পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তারকা এখন সিদ্দিকি!
আব্বাস সিদ্দিকি ও মমতা ব্যানার্জি - ছবি সংগৃহীত
প্রশ্ন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম নির্বাচন নিয়ে। আর এই ভোটের উপরই নির্ভর করছে, আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে বাম ও কংগ্রেস কয়টা আসনে জিততে পারবে। ওই কারণেই কংগ্রেস ও বামের কাছে খুবই গুরুত্ব পাচ্ছেন ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি ও তার জোট। আগামী ২১ জানুয়ারি সিদ্দিকি তার দলগঠনের কথা ঘোষণা করবেন। সেইসঙ্গে আরো দশ দলের জোটের ঘোষণাও করার কথা তার। এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসি ইতিমধ্যে সিদ্দিকির সঙ্গে দেখা করে তার নেতৃত্বে ভোটে লড়ার কথা বলেছেন।
সম্প্রতি আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে পরপর দু'দিন দেখা করেছেন দুই কংগ্রেস নেতা, আব্দুল মান্নান এবং প্রয়াত নেতা গনি খান চৌধুরির ভাই আবু হাসেম খান চৌধুরি, যিনি পশ্চিমবঙ্গে ডালুদা নামেই বেশি পরিচিত। এর আগে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও একবার পিরজাদার সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। কিন্তু সেদিন আব্বাস সিদ্দিকি ছিলেন না বলে দেখা হয়নি। বাম নেতারাও তার সঙ্গে দেখা করছেন। অতীতে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে বামাদেরও ভালো সম্পর্ক ছিল এবং এখনো আছে।
কংগ্রেস নেতাদের আশঙ্কা, এমআইএম এবং পিরজাদার দল মুসলিম ভোটে ভালোই ভাগ বসাতে পারে। তারা জিততে না পারলেও কংগ্রেস, বাম, তৃণমূলের মুসলিম ভোটে ভাগ বসিয়ে হারিয়ে দিতে পারবে। এআইএমআইএম মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুরের মতো জেলাগুলোতে প্রচুর প্রার্থী দাঁড় করাতে পারে। আর এই জেলাগুলিতেই এখনো কংগ্রেস ও বামেদের শক্তি টিকে আছে। এই তিন জেলা, বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ ও মালদহে কংগ্রেস বেশ কয়েকটি আসন জেতার ব্যাপারে আশাবাদী। কিন্তু তাঁদের বাড়া ভাতে ছাই ফেলে দিতে পারেন ওয়েইসি ও আব্বাস সিদ্দিকি। তাই কংগ্রেস এখন থেকেই পিরজাদার দলের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে উদ্যোগী, যাতে তাদের মুসলিম ভোট অটুট থাকে।
কংগ্রেসের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে সম্পর্ক সব চেয়ে ভালো রাজ্যের বিরোধী নেতা আব্দুল মান্নানের। তাঁর সঙ্গেই আব্বাস সিদ্দিকির দীর্ঘ কথা হয়েছে। ডিডাব্লিউকে আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, ''আমাদের লড়াই বঞ্চনার বিরুদ্ধে। মুসলিম ও হিন্দু দুই সম্প্রদায়ই রাজ্যে তৃণমূল ও কেন্দ্রে বিজেপি-র শাসনে বঞ্চিত হচ্ছে। জিনিসের দাম আকাশছোঁয়া। বেকারত্ব দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রবল। আমি আব্বাস সিদ্দিকিকে বলেছি, একটা ধর্মনিরপেক্ষ দল ও জোট করতে। তিনিও আমার সঙ্গে একমত।''
কেন তিনি সিদ্দিকিকে এই পরামর্শ দিয়েছেন, তার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী নেতা। তার সোজাসাপটা বক্তব্য, ''হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে লড়াই করে লাভ নেই। সমস্যার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। বিজেপির ফাঁদে পা দিলে মোদিরই লাভ। বিজেপি চাইছে, হিন্দু-মুসলিম বিরোধ লাগিয়ে জিততে। মমতাও সেই ফাঁদে পা দিয়েছেন। দুই জনের গট আপ গেম চলছে। আব্বাস সিদ্দিকিও বলেছেন, তিনি শুধু মুসলিম নয়, দলিত, শোষিত, বঞ্চিত সকলকে নিয়েই দল করবেন এবং সেই মতো চলবেন।''
পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের উপর দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন প্রবীণ সাংবাদিক মিলন দত্ত। ভোটের সংখ্যাতত্ত্ব বিশ্লেষণ করে তিনি এ নিয়ে কয়েকটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেছেন, ''১৯৬৯ সালের পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে কোনো মুসলিম নামের দলের প্রার্থী জেতেননি। ৬৯ সালে প্রোগ্রেসিভ মুসলিম লিগ তিনটি আসনে জিতেছিল। দ্বিতীয় তথ্যটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমবঙ্গই হলো ভারতের একমাত্র রাজ্য, যেখানে মুসলিম প্রধান কেন্দ্র থেকে হিন্দু প্রার্থী জেতে। হয়তো সেখানে ৭০ বা ৮০ শতাংশ ভোটদাতা মুসলিম, কিন্তু হিন্দু প্রার্থী জিতে যান। পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম ভোটদাতারা সত্যিই রাজনৈতিকভাবে ষোলো আনা ধর্মনিরপেক্ষ।''
মিলনের মতে, ''ওয়েইসি খুব বিচক্ষণ রাজনীতিক। তিনি এক বছর ধরে অনেক চেষ্টা-চরিত্র, চর্চা, সংগঠন সব করে বুঝতে পারলেন, পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে মুসলিম নামের দলের পক্ষে জেতা মুশকিল, প্রায় অসম্ভব। তাই তিনি আব্বাস সিদ্দিকির নেতৃত্ব মেনে নিয়েছেন। আমি বলতে চাই, মুসলিম দলের ভবিষ্যৎ আছে কি না, সেটা আগে ভাবতে হবে। তারপর দেখতে হবে, সিদ্দিকি কিছু করতে পারবেন কি না।'' একথা ঠিক, ফুরফুরা শরিফের পিরজাদার প্রচুর সমর্থক সারা পশ্চিমবঙ্গে ছড়িয়ে আছেন। কিন্তু ভোটের সময় তাঁদের আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক আনুগত্য এক নাও হতে পারে বলে মনে করছেন মিলন।
আব্দুল মান্নান জানিয়েছেন, ''সিদ্দিকি আমাকে বলেছেন দলের কোনো মুসলিম-ঘেঁষা নাম তিনি রাখবেন না। ধর্মান্ধতা থাকবে না। সব বঞ্চিত ও প্রতারিত মানুষকে নিয়ে লড়াই করবেন তিনি। তাহলে বিজেপি ও তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাকে লড়তে হবে। আগে তিনি দলটা করুন, জোট গঠন করুন, তারপর আমরা দেখব। ওর সঙ্গে আমি কথা বলছি।'' বোঝা যাচ্ছে, কংগ্রেসও সিদ্দিকিকে সঙ্গে নিয়েই চলতে চায়। ভোট ভাগ হয়ে মুর্শিদাবাদ, মালদহ সহ অন্যত্র দলের প্রার্থীরা হেরে যান, সেটা কংগ্রেস চাইছে না। তবে শেষ পর্যন্ত সিদ্দিকির দলের সঙ্গে কংগ্রেসের সমঝোতা হবে কি না, সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।
সূত্র : ডয়চে ভেলে