প্রসঙ্গ আনুশকা ও দিহান : একটা গুরুত্বপূর্ণ নোট
আনুশকা ও দিহান - ছবি সংগৃহীত
ভেবেছিলাম বিষয়টা নিয়ে লিখব না। কিন্তু ঘটনাটা মনের ভেতর এত বেশি আঘাত করেছে যে না লিখে পারলাম না। আনুশকার মৃত্যু আমাদের অসুস্থ সমাজের একটা প্রতীকী মৃত্যু। আমাদের সমাজ যে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে অবধারিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তারই একটা অন্যতম দৃষ্টান্ত।
কিছু অপ্রিয় কথা এখানে বলতেই হবে। নিজেদের আমরা যদি খুঁড়ে না দেখি, নিজেদের আমরা কখনোই চিনতে পারব না।
প্রথমত আমরা 'সেক্স' শব্দটাকে একটা নিষিদ্ধ শব্দ হিসাবে গণ্য করি। যেন এই শব্দ ভুল করেও উচ্চারণ করা যাবে না। উচ্চারণ করলেই সোজা দোযখে চলে যেতে হবে। আমার পরিষ্কার মনে আছে, আমি যখন ক্লাস টেনে পড়ি (মেয়েদের স্কুলে পড়েছি) আমার এক বান্ধবী আমাকে ভীষণ লজ্জিত মুখে জিজ্ঞেস করেছিল, 'আচ্ছা ফ্লোরা সেক্স মানে কী?' আমি উত্তর দেব কী, ওর কাচুমাচু করা চেহারা দেখে ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
সবচেয়ে বড় কথা, সেক্স শব্দটা দিয়ে যে প্রথমত লিঙ্গ বোঝায়, এটা আমরা মাথাতেই রাখি না। নারী, পুরুষ বা তৃতীয় লিঙ্গ। তারপরে আসে যৌনতার প্রসঙ্গ। এই 'যৌনতা'য় এসেই আমরা থেমে যাই। একদম সটান দাঁড়িয়ে, মুখে স্কচটেপ দিয়ে নিজেদের মুখ নিজেরা একদম বন্ধ করে ফেলি। কেন? কারণ এটা একটা শরীরী বিষয়। শরীর কী? খুব খারাপ জিনিস। শরীরের মতো খারাপ পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। অথচ এই শরীর আছে বলেই কিন্তু আমরা বেঁচে আছি। শরীর নেই তো বেঁচে থাকাও নেই। এটা কিন্তু মাথায় আসে না। এই যে মাথা শব্দটা বললাম। মাথা কী? মাথার সাথে মনের যোগাযোগ। তার মানে শরীরের সাথে আমাদের একটা মাথা বা মনও আছে। তো মনের কাজ কী? এখানে এসে আমরা আবার আরেক ধরনের ধাক্কা খাই। মন নিয়ে খুব বেশি ভাবার কিছু নেই। যেহেতু শরীর আছে, কাজেই শরীরের সাথে মন তো থাকবেই।
অথচ এই মন বা মাথা বা চিন্তা আমাদের জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এটা নিয়ে ভাবি না বললেই চলে। মনের বিস্তারিত বিষয়ে যাচ্ছি না, বহু কথা লিখতে হবে। সংক্ষেপে মন শরীর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে শরীর অচল হলেও সচল করা যায়, মন অচল হলে সহজে সচল করা যায় না।
খুব বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। আমাদের সমাজে সমাজ-মনের একটা অবক্ষয় বিগত বিশ/পঁচিশ বছর ধরে বেশি হারে গড়ে উঠেছে। কী চরম অবক্ষয়? প্রগতিশীল বনাম রক্ষণশীল অবক্ষয়। একদল উন্মুক্ত স্থানে প্রেমিকাকে চুমু দিয়ে ব্যাটাগিরি দেখাতে চায়। আরেকদল কন্যাসন্তানদের (ছেলেসন্তানদের না) এই বলে শিক্ষা দেয়, খবরদার স্কুল-কলেজে বা কোথাও ভুল করেও কোনো ছেলের দিকে তাকাবি না। তাকিয়েছিস তো ... বাকিটা নিশ্চয়ই বোঝা যাচ্ছে। অতি প্রগতিশীলতায় লাগাম ছাড়া যেমন হয়, অতি রক্ষণশীলতা নিষিদ্ধ বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আকৃষ্ট হয়। মাঝখানে বেচারা যৌনতা অসহায়ের মতো বলে, আমি রক্ষণশীলও না, প্রগতিশীলও না। আমি নির্ভেজাল প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক একটা অনুভূতি। প্রাকৃতিক ও অনুভূতি শব্দ দুটি লক্ষ্য করবেন। এটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। আর এই গুরুত্বপূর্ণ শব্দ দুটিই উপেক্ষিত হয় সবচেয়ে বেশি।
যৌনতাকে প্রথমেই একটা ভালগার বা রক্ষণশীল শব্দে রূপান্তরিত করি অথবা স্বেচ্ছাচার করে তুলি। সমস্যাটা এখানেই। এবং শুধু এখানেই। যৌনতা বা যৌন অনুভূতি অত্যন্ত প্রাকৃতিক এবং একইসঙ্গে স্বাভাবিক একটা অনুভূতি। এই অনুভূতি কেউ চাইলেও এড়াতে পারে না। অ্যাবসার্ড। এড়ালে বা অস্বীকার করলে সে অবশ্যই অস্বাভাবিক। যৌনতা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর একটা বিষয়। শারীরিক সাস্থ্যের মতোই এর বাড়াবাড়ি অথবা কার্পণ্য কোনোটাই করা উচিৎ না। তাহলে কী করা উচিৎ?
প্রথমেই 'যৌন' শব্দের ট্যাবুটা মাথা থেকে ঝেড়ে দিতে হবে। হাত, পা, হাড়ি, পাতিল, চাঁদ, সূর্যের মতো এটাও একটা শব্দ এটা বুঝতে হবে সবার আগে।
দ্বিতীয়ত নারী পুরুষ উভয়েই যে মানুষ, আলাদা প্রাণী নয়, সেটাও বুঝতে হবে। বলাই বাহুল্য এখানে তথাকথিত নারীবাদী অর্থে নারী-পুরুষ সমানের কথা বলা হচ্ছে না। কেউ কারোর সমান হতে পারে না, প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন বৈশিষ্ট নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এই মানুষ তার চেয়ে আরো গভীর অর্থ বহন করে। অর্থাৎ নারী-পুরুষ মানুষ ছাড়া আর কিছুই না।
তৃতীয়ত যৌন বিষয়টা প্রথম ও প্রধানত পরিবার বা ঘর থেকে খোলাসা করতে হবে। এবং যৌনতার এই নষ্টামি ঘর থেকেই শুরু হয় সবার আগে। একটা ছেলে বা মেয়ে যৌনতার হয়রানির শিকার হয় ঘর থেকে অর্থাৎ কাছের আত্মীয়স্বজন বা পাড়াপড়শির কাছ থেকে। কাজেই এই ক্ষেত্রে বাবা, মা বা আপু-ভাইয়া প্রত্যেকের দায়িত্ব কিশোর অবস্থায় যার যার ছেলে, মেয়ে, ভাই বা বোনদের সব খোলাসা করে বুঝিয়ে দেয়া।
কী বোঝাবে? আগেই যে প্রাকৃতিক এবং স্বাভাবিক অনুভূতির কথা বলেছি তার কথা তো আছেই। সেইসাথে, প্রত্যেক বয়সের নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম থাকে সেটাও বুঝতে হবে। একটা শিশু জন্ম নিয়েই ভাত মুখে দেয় না বা দিতে পারে না। প্রথমে তাকে তরল খাবারে অভ্যস্ত হার পর শক্ত খাবারের দিকে যেতে হয়। যৌনতার ক্ষেত্রেও একজন যখন তখন, যেকোনো বয়সে, যার তার সাথে শুতে যেতে পারে না। যৌনতার প্রথম ও প্রধান শর্তই সততা (সততা শব্দে অনেকে হাসবেন। কারণ গোটা সমাজে সাধারণ জায়গায় যেখানে সততার চিহ্ন নেই, যৌনতায় থাকার প্রশ্নই আসে না। কিন্তু নেই বলে চুপ থেকে অসততাকে তো প্রশ্রয় দেয়া যায় না)। যতক্ষণ পর্যন্ত একটা ছেলে বা মেয়ে তার প্রেমিকা বা প্রেমিককে অথবা বউ বা স্বামীকে অন্তর দিয়ে পছন্দ বা ভালো না বাসছে, ঠিকঠাক মতো দুজন মানুষ দুজনকে পড়তে, বুঝতে না পারছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারে না। উচিৎ না। ধর্মীয় বিধানের কথা এখানে বাদ রাখলাম। কারণ ধর্মীয় বিধান আরো পবিত্র, আরও সুন্দর, সবসময় হয়তো মানা সম্ভব হতে নাও পারে। যৌনতার সবটাই মানসিক, শরীর একটা বাহুল্য মাত্র। এই বিষয়টা বুঝতে পারা সব থেকে জরুরি।
আমি তাই আনুশকা বা দিহানকে দোষ দেয়ার আগে তাদের বাবা-মা, আত্মীয়স্বজন তথা গোটা সমাজ অর্থাৎ আমাদের নিজেদেরকে দায়ী করতে চাই সবার আগে। এই রকম দিহানকে আমরা নিজেদের হাতে বিগত বছরগুলোতে তিল তিল করে প্রগতিশীল বা রক্ষণশীলদের মাধ্যমে গড়ে তুলেছি। আর দিহানের বিষয়টা যদি ধর্ষণ হয় তাহলে বলতে হবে অস্বাভাবিক কাজ, কারণ ধর্ষকদের কখনোই স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গণ্য করা যায় না। আর যদি হত্যা হয়ে থাকে, তাহলে তো সে হত্যাকারী, বিচারের বিষয়। সেটা একেবারেই ভিন্ন বিষয়। যে বিষয়টার দিকে এখানে গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা হলো, দিহান যে জায়গা থেকে আনুশকার সাথে মিলিত হবার 'বাসনা' করেছিল সেই বাসনার জায়গাটা। একটা অসুস্থ বাসনার সমাজ অসুস্থ নাগরিক গড়ে তুলবে, সেটাই স্বাভাবিক। আমরা আমাদের অসুস্থ যৌন তাড়না, অতি রক্ষণশীলতা বা অতি প্রগতিশীলতার লাগাম ঠিকমতো ধরতে না পারলে এই রকম ঘটনা ঘটে চলবে। মনে রাখবেন, অসুস্থ যৌনতা অসুস্থ সমাজ নির্মাণ করে।