ফিলিস্তিনিরা কেন সশস্ত্র দিকে ঝুঁকেছিল?
ইয়াসির আরাফাত - ছবি সংগৃহীত
ইসরাইলের কাছে বারবার পরাজিত হওয়ার পর এবার ফিলিস্তিনি গেরিলারা গাজা উপত্যাকাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৯৫৯ সালে বাম ধারার সমাজতন্ত্রী সংগঠন ফাতাহ জন্ম নেয়। ১৯৬৪ সালে ফাতাহসহ আরো অনেক ফিলিস্তিনি সংগঠন একত্রে গঠন করে ‘প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন’ (পিএলও)। ১৯৫৬ সালে সুয়েজ নিয়ে মিসরের সাথে ব্রিটিশ-ফরাসিদের দ্বন্দ্ব শুরু হলে তারা ইসরাইলকে সাথে নিয়ে এক যোগে মিসর আক্রমণ করে। ইসরাইল সিনাই উপদ্বীপ দখল করে বসে। কিন্তু মিসর যুদ্ধে বিজয়ী হলে তারা তা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে এই প্রথম ইসরাইলকে সামরিকভাবে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয় কোনো আরব দেশ। এতে উৎসাহিত হয়ে ১৯৬৭ সালে মিসর, সিরিয়া, জর্দান ও ইরাক একযোগে আক্রমণ করে ইসরাইলকে। কিন্তু তারা এবার ভীষণভাবে পরাজিত হয়। ইসরায়েল মিসরের কাছ থেকে সিনাই ও গাজা, সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি, জর্দানের কাছ থেকে পশ্চিম তীর কেড়ে নেয়। ১৯৭৩ সালে ইয়োম কিপ্পুরের দিন মিসর ও সিরিয়া একযোগে ইসরাইলকে আক্রমণ করে। কিন্তু এবারও তারা পরাজিত হয়। এর মধ্য দিয়ে আরব দেশগুলোর সাথে ইসরাইলের সরাসরি যুদ্ধের দিন শেষ হয়। কিন্তু পিএলওসহ অন্যান্য সশস্ত্র সংগঠন গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যায়। দক্ষিণ লেবাননে পিএলও-সহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপগুলোর উপস্থিতি নিয়ে দেশটির মুসলিম-খ্রিস্টানদের মধ্যকার উত্তেজনা বাড়তে বাড়তে ১৯৭৫ সালে গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়।
এ সময় ফিলিস্তিনি গেরিলারা লেবানন থেকে ইসরাইলে ক্রমাগত হামলা চালালে ইসরাইলও লেবাননের গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৮২ সালে তারা শিয়া প্রধান দক্ষিণ লেবাননের কিছু অংশ দখল করে। কিন্তু এবার ইসরাইলকে কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়। লেবানীয় বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনিদের সাথে হাত মিলিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালাতে থাকে। ১৯৮৫ সালে ইসরাইল দক্ষিণ লেবানন ছাড়তে বাধ্য হলেও তাদের সহযোগী খ্রিস্টান সশস্ত্র গ্রুপগুলো দক্ষিণ লেবাননে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ অব্যহত রাখে।
একই বছর লেবাননে ইরানের মদদে শিয়া ইসলামপন্থী হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ১৯৮৭ সালে সৃষ্টি হয় মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সুন্নি ইসলামপন্থী হামাস। ফলে লেবাননে ইসরাইলবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়। ১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধ শেষ হলেও দক্ষিণ লেবানন সঙ্কট চলতেই থাকে। হিজবুল্লাহ ও ফিলিস্তিনিদের হাতে ইসরাইল ক্রমাগত নাস্তানাবুদ হতে থাকে। ২০০০ সালে দক্ষিণ লেবানন থেকে সম্পূর্ণ রূপে সরে আসে ইসরাইল। কিন্তু হিজবুল্লাহ-হামাসসহ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গ্রুপগুলো তাদের পিছু ছাড়ে না। ২০০৬ সালে আবারও ইসরাইল লেবাননে হিজবুল্লাহের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এই যুদ্ধ শেষ হয় অমীমাংসিতভাবে।
এ দিকে ২০০৫ সালে গাজা উপত্যাকা ইসরাইল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিলে ফিলিস্তিনিরা নিজস্ব সরকার নির্বাচন করে। নির্বাচনে ফাতাহ পশ্চিম তীরে এবং হামাস গাজায় বিজয়ী হয়। এরপর হামাস গাজার পুরো নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নেয়। গাজা থেকে ইসরাইলবিরোধী হামলা চালাতে থাকে হামাস। ইসরাইল নতুন করে গাজার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ২০০৮, ২০১২ ও ২০১৪ সালে হামাসের হামলার বিপরীতে গাজায় হামলা চালায় ইসরাইল।
এতসব সহিংসতার মধ্যেও কিন্তু ইসরাইল-ফিলিস্তিনি শান্তি আলোচনা কখনোই পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। ১৯৮৭-৯৩ সালব্যাপী প্রথম ফিলিস্তিনি গণভ্যূত্থানের পর ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি নেতৃবৃন্দ বুঝতে সক্ষম হয়, শান্তি প্রক্রিয়ার কোনো বিকল্প নেই। ১৯৯৩ সালে অসলো ঐক্যমতের মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও পিএলও পরষ্পরকে স্বীকৃতি দেয়।১৯৯৪ সালে গাজা-জেরিকো সমঝোতায় ফিলিস্তিনি স্বায়ত্ত্বশাসনের রূপরেখা নির্ধারিত হয়। কিন্তু এরপর নানা সম্মেলন ও আলাপ-আলোচনার পরও শান্তি প্রক্রিয়ায় তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। বরং ২০০০-০৫ সাল ব্যাপী ফিলিস্তিনি গণভ্যূত্থান কঠোর ও নির্মমভাবে দমন করা হলে বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের বিক্ষোভ-সহিংসতা এবং ইসরাইলি সেনাবাহিনীরা ব্যাপক নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে ফিলিস্তিনিদের শান্তির চেয়ে সহিংসতার দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ছে। বিশেষত ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশ জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা করা ও ২০১৯ সালের ট্রাম্প শান্তি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনিদের নামমাত্র স্বাধীনতা দেয়ার প্রস্তাবের ফলে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ফিলিস্তিনি জনতা ও নেতৃবৃন্দ এসব পদক্ষেপ ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করে। বিশেষত দখলকৃত পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি নির্মাণকে কেন্দ্র করে সহিংসতা ক্রমশ বাড়ছে।