হজরত আব্বাস ও ওমায়েরের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী
হজরত আব্বাস ও ওমায়েরের ইসলাম গ্রহণের কাহিনী - ছবি সংগৃহীত
আল্লাহ তায়ালা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁরা নিজ নিজ জাতিকে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। দাওয়াতের উপকরণ হিসেবে তাদের সাথে ছিল আল্লাহ প্রদত্ত আসমানি কিতাব ও মুজিজা। মুজিজা হলো অভ্যাসেরবহির্ভূত এমন কাজ যা নবুয়তের দাবিদার ব্যক্তি থেকে প্রকাশ পায়। প্রত্যেক নবীকেই কমবেশি মুজিজা দেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশি মুজিজা ছিল বিশ্বনবী সা:-এর। তাঁর মুজিজা বা অলৌকিক কর্ম দেখে অনেক কাফির ইসলাম গ্রহণ করেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম মহানবী সা:-এর চাচা হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব এবং ওমায়ের ইবনে ওহাব রা:।
হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা: হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা: ও উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- হজরত আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিব রা: বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। তার মুক্তিদান স্বরূপ একটি অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়, যেন তিনি তা প্রদান করে মুক্ত হতে পারেন। হজরত আব্বাস রা: বললেন- ভাতিজা! আমার দেয়ার মতো কিছু নেই। তুমি ইচ্ছা করলে এমনিতেই আমাকে ছাড়তে পারো। মহানবী সা: বললেন- ‘চাচা! সেই মালের কী হয়েছে, যা আপনি চাচী উম্মে ফজলের কাছে মাটিতে পুঁতে রেখে এসেছেন? আর যুদ্ধে আসার সময় বলে এসেছেন, যদি আমি যুদ্ধে মারা যাই এ মাল আমার সন্তান-সন্ততি পাবে। আর যদি বন্দী হই তাহলে মুক্তিপণ হিসেবে তা প্রদান করবে। কারণ, হজরত আব্বাস রা: মহানবী সা:-এর কথা শ্রবণ করে বিস্মিত হন। আমিও আমার স্ত্রী উম্মে ফজলের মাঝে যে কথা হয়েছে তা তো ভাতিজা জানার কথা নয়। অতপর হজরত আব্বাস রা: মহানবী সা:কে সত্য নবী হিসেবে স্বীকার করে নেন এবং ইসলামে দীক্ষিত হন। (মুসনাদ আহমদ, বায়হাকি, হাকেম)
হজরত ওমায়ের ইবনে ওহাব রা:-এর ইসলাম গ্রহণ : হজরত ওমায়ের ইবনে ওহাব ছিলেন কট্টর ইসলামবিদ্বেষী। তার পুত্র ওহাব ইবনে ওমায়ের বদর যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে বন্দী হন। বদর যুদ্ধের পরে একদিন ওমায়ের কাবার হাতিমে বসে সাফওয়ান ইবনে উমাইয়ার সাথে বদর যুদ্ধ প্রসঙ্গে আলাপ করছিলেন।
সাফওয়ান বলছেন, বদর যুদ্ধে আমাদের এতগুলো নেতা নিহত হলো এবং তাদের দেহ একটি নোঙরা কূপে নিক্ষেপ করা হলো। তাদের অনুপস্থিতিতে আমাদের বেঁচে থাকার কী মূল্য আছে! ওমায়ের প্রত্যুত্তরে বলেছেন, আল্লাহর শপথ! তুমি সত্য কথাই বলেছ। আমি যদি ঋণগ্রস্ত না হতাম এবং আমার পরিবার পরিজনের চিন্তা না থাকত, তাহলে আমি মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদকে শেষ করে দিতাম। কিন্তু আমার ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য নেই, তা ছাড়া পরিবার পরিজনও আমার অবর্তমানে নিরাপদ থাকবে না। আরেকটি বিষয় হলো- আমার ছেলে তাদের হাতে বন্দী আছে।
সাফওয়ান সব কথা শুনে বললেন- ওমায়ের, শোনো! তোমার ঋণ পরিশোধের দায়িত্ব আমার, আমি তা পরিশোধ করব এবং তোমার পরিবারের দায়িত্বও আমি নেবো। আজীবন তোমার পরিবারকে আমার পরিবারের মতো দেখাশোনা করব। ওমায়ের বললেন ঠিক আছে! তবে আমাদের এ কথা যেন সম্পূর্ণরূপে গোপন থাকে। সাফওয়ান বললেন, হ্যাঁ অবশ্যই গোপন থাকবে। যে সিদ্ধান্ত সে কাজ। ওমায়ের বাড়িতে গিয়ে তার তরবারি ধার করলেন এবং তাতে বিষ মিশালেন। অতপর উন্মুক্ত তরবারি নিয়ে মদিনার পথে রওনা হলেন। মদিনায় গিয়ে মসজিদে নববীর সামনে উট বসালেন। এমন সময় হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব রা:-এর দৃষ্টি তার দিকে গিয়ে পড়ল। তিনি ধারণা করলেন, ওমায়ের ভালো উদ্দেশ্যে এখানে আসেনি, অবশ্যই খারাপ উদ্দেশ্যে এসেছে। হজরত ওমর রা: রাসূলুল্লাহ সা:কে বললেন, ওমায়ের তরবারি গলায় ঝুলিয়ে এসেছে, তার উদ্দেশ্য ভালো নয়। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন ওকে আমার কাছে নিয়ে আসো। হজরত ওমর রা: ওমায়েরকে চেপে ধরে রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে নিয়ে আসেন। হজরত ওমর রা: কয়েকজন আনসার সাহাবিকে বললেন, তোমরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর কাছে থাকবে। কারণ একে বিশ্বাস করা যায় না।
রাসূলুল্লাহ সা: ওমায়েরকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে রাখতে দেখে হজরত ওমর রা:কে বললেন, ওকে ছেড়ে দাও। রাসূলুল্লাহ সা: ওমায়েরকে কাছে ডেকে বললেন, ‘হে ওমায়ের! তুমি কেন এসেছ? তিনি বললেন- আপনাদের কাছে যে বন্দী রয়েছে সে ব্যাপারে এসেছি। আপনারা আমার ছেলের ব্যাপারে অনুগ্রহ করুন। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তাহলে তোমার গলায় তরবারি কেন? তিনি আবার আগের কথা বললেন, যুদ্ধবন্দী সম্পর্কে আলোচনার জন্য এসেছি। রাসূলুল্লাহ সা: বললেন, তা সত্য নয়। তুমি ও সাফওয়ান কাবা শরিফের হাতিমে বসেছিলে এবং নিহত কোরাইশদের লাশ কূপে ফেলার প্রসঙ্গে আফসোস করছিলে। তারপর তুমি বলেছিলে, যদি আমি ঋণগ্রস্ত না হতাম এবং আমার পরিবার পরিজন না থাকত, তবে আমি মদিনায় গিয়ে মুহাম্মদকে হত্যা করতাম। তোমার কথা শুনার পর সাফওয়ান তোমার ঋণ ও পরিবার পরিজনের দায়িত্ব নিয়েছে। এ কথা কি ঠিক? শোনো! আল্লাহ তায়ালা আমার ও তোমাদের মধ্যে অন্তরায় হয়ে আছেন।
আল্লাহ আমার রক্ষক। ওমায়ের তখন অবাক হয়ে বললেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল। (ইবনে হিশাম, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৬৬০) মহানবী সা:কে আল্লাহ তায়ালা অনেক বিষয় জানিয়ে দিয়েছেন। তাই তিনি বলতে পেরেছেন। তা গায়েবের সংবাদ দান নয় বরং মহানবী সা:-এর মুজিজা বা অলৌকিক সংবাদ।
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল-জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী