কারাকোরাম : ট্রেকারদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু
কারাকোরাম - ছবি সংগৃহীত
পর্বতারোহণ বা ট্রেকিং যাদের প্রিয় পেশা- এমন অভিযাত্রীদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য হচ্ছে পাকিস্তানের কারাকোরাম পর্বতমালা। এটি হচ্ছে হিমালয় পর্বতমালার পর দ্বিতীয় উচ্চতম শৈলচূড়া।
এশিয়ার হিমবাহবিশিষ্ট এ পর্বতমালার অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন, ক্যাম্পে অবস্থান করে রাত আর দিনের হিম উপভোগ করা আর ধাপে ধাপে কষ্টকর ঊর্ধ্বমুখি অভিযাত্রা পরিচালনা- এ সব হচ্ছে বিশ্বের পর্বতারোহীদের জন্য উন্মাদনাপূর্ণ আকর্ষণ। তাই তো, দুঃসাহসী এ অভিযাত্রায় যোগ দিতে কারাকোরাম অঞ্চলে ছুটে আসেন দেশ-বিদেশের শত শত পর্বতপ্রেমী।
হিমালয় পর্বতমালা এশিয়ার মধ্য অঞ্চল থেকে দক্ষিণাঞ্চলকে আলাদা করে রেখেছে। হিমালয়ের গিরিসারি পশ্চিমে বিস্তৃত হয়ে কাশ্মির ও পাকিস্তানের উত্তর অংশে ২০০ মাইল জুড়ে অবস্থান করছে। এ পর্বতমালা থেকে উৎসারিত হয়েছে ঝিলাম, সিন্ধু ও শায়ক নদী।
আর এই কারাকোরাম পর্বতমালার দূর উত্তর শাখা গিয়ে ঠেকেছে চীনের ঝিংজায়াং প্রদেশের উইঘুর অঞ্চলে। এ পর্বতমালা ভেদ করে নির্মিত হয়েছে পাকিস্তানের গিলগিট থেকে চীনের কাশগর পর্যন্ত কারাকোরাম মহাসড়ক। চীনের সাথে পাকিস্তানের আর্থনৈতিক সম্পর্কের করিডোর।
কারাকোরাম রেঞ্জের পর্বতারোহীদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে কে-টু পর্বত। এর শৃঙ্গের উচ্চতা আট হাজার ছয় শ' এগারো মিটার। বরফ জমা শৃঙ্গে শীতকালে আরোহণ করা সম্ভব না হলেও পাদদেশে বেজ ক্যাম্পে জড়ো হতে শুরু করে হিম শিহরিত পর্বতারোহীরা।
এবার অভিযাত্রীদের জন্য কারাকোরাম পর্বতমালার প্রবেশদ্বার বলে পরিচিত স্কারডু থেকে একটি রাস্তা তৈরী করা হয়েছে বেস ক্যাম্পে যাবার জন্য।
আসলে পর্বতারোহীদের জন্য কারাকোরামে রয়েছে উন্মাদনাপূর্ণ আকর্ষণ। এখানে বেস ক্যাম্পে বরফজমা ঠাণ্ডায় কয়েক রাত আতিবাহিত করার শিহরণটাই আন্য রকম। কে-টু পর্বতের বালতোড়া হিমবাহ ছাড়াও রয়েছে আরো কয়েকটি ট্রেকিং সাইট। রয়েছে আরো বেশি অভিযাত্রীর জন্য অবস্থান করার সুবিধা। রয়েছে এক তাঁবু থেকে ওপরের তাঁবুতে চলাচলের পথ এবং দিনব্যাপী পর্বতারোহণের পাগল করা আকর্ষণ।
২০১৮ সালে ইমরান খান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার পর প্রথম ১০০ দিনের কর্মসূচিতে দেশের নিরাপত্তা ও পর্যটনকে বিশেষ গুরুত্ব দেবার কথা ঘোষণা দেন। সে আনুযায়ী আরো বেশি টুরিষ্ট ভিসা প্রদান, ই-ভিসা প্রবর্তন, ব্রিটিশ রাজপরিবারকে আতিথেয়তা প্রদান এবং আন্তর্জাতিক রুটে ইসলামাবাদের সাথে সরাসরি আকাশপথে যোগাযোগ চালু করা হয়।
এর মধ্যে করোনা সঙ্কটের কারণে বন্ধ থাকা পাকিস্তানের পর্যটন সেক্টরে আবার গতি আসতে শুরু করেছে বলে মনে করছেন।
দুনিয়া যার কাছে খোলা আঙিনা
আলমগীর কবির
দুনিয়া যার কাছে খোলা আঙিনার মতো, তিনি কাজী আসমা আজমেরী। তার আছে জাদুর মতো শক্তি। আর আছে স্বপ্নের সাগর। স্বপ্ন ভাসিয়ে দুনিয়াকে বশ মানিয়েছেন এই নারী। এখন পর্যন্ত পা রেখেছেন ১১৫টি দেশে।
কিভাবে সম্ভব!
একে তো তিনি নারী! তার ওপর সবুজ পাসপোর্টধারী! দুটোই দুনিয়া ভ্রমণের সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ওই সব দেয়াল টপকাতে পেরেছেন বলেই কাজী আসমা আজমেরীকে নিয়ে এই প্রতিবেদন।
সমাজ আর বাস্তবতার দেয়াল টপকানো খুব সহজ নয়। আবার হৃদয় থেকে চাইলে খুব কঠিনও নয়। আজমেরীর বেলায় কঠিন ছিল না। কারণ তার চোখ খুলে গিয়েছিল। খোলা চোখে দুনিয়াকে দেখেছেন। আর পায়ের ছাপও রেখে এসেছেন।
বাংলাদেশের বাস্তবতা বলছে, এমনটি অসম্ভব!
হ্যাঁ, আসমাকেও একই কথা জানিয়েছিলেন তার এক বন্ধুর মা।
সময়টা ছিল আজ থেকে ১২ বছর আগের। তখন আসমার চোখ অন্য আট-দশজনের মতোই ছিল। সবাই যা দেখতে পেত, তিনিও তাই দেখতেন। তবে সবাই যেমন করে ভাবতেন। তিনি ভাবতেন একটু অন্য রকম করে।
আসমার জেদ ছিল বাড়াবাড়ি রকমের। আর ছিল দারুণ চঞ্চলতা। তবে ও দুটোর কোনোটাই ব্যক্তিত্বকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি। বাবা কাজী গোলাম কিবরিয়া প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। মা কাজী শাহিদা আহমেদ বনেদি পরিবার থেকে এসেছেন। তাদের প্রথম সন্তান আসমা। আছে ছোট এক ভাই।
বাবা-মা আর দুই সন্তানের পরিপাটি পরিবার। আসমার জীবনের শুরুটা খুব রকম পরিপাটিই ছিল। খুলনায় পরিবারের সাথে থেকেই স্কুলে যাওয়া-আসা করতেন। খুলনা মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চলে আসেন ঢাকায়। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ, ইস্টওয়েস্ট থেকে এমবিএ শেষ করেন।
কেতাবি শিক্ষা আর পারিবারিক ইতিহাস দেখলে আসমার একজন ব্যবসায়ী হওয়ার কথা। কিন্তু তিনি হলেন ট্র্যাভেলার।
কেন?
তার চোখ খুলে গিয়েছিল বলেই বিশ্বকে বাড়ির আঙিনার মতো করে দেখতে পেয়েছিলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন।
২০০৭ সালে থাইল্যান্ড যান আসমা। ওটা ছিল গতানুগতিক ভ্রমণ, অন্য আট-দশজন যেমন করে যান। তখনো মাথায় দুনিয়া চষে বেড়ানোর চিন্তা আসেনি তার।
এক দিন শুনলেন তার এক বন্ধু ২৭টি দেশ ঘুরে এসেছেন। সেই বন্ধুকে দেখতে অনেকেই ভিড় করল। আসমাও গেলেন। ভ্রমণফেরত বন্ধুর দেখা পেয়ে তিনিও ভাসলেন আবেগে। বললেন, ‘পৃথিবী দেখতে আমিও যাবো’। কথাটা শুনলেন ওই বন্ধুর মা। তিনি আসমাকে অনেকটা কটু ভাষায় জানিয়ে দিলেন, একজন নারীর পক্ষে এটা সম্ভব নয়।
জেদি মেয়ে আসমা। কথাটা সহজভাবে নিতে পারলেন না। জেদ চেপে রাখলেন, এক দিন পৃথিবী দেখতে যাবেন-ই। কিন্তু চেপে রাখা এসব জেদ বেশি দিন লালন করা যায় না। অন্য বাস্তবতার সাথে বাতাসেই মিলিয়ে যায়। আসমার বেলায়ও তাই হলো।
তা হলে তিনি কী করে ট্র্যাভেলার হয়ে উঠলেন?
এবার জানুন কাজী আসমা আজমেরীর থেকেই, ‘নেপাল বেড়াতে গিয়ে আমার চিন্তাটা পাল্টে গেল। তখন ২০০৯ সাল। আমার শরীর ও মন খারাপ ছিল। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন হাওয়া বদল করার। হাওয়া বদলাতে অনেকে নেপালকেই বেছে নেয়। আমিও তা-ই নিলাম।’
তার পর?
আজমেরী বললেন, ‘হাওয়া বদলাতে গিয়ে নিজেই বদলে গেলাম। ঘটনাটা ঘটে যায় এক ঘণ্টার মধ্যে। কাঠমান্ডু থেকে হেলিকপ্টার ভাড়া করে এভারেস্ট দেখতে গেলাম। হিমালয়ের মাথার ওপর যখন কপ্টার উড়ছিল, আমার মনে হলো কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসেছি। এত দিন আটকে ছিলাম। বদ্ধ ছিলাম সামাজিক দেয়ালে। অথচ পৃথিবী বসে আছে আমার জন্য, খোলা আঙিনা নিয়ে। অনেক অনেক অজানা নিয়ে। তখন পৃথিবীকে দেখার প্রবল ইচ্ছা হলো। হিমালয়ের মাথার ওপর কপ্টারে চক্কর দিতে দিতেই সিদ্ধান্ত নিই আমি পৃথিবী দেখব।’
নেপাল থেকে ফিরে এসে নিজের গয়না বিক্রি করে দিলেন কাজী আসমা আজমেরী। ওই টাকা দিয়ে বেরিয়ে যান খোলা আঙিনায়। সেই যে শুরু, এখনো চলছে।
এখন তিনি আছেন নিউজিল্যান্ডে। এক শ’ ছাড়িয়ে আরো ১৫টি দেশের মাটি ছুঁয়ে আসা এই নারী ওই দেশে খণ্ডকালীন কাজ করছেন। কাজের বিরতিতে বাংলাদেশেও আসেন। আবার কাজে ফিরে যান। এবং ছোট্ট কচ্ছপের মতো পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে যান দুনিয়ার আঙিনায়।
আজমেরীর এই কচ্ছপযাত্রা মোটেও প্রমোদ ভ্রমণ নয়। অনেকটাই দুঃসাহসিক। তিনি এক্সট্রিম ট্র্যাভেলার। কেবল প্রকৃতির সুন্দর নয়, তিনি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যান মানুষের সুন্দরকেও। ঢুকে যান মানুষের কৃষ্টির ভেতর। ডুব দিয়ে আসেন সংস্কৃতি আর ইতিহাস থেকে।
ওই সবের সাথে নীল রঙের সাগর আর একটু গরম হাওয়া। আসমার হৃদয়ে ঢেউ তুলতে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না।
আর তিনি যেটা চান, দেশের মানুষের ভালোবাসা। কারণ তিনি দেশকে ভালোবাসেন। এত বছর নিউজিল্যান্ডে থেকেও ওই দেশের পাসপোর্ট নেননি। তিনি কেবল সবুজ পাসপোর্টের মালিক হয়েই থাকতে চান।
আসমার এই জেদের পেছনেও আছে আরেক গল্প। জানুন তার থেকেই, ‘তখন ২০১০ সাল। আমি গিয়েছিলাম ভিয়েতনামে। দিনটা মনে আছে ফেব্রুয়ারি মাসের ৯ তারিখ। ওই দিন সাড়ে ছয় ঘণ্টা আমাকে ইমিগ্রেশনে আটকে রাখা হয়েছিল কেবল বাংলাদেশী পাসপোর্টের কারণে।’
বাংলাদেশী পাসপোর্ট থাকলে সাড়ে ছয় ঘণ্টা আটকে থাকতে হবে কেন?
‘কারণ অনেক দেশ সবুজ পাসপোর্টকে বিশ্বাস করতে পারে না। অনেকেই বাংলাদেশী সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে গিয়ে ওই দেশে থেকে যায়। তাই কিছু কিছু দেশে সবুজ পাসপোর্ট দেখলেই সন্দেহ করা হয়।’
কাজী আসমা আজমেরী বললেন, ভিয়তেনামে তার সাথে যা ঘটেছিল, ‘ভিয়েতনাম ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাকে ২৩ ঘণ্টা কারাগারে আটকে রেখেছিল। তখন মনে অনেক ক্ষোভ জন্মেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম সেই রাতে। ওদের অজুহাত ছিল আমি রিটার্ন টিকিট করিনি। হোটেল বুক করিনি ইত্যাদি ইত্যাদি।’
সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে আরো কোনো বাধার মুখোমুখি হয়েছেন?
‘হ্যাঁ, বরাবরই হতে হয়। কিন্তু আমার জেদের কাছে ওসব বাধা টিকতে পারে না। ভিয়েতনামের ঘটনার পর ওই বছরই আমি গিয়েছিলাম সাইপ্রাস। দেশটিতে বাংলাদেশীদের জন্য অন অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা আছে। কিন্তু তার পরও ছাড় পাইনি। আগেরবারের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার হোটেল বুকিং, রিটার্ন টিকিট এবং ব্যাংক স্টেটমেন্ট নিতে ভুল করিনি। কিন্তু ওসব থাকার পরও সবুজ পাসপোর্ট দেখে আমাকে সন্দেহ করা হয়। সাইপ্রাসে ঢুকতে দেয়া হয়নি। ইমিগ্রেশন অফিসার আমাকে গলা ধাক্কা দিয়ে খাঁচায় ঢুকিয়ে দেয়। খাঁচার ভেতর ২৭ ঘণ্টার ওই লজ্জা কখনো ভুলতে পারব না। অপমানে আমি প্রতিজ্ঞা করি বাংলাদেশী পাসপোর্ট নিয়েই বিশ্ব ভ্রমণ করব। দেখিয়ে দিতে চাই বাংলাদেশীরা কাজ করতে যেমন অন্য দেশে যায়। তেমনভাবে ভ্রমণ করতেও যায়।’
সবুজ পাসপোর্টের এই জটিলতা কিভাবে দূর করা সম্ভব?
‘এর জন্য আমি কাজ করছি। চেষ্টা করছি বাংলাদেশের সবুজ রঙের পাসপোর্টের মানোন্নয়নে সহায়তা করতে। যারা অবৈধভাবে বিদেশ যান, তাদেরকে নিরুৎসাহিত করছি। সচেতন করছি। ভ্রমণ করতে গিয়ে থেকে যাওয়ার প্রবণতা দূর করতে বলছি। সবুজ পাসপোর্ট নিয়ে ভ্রমণে মানুষকে উৎসাহিত করছি।’
কাজী আসমা আজমেরী চান তার মতো করেই বাংলাদেশী আরো তরুণের সামনে খুলে যাক পৃথিবীর দরজা। এই দরজা সহজে খুলতে হলে চাই যুৎসই চাবি। আর এই চাবির কারিগরদের একজন তিনি নিজেকে মনে করেন। কেবল আসমাই নন, এই মনে করাটা গোটা দেশবাসীর। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বও এখন তাকে জানে।
কাজী আসমা আজমেরী, দুনিয়ার কাছে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন একজন ট্র্যাভেলার হিসেবে। ডাকসাইটে গণমাধ্যমগুলো তাকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। প্রকাশ করেছে আজমেরীর কচ্ছপযাত্রার বিশদ।
যিনি এতগুলো দেশ ঘুরেছেন, তার ঝুলি রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতায় ভরপুর থাকা স্বাভাবিক। আসমা জানালেন, সেসব তো আছেই। তবে একজন নারী হিসেবে যতটা বিপদের মুখে পড়ার কথা, ততটা তাকে পড়তে হয়নি। কারণ তিনি ছিলেন সদা সতর্ক।
সতর্ক থাকলেও কখনো কখনো পথিককে পথভোলা হতে হয়। আসমা জানালেন এমনই এক অভিজ্ঞতা, ‘একবার চেক রিপাবলিক থেকে পোল্যান্ড যাবো বলে ঠিক করেছি। যাচ্ছিলাম সড়কপথে। কিন্তু সড়কটা ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকবে ঠাহর করতে পারছিলাম না। অনেক অনেক পথ যাওয়ার পর জানতে পারলাম, আমি চলে এসেছি মরক্কো।’
সে এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। আসমা আজমেরী সলো ট্র্যাভেল করেছেন। অর্থাৎ পৃথিবীর বেশির ভাগ এলাকা ঘুরেছেন একা একাই। খুব দরকারে কিছু এলাকায় অন্য ট্র্যাভেলারদের সাথে দল বেঁধেছেন। এ ছাড়া একলা চলো নীতিই তার।
খোলা পৃথিবীতে নাঙা আকাশের নিচে একা এক নারী!
অনেকে হয়তো এতটা ভাবার সাহসই রাখেন না। কিন্তু আসমা সেটা করে দেখিয়েছেন। কেবল একা থাকার ঝুঁকি নয়, তিনি নিয়েছেন হিচহাইকিংয়ের ঝুঁকিও। ভ্রমণের পরিভাষায় এই শব্দটার অর্থ হলো, বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করা।
বাংলাদেশে ‘হিচহাইকিং’ পরিচিত না হলেও ইউরোপ, আমেরিকায় শব্দটার সাথে পরিচয় আছে। ওখানকার ট্রাক ড্রাইভাররা ‘বুড়ো আঙুল’ দেখে অভ্যস্ত। কোনো ট্র্যাভেলার যদি সড়কের পাশে বুড়ো আঙুল তুলে দাঁড়ান। তখন ট্রাক অথবা অন্য কোনো গাড়ির চালক বুঝে যান এর অর্থ। গাড়ি যে দিকে যাচ্ছে, ট্র্যাভেলারের গন্তব্যও যদি সে দিকে হয়, তা হলে তাকে তুলে নেন চালক। হিচহাইকিংয়ে ট্র্যাভেলারদের কাছ থেকে ভাড়া নেয়া হয় না। বিনিময় হয় হাসি ও সংস্কৃতির।
কাজী আসমা হিচহাইক করেছেন জর্জিয়া, নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ায়। অ্যাডভেঞ্চার বেশি হয়েছে জর্জিয়ায়। তবে হিচহাইক করতে গিয়ে বিপদের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। আসমা বললেন, ‘নারীদের জন্য হিচহাইক-এ চ্যালেঞ্জ আছে। আমি অনেক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। তবে ভাগ্য ভালো ওরকম বিড়ম্বনা হয়নি। তা ছাড়া রাতে কারো সাথে হিচহাইক করিনি। ২০১০ সালের একটা ঘটনার কথা বলা যায়। তুরস্কে গিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম। ওই দিন বেলা সাড়ে ১১টা থেকে প্রায় ৩টা পর্যন্ত একটা গাড়িতে ছিলাম। চালক কিছুটা অস্বাভাবিক আচরণ করছিল। ওর আচরণ দেখে আমি গাড়ি থেকে নেমে যাই।’
এক শ’ পেরিয়ে আরো ১৫টি দেশ, চাট্টিখানি কথা নয়। সবগুলোর তালিকা দিতে গেলে প্রতিবেদনের বড় একটি অংশ বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়াবে। আর সব দেশে আসমার অভিজ্ঞতা জানাতে গেলেও দরকার হতে পারে বড় এক কেতাব রচনা করা। তার চেয়ে ভালো ভূমির বৈশিষ্ট্য ধরে ধরে তার কয়েকটা অভিজ্ঞতা জেনে নেয়া।
আসমা জানালেন, মরুভূমি তার কাছে মোহময়। মরুর চিক চিক করা ক্যানভাস, বালিয়াড়ির ঢেউ জাদুর মতো। তিনি বললেন, ‘সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল সাহারা মরুতে। ওখানে পাঁচ দিনের একটা ট্রিপ ছিল। আমাদের সাথে ছিল ১১টি উটের বহর। মাথার ওপর গনগনে সূর্য, নিচে লাল রঙের তপ্ত বালু। অসাধারণ এক অনুভূতি। প্রতিদিন পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা করে উটের পিঠে করে চলতাম। এক দিন বালুঝড় আমাদের তছনছ করে দিতে চাইল। শরীরে উড়না পেঁচিয়ে কোনোরকম বাঁচতে পেরেছিলাম। তবু চোখে মোটা মোটা বালু ঢুকে গিয়েছিল। এমন পরিপুষ্ট বালু চোখের ভেতর ব্যাপক যন্ত্রণা দেয়।’
আজমেরী জানালেন, সাহারা মরুতে নিজেকে ইবনে বতুতা মনে হয়েছিল তার।
মরুর পর আসা যাক বরফের কাছে। শুনুন তার থেকেই, ‘আমি বেশ কিছু দিন শিকাগোতে থাকতাম। প্রতি সকালে হাঁটতে বের হতাম। অক্টোবর-নভেম্বরে মাঝে মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত তুষার জমে যেত। চলতে কষ্ট হতো। তবে অনুভূতি ছিল দারুণ। একবার লন্ডন থেকে প্যারিসে যাওয়ার সময় বরফ আমার পথ আগলেছিল। পরের সকালে প্যারিস পৌঁছতে পেরেছিলাম। তখন আমার পুরো শরীর তুষারঢাকা সাদা।’
আসমা জানালেন, তার আরো একটি রোমাঞ্চকর সময়ের কথা। সেই সময়টা কেটেছিল মঙ্গোলিয়ায়। দেশটা যাযাবরদের। রাজধানী উলানবাটোর ছাড়া প্রায় সবটাজুড়েই যাযাবরদের মতোই বসতি। দেশের লোকেরা পশু চরায়। থাকে দুই রকম বাড়িতে। শীতে এক রকম। গ্রীষ্মে অন্য রকম। পশুর জন্য তৃণভূমি পেতে যাযাবরদের রকম পাল্টাতে হয়।
তিনি বললেন, ‘মঙ্গোলিয়ায় চেঙ্গিস খানের সাম্রাজ্যের গুপ্তধন দেখতে গিয়েছিলাম। ওখানে যেতে হয় ঘোড়ায় করে। মঙ্গোলিয়ানরা কিন্তু ঘোড়ার মাংসও খায়।’
এমন করে নিজের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা শোনান কাজী আসমা আজমেরী। এসব মন দিয়ে শোনে স্কুল-কলেজের কিশোর-তরুণরা। এরা আসমার গল্প থেকে রসদ নিয়ে নিজেদের স্বপ্ন তৈরি করে।
আসমা বিশ্বাস করেন, এক দিন এই স্বপ্নবাজরাই দুনিয়া জয় করবে।