পশ্চিমবঙ্গের ভোটের হিসাব বদলে দেবেন আব্বাস সিদ্দিকি?
আব্বাস সিদ্দিকি - ছবি সংগৃহীত
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিধানসভার ভোটে মুসলিম, দলিত ও আদিবাসীদের জন্য একটা নতুন রাজনৈতিক দল তৈরির পরিকল্পনা করছেন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি।
এই দল ঘোষণা করা হবে ২১ জানুয়ারি। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম-দলিত-আদিবাসী ভোট এত দিন মূলধারার দলগুলোই পেত, কিন্তু এই শ্রেণির মানুষের স্বার্থ রক্ষায় সব দলই ব্যর্থ হয়েছে বলেই তার নতুন দল গড়ার সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন সিদ্দিকি।
কয়েক মাসের মধ্যেই বিধানসভার যে নির্বাচন হতে চলেছে, সেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট সব দলের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ।
এত দিন এই ভোটের সিংহভাগ পেয়ে এসেছে রাজ্যের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস, কিন্তু এবার ওই ভোট ভাগাভাগি হতে চলেছে।
মাস কয়েক আগে হায়দ্রাবাদভিত্তিক মুসলিম প্রধান দল এআইএমআইএম-এর প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ঘোষণা করেছেন যে তার দল পশ্চিমবঙ্গের ভোটে নামবে।
আর এখন ফুরফুরা শরিফের পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি বলছেন তিনিও একটি নতুন দল তৈরি করতে চলেছেন মুসলিম-দলিত এবং আদিবাসী শ্রেণির মানুষদের জন্য। বিধানসভা ভোটে তারাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।
সিদ্দিকি বলেছেন, ৭৪ বছর ধরে এইসব মানুষকে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
''আমাদের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, সংসদীয় রাজনীতিতে এসে এইসব অসহায় মানুষের হয়ে আওয়াজ তোলা আমার দরকার। সেজন্যই দল গড়ছি। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি যদি এটা আগে করতে পারত, তাহলে আমাদের এগিয়ে আসার দরকার হতো না," বিবিসি বাংলাকে বলেন সিদ্দিকি।
তিনি আরো বলছেন যে মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনতার পর থেকে কোনো দিনই মুসলমান সমাজের উন্নয়নের জন্য বিশেষ কিছু করেনি। তারা মুসলমানদের ভোট ব্যাংক হিসাবে ব্যবহার করে এসেছে। তাই তারা মনে করছেন যে তাদের নিজেদের একটা রাজনৈতিক দল প্রয়োজন - যেটি শিক্ষিত - মধ্যবিত্ত মুসলমানদের আশা আকাঙ্ক্ষার কথা রাজনৈতিক পরিসরে তুলে ধরতে পারবে।
পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান সমাজের ওপর নজর রাখেন কলকাতার সাংবাদিক মোক্তার হোসেন মন্ডল। তিনি ব্যাখ্যা করছিলেন যে দীর্ঘ সময় ধরে কংগ্রেস, বাম, তৃণমূল কংগ্রেসের মতো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোকেই রাজ্যের মুসলমানরা ভোট দিয়ে এসেছেন।
"কিন্তু এখন মুসলমান সমাজের শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা প্রশ্ন তুলছে যে এভাবে শুধুই তো ওইসব দলের ওপরে ভরসা করে থাকা যায় না। যে রাজ্যেই মুসলিমরা নিজেদের আইডেন্টিটি পলিটিকস করেছে, সেখানে তাদের উন্নয়ন হয়েছে।
''আসামে করেছেন বদরুদ্দিন আজমল। সে রাজ্যের মুসলমানরা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন। কেরালায় মুসলিম লীগ আছে, সেখানকার মুসলিমরা উন্নতি করেছে। হায়দ্রাবাদ-তেলেঙ্গানায় ওয়াইসির এআইএমআইএম আছে, তার ফলে উন্নয়ন হয়েছে। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই মুসলমানরা সেক্যুলার দলের সঙ্গে থেকেছে বলেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা এই রাজ্যে," বলেন মন্ডল।
"আরো একটা কারণে আব্বাস সিদ্দিকির দিকে মুসলমানরা ভিড়ছে। তৃণমূল কংগ্রেসের যেসব নেতার সঙ্গে মুসলমান সমাজের সঙ্গে একটা সম্পর্ক ছিল - যেমন মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী - তারা বিজেপিতে চলে গেছেন,'' বলছেন মন্ডল। "তাই এই ভয়ও তৈরি হয়েছে মুসলমানদের মনে যে আজ যে তৃণমূল কংগ্রেস নেতাকে ভোট দিয়ে জেতানো হলো, কাল যদি সে বিজেপিতে চলে যায়?"
মাস কয়েক ধরেই আব্বাস সিদ্দিকি দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে জলসা করছেন। তার সমাবেশগুলো রাজনৈতিক সমাবেশ না হলেও সেগুলোতে তিনি মূলত রাজনৈতিক বক্তব্যই রাখছেন। তাই তার রাজনৈতিক দল গড়ার ঘোষণা হয়তো সময়ের অপেক্ষা ছিল।
কিন্তু মুসলমানদের নতুন রাজনৈতিক দল হলে তারা সমাজবদ্ধভাবে যে বিজেপি-র বিরোধিতা করে, তাদেরই আখেরে লাভ হবে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক অরুন্ধতী মুখার্জী।
"আগে যেটা ভাবা হচ্ছিল যে এবারের ভোট হয়তো দ্বিমুখী হবে তৃণমূল কংগ্রেস আর বিজেপির মধ্যে। কিন্তু এখন বহুমুখী ভোট হতে চলেছে। মুসলিমরা একটা বড় ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে চলেছে। আর তারা ভোটে দাঁড়ালে যে (দলের) ভোট ভাগ হবে, সেটা কিন্তু প্রায় পুরোটাই তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এতে বিজেপি তো কিছুটা লাভবান হবেই," ব্যাখ্যা করেছেন অরুন্ধতী মুখার্জী।
তৃণমূল কংগ্রেস মনে করে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি বা আব্বাস সিদ্দিকির ভোটের আসরে নামা আসলে বিজেপিরই একটা নির্বাচনী কৌশল - যাতে মুসলিম ভোট ভাগাভাগি হয়ে যায় আর বিজেপি সেই সুবিধাটা পায়।
আব্বাস সিদ্দিকি অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করছেন।
"আমাদের আসার কারণে বিজেপি-র সুবিধা কী করে হবে? আমরা কি তাদের হয়ে প্রচার করব? আসলে এই রাজ্যে কত ছোট বড় দল সামনে আসছে - কই তাদের বেলায় তো এই কথা বলা হয় না যে তারা বিজেপির সুবিধা করে দিচ্ছে!
''আমরা ইসলাম ধর্মের অনুসারী - রাজনীতিতে আসছি, তাই এসব কথা বলে একটা বিভ্রান্তিমূলক প্রচার করা হচ্ছে। মানুষের সামনে একটা ভুল ছবি তুলে ধরা হচ্ছে," বলেন সিদ্দিকি।
নতুন রাজনৈতিক দলটির সঙ্গে অন্যান্য দলের এখন আলাপ আলোচনা চলছে জোট নিয়ে।
কিছুদিন আগে আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ফুরফুরা শরিফে গিয়ে সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করেছেন। কিন্তু কোন কোন দলের সঙ্গে জোট হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি বলেই জানাচ্ছেন আব্বাস সিদ্দিকি।
সূত্র : বিবিসি