্তিনকে ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’-এ পরিণত করা হলে সেখানে ব্রিটিশ তত্ত্বাবধানে ব্যাপক হারে ইহুদিদের প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। ফলে স্থানীয় আরব মুসলিমদের সাথে ইহুদি বসতকারী ও ব্রিটিশ প্রশাসনের সংঘাত শুরু হয়। অন্য দিকে ইহুদিরাও ব্রিটিশদের সহায়তায় নতুন দেশে এলেও আবারও ইউরোপীয়দের অধীনে বসবাস করতে অস্বীকার করে। ফলে তারাও ব্রিটিশবিরোধী এবং আরববিরোধী সহিংসতায় লিপ্ত হয়। ১৯৪৭ সালে এই ত্রিমুখী সংঘাত গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশরা ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে। জাতিসঙ্ঘ ‘ম্যান্ডেটরি প্যালেস্টাইন’-কে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করে। অন্য দিকে ইহুদিরা স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা দেয়। ফিলিস্তিনের আরব মুসলিমরা তাদের দেশ রক্ষার্থে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা পরাজিত হয়। তারা জাতিসঙ্ঘ বরাদ্ধকৃত ফিলিস্তিনিদের ভূমির ৬০% দখল করে। এ সময় ৭ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে তাদের দেশ থেকে বিতাড়িত করা হয়। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা জর্দান, সিরিয়া, লেবানন, মিসরসহ বিভিন্ন আরব দেশে উদ্বাস্তু শিবিরে ঠাঁই নেয়।
অন্য দিকে ইহুদি প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার পর থেকে অন্যান্য আরব দেশও এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের নানাভাবে স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকেই আরব দেশগুলোর সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ইসরাইল। আরব মুসলিম ফিলিস্তিনিদের দেশ দখল করে পশ্চিমাদের তাঁবেদারি জায়নবাদী ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল গঠন করা হয়েছে - এই দাবিতে গৃহযুদ্ধ শেষ হওয়ার সাথে সাথে ১৯৪৮ সালে আরব লীগের অধীনে লেবানন, সিরিয়া, ইরাক, জর্দান, মিসর, সৌদি আরব ও ইয়েমেন একযোগে আক্রমণ করে সদ্য ভূমিষ্ট ইসরাইলি রাষ্ট্রকে। কিন্তু ইসরাইল এবারও বিজয়ী হয়।