ফিলিস্তিনিরা কি ইরানের দিকে ঝুঁকবে?
ইরান-ইসরাইল সঙ্ঘাত - ছবি সংগৃহীত
সুন্নি হওয়া সত্ত্বেও আল-কায়েদার সাথে সখ্য থাকে ইরানের। এর আগে সৌদি আরবও একই কাজ করে আসছিল মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম দেশগুলো জুড়ে, কিন্তু মার্কিনপন্থী হওয়ায় তাদের ইসলামবাদ সরাসরি মার্কিনীদের বিরুদ্ধে যায়নি। ইরান সেই সুযোগটি নেয়। একই কারণে ইসরাইলের প্রতি সৌদিদের নমনীয় মনোভাব এবং ইরানের উগ্র বিরোধিতা প্রকাশিত হয় মুসলিম বিশ্বজুড়ে। এতে ইসরাইলবিরোধী ও মার্কিনবিরোধী মনোভাব ব্যপকভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তা বামপন্থী সমাজবাদ থেকে ক্রমশ ডানপন্থী ইসলামবাদে রূপ নেয়। ১৯৮১ সালে ইসলামবাদী উগ্রপন্থীরা সাদাতকে হত্যা করে। এতে ইরানের প্রচ্ছন্ন মদদ ছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। একই সময়ে লেবানীয় গৃহযুদ্ধ ও ইসরাইলবিরোধী সংগ্রামে সিরিয়াকে সাথে নিয়ে ইরান হিজবুল্লাহসহ শিয়া লেবাননীয় সংগঠনগুলোকে সর্বপ্রকার সাহায্য-সহায়তা দিতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের অন্যান্য সমাজবাদী দেশগুলোর মত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে এবং বামপন্থা থেকে অনেকাংশেই সরে আসে। এই সময় সৌদি আরব ও ইরান ইসলামপন্থীদের মদদ দিয়ে সরাসরি সরকার উত্খাতের চেষ্টা শুরু করে। ১৯৯১-২০০২ পর্যন্ত আলজেরিয়ার গৃহযুদ্ধ তার প্রমাণ। ৯/১১-এর পর ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হলে তা ‘দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ’-এ পরিণত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ও ইরাক আক্রমণের পর মুসলিম বিশ্বে পশ্চিমাবিরোধিতা অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে তুঙ্গে ওঠে।
ফলে সাধারণ মুসলিমদের মনেও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতও যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। ইরান এই সুযোগ পুরো মাত্রায় গ্রহণ করে। বিশেষত ফিলিস্তিনি এবং ইসরাইল-সীমান্তবর্তী দেশ লেবানন ও সিরিয়ার শিয়া সম্প্রদায়ের সাথে ঢালাও সহযোগিতা করতে থাকে তারা। সৌদি আরব নিজেও এই সুযোগ গ্রহণ করে, কিন্তু পাশাপাশি মার্কিন সমর্থক হওয়ার কারণে এবং শিয়া ইরান সুন্নি সৌদিদের প্রভাবকে সব দিক থেকে খর্ব করার চেষ্টা চালাতে থাকায় তারা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে রাখে। এত দিন উপসাগরীয় দেশগুলো সৌদিদের পক্ষে থাকলেও কাতার শেষ পর্যন্ত দলত্যাগ করে। সৌদি রাজতন্ত্রের কর্তৃত্ব অস্বীকার করে গাঁটছাড়া হয় মুসলিম ব্রাদারহুডও।
এবার কাতার মুসলিম ব্রাদারহুডকে সমর্থন দেওয়া শুরু করে। তুরস্কে সেনাবাহিনীর মদদে দীর্ঘদিন ইসলামবাদীদের দাবিয়ে রাখার হলেও শেষ পর্যন্ত ২০০২-এ ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। ২০১০-এ আরব বসন্ত শুরু হলে ইরান ও সৌদিরা মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যথাক্রমে সরকার উত্খাত ও সরকার অধিষ্ঠানে ব্যস্ত হয়। তবে সিরিয়া ও লিবিয়াতে তাদের ভূমিকা ছিল উল্টো। ইরান ও সৌদি আরবের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে নিজেদের প্রভাব বলয় বৃদ্ধি করা। সেজন্য তারা নিজ আদর্শের বিপরীতমুখী অবস্থান নিতেও পিছপা হয়নি। আর নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তারা নিজ নিজ ধর্মীয় উপগোষ্ঠীর দিকে হাত বাড়ায়। ফলে মধ্যপ্রাচ্যেও ‘দ্বিতীয় শীতল যুদ্ধ’ শুরু হয়, যাকে ‘ইসলামী শীতল যুদ্ধ’ বলা চলে। সুন্নি-শিয়াদের মধ্যকার এই যুদ্ধ পুরো মধ্যপ্রাচ্য তছনছ করে দিয়েছে। তবে এর ডামাডোলের মধ্যেই ফিলিস্তিনিরা অনবরত ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার হতে থাকে।
কিন্তু সৌদি আরব ও তার মিত্ররা ইরান-সমস্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তারা তা অগ্রাহ্য করে। উপরন্তু ইরান ও তার মিত্রদের কট্টর ইসরাইলবিদ্বেষকে পুঁজি করে ইসরায়েলের প্রতি উদ্বাহু হয়ে ওঠে তারা। ইসরাইলও এই আমন্ত্রণ সাদরে গ্রহণ করে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, বিশেষত ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই মৈত্রী প্রক্রিয়া জমে ওঠে, যার চরম পরিণতি হলো ‘ইব্রাহিম ঐকমত্য’। তবে শুধু ইরান ও তার প্রভাব বলয় থেকে নয়, সৌদি আরব তার নিজস্ব প্রভাব বলয়ের এক দলত্যাগী অংশ থেকেও তীব্র বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। এই ইসরাইলবিরোধী বিদ্রোহী দল হল মুসলিম ব্রাদারহুড সমর্থক কাতার-তুরস্ক। সৌদিদের বিপক্ষে ইরানকে সমর্থন দিচ্ছে তারা। অন্য দিকে শিয়াশাসিত ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের অব্যহত সমর্থন এবং হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য শিয়া গোষ্ঠীর তত্পরতা মুসলিম বিশ্বে সুন্নি-শিয়া বিভেদকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
প্রায় সম্পূর্ণ সুন্নি মতবাদানুসারী ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তাই ইরান-বলয়ের প্রতি অবিশ্বাস ও ক্রোধ বাড়ছে।