আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাত
আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাত - ছবি সংগৃহীত
আরব-ইসরাইল সঙ্ঘাতও ভিন্ন মাত্রা লাভ করেছে গত কয়েক দশকে। পঞ্চাশের দশকে মিসরে সেনা অভূত্থানের পর জামাল আব্দেল নাসেরের ক্ষমতায় আহরণের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুগের সূচনা হয়। আরব জাতীয়তাবাদ, বৈশ্বিক আরববাদ ও আরব সমাজতন্ত্র জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পুরো মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। একে একে ইরাক, সিরিয়া, উত্তর ইয়েমেন, লিবিয়া, সুদান, আলজেরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সেনা অভ্যূত্থান বা সরাসরি যুদ্ধের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বামপন্থীরা। নাসের জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন সৃষ্টি করলেও মধ্যপ্রাচ্যের এই সব বামঘেঁষা সরকার ছিল সোভিয়েতদের প্রতি সহানুভূতিশীল। ফিলিস্তিনি সংগঠন পিএলও এবং এর অন্তর্গত ফাতাহ ও অন্যান্য সংগঠনগুলোও ছিল একই আদর্শে ব্রতী। অন্য দিকে সৌদি আরব, ওমান, বাহরাইন, কুয়েত, জর্দান, মরক্কোসহ রাজতান্ত্রিক দেশগুলো ছিল মার্কিনপন্থী ও ইসলামঘেঁষা। ফলে আরব দেশগুলোর নিজেদের মধ্যেই দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকে। পিএলওর ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে তা এর মূল ঘাঁটি জর্দানের সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ১৯৭০ সালে জর্দান ও পিএলও মুখোমুখি হয় এবং শেষ পর্যন্ত পিএলও পরাজিত হয়ে জর্দান ছাড়তে বাধ্য হয়।
মিসরে নাসেরের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসেন আনোয়ার সাদাত। ধীরে ধীরে বামাদর্শের পালে হাওয়া কমতে থাকে ও ইসলামতন্ত্রের পক্ষে মতামত বাড়তে থাকে। সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় তৈলরাজ্যগুলো ইসলামবাদীদের প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ইন্ধন জোগায়। বিশেষত মিসরীয় মুসলিম ব্রাদারহুড এসব সংগঠনের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। এদিকে সত্তরের দশকের মাঝামাঝি ইসরাইলের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর সাদাত ক্রমশ মার্কিনিদের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। ১৯৬৭ সালে আরব লীগ খার্তুম শপথের মধ্য দিয়ে ইসরাইলের সাথে সব ধরনের সংস্পর্শ বন্ধের যে অঙ্গীকার করে ছিল, তা ভঙ্গ করে ১৯৭৯ সালে মিসর প্রথম আরব ও মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে ইসরায়েলের সাথে শান্তি চু্ক্তি করে। মিসরীয় জনগণ অবশ্য তা সহজে গ্রহণ করেনি। বিশেষত ইসলামবাদীরা এতে সাদাতের প্রতি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়।
একই বছর আবার দু’টি বড় ঘটনা আরব ও মুসলিম বিশ্বকে হতচকিত করে। মার্কিনপন্থী ইরানের শাহের পতন হয় গণ-অভ্যূত্থানে, ক্ষমতায় বসে খোমেইনির শিয়া ধর্মগুরু শাসিত সরকার। সোভিয়েত-সমর্থিত সাম্যবাদী আফগান সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ নেয়, যা দমন করতে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তানে সৈন্য পাঠায়, ফলে শুরু হয় ভয়াবহ যুদ্ধের। আফগান যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে মুসলিমদের মনে ইসলামী জাতীয়বাদ তীব্র থেকে তীব্রতর করে, যা কাজে লাগায় সৌদিরা। কিন্তু ইরানের শিয়া ধর্মগুরুরাও একই কাজে নামে, কিন্তু প্রধানত সংখ্যালঘু শিয়াদের জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের শিয়া সম্প্রাদয়কে সুন্নি নিপীড়ন থেকে রক্ষার জন্য বদ্ধ পরিকর ইরান লেবানন, বাহরাইন, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে তৎপরতা শুরু করে। সিরিয়ায় বা’আস সরকারের নেতৃত্ব সংখ্যালঘু আলাউই শিয়া সম্প্রদায়ের হাতে থাকায় তারা ইরানের প্রধানতম মিত্রে পরিণত হয়। ইরানের শিয়া বিপ্লব প্রকল্প হয় দাঁড়ায় সুন্নি সৌদি আরবের প্রধান আশঙ্কার কারণ। ১৯৭৯ সালে শিয়া বিদ্রোহের ভয়ে সংখ্যালঘু সুন্নিদের প্রতিনিধি বা’আস পার্টির নেতা সাদ্দাম হুসেন ক্ষমতায় আসে ইরাকে। অন্য দিকে মধ্যপ্রাচ্যের বামশাসিত বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশগুলোতে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে সৌদিদের ডিঙিয়ে স্থানীয় ইসলামবাদীদের সমর্থন আদায়ে অগ্রসর হয় ইরান। বিশেষত মার্কিনঘেঁষা রাষ্ট্রগুলোতে ইসলামপন্থীদের সরকারবিরোধী কার্যক্রমে মদত দেয় ইরান।