নতুন সমীকরণে সৌদি-তুর্কি সম্পর্ক?
এরদোগান ও মোহাম্মদ - ছবি সংগৃহীত
কাতারের ওপর আরোপিত, সৌদি নেতৃত্বাধীন উপসাগরীয় জোটের দেশগুলোর অবরোধ প্রত্যাহারের বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন সহযোগিতা বলয় তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এই বলয়ের কেন্দ্রে থাকবে মধ্যপ্রাচ্যের উদীয়মান শক্তি তুরস্ক এবং পবিত্র দুই হারাম শরিফের রক্ষণাবেক্ষণকারী সৌদি আরব। ২০২১ সালের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে এটি সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি সম্ভাবনার সৃষ্টি করেছে।
এই সহযোগিতা বলয়ে মধ্যপ্রাচ্যের কাতার, কুয়েত, লিবিয়া, তিউনিশিয়া থাকতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, আজারবাইজানের মতো প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোও এর অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। এটি কার্যকর হলে ইয়েমেন, সিরিয়া ও ইরাকে যুদ্ধ ও অস্থির পরিস্থিতির অবসান ঘটতে পারে। আর মধ্যপ্রাচ্যে এই নতুন বলয় সৃষ্টি হলে এর পাশাপাশি ইসরাইল-আমিরাত নেতৃত্বাধীন পৃথক একটি বলয় অবস্থান করবে, যার সাথে প্রধানত ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানকারী দেশগুলো থাকতে পারে।
‘সৌদি-তুরস্ক-পাকিস্তান-ইন্দোনেশিয়া’ জোট হলে ওআইসিভুক্ত বেশির ভাগ মুসলিম দেশ এই বলয়ে অবস্থান নিতে পারে। আর একই সাথে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা বা ওআইসি মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্থনীতি বাজার বিনিয়োগ ও প্রতিরক্ষা খাতে বিশেষ সহযোগিতার প্রক্রিয়া তৈরি করবে। এই জোটটি ইরানকেন্দ্রিক শক্তি বলয়ের সাথে সঙ্ঘাতের বিষয়গুলোকে যথাসম্ভব কমিয়ে আনার চেষ্টা করবে। ইসরাইলকেন্দ্রিক আমিরাতের নেতৃত্বাধীন বলয়ের সাথেও সঙ্ঘাত পরিহার করার চেষ্টা করবে।
মধ্যপ্রাচ্যে এবং একই সাথে ওআইসিভুক্ত মুসলিম দেশগুলোর নীতিনির্ধারণে সৌদি আরব দীর্ঘকাল ধরে নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানা ক্ষেত্রে এই ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। বিষয়টির পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, সংযুক্ত আরব-আমিরাতের উচ্চাভিলাষী ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদ সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের ওপর প্রভাব বিস্তার করে সৌদি আরবকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রান্তিক অবস্থানে নিয়ে গেছেন। এতে ইয়েমেন সিরিয়া লেবাননসহ সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি নীতিগুলো একের পর এক ব্যর্থতার পর্যবসিত হতে শুরু করে। আর মুসলিম বিশ্বের নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র থেকে রিয়াদের স্থান দখলে এগিয়ে যেতে থাকে আবুধাবি।
বিষয়টি এতটাই এগোয় যে, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে আরব আমিরাত বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজকে অগোচরে রাখে। আর আমিরাতকে অনুকরণ করে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট কোনো অঙ্গীকার ছাড়াই ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার জামাতা জ্যারেড কুশনারকে দিয়ে চাপ প্রয়োগ করা হতে থাকে। রিয়াদকে বলা হয়, ‘ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দেশটির নেতৃত্বে বহাল থাকছেন আর ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসছেন’।
সৌদি বাদশাহ সালমান ও তার উপদেষ্টারা এই চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফল কী হয়, সেটি দেখার জন্য পরামর্শ দেন। আমেরিকার নির্বাচনের ফলাফলে ইসরাইল-আমিরাতের বক্তব্য অসত্য প্রমাণিত হয়। ট্রাম্প শুধু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেই হেরে যাননি, একই সাথে কংগ্রেসের দুই কক্ষ সিনেট ও প্রতিনিধি সভার নিয়ন্ত্রণও হারিয়েছেন। এর পর উগ্র অনুসারীদের উসকে দিয়ে কংগ্রেসে রক্তক্ষয়ী হামলা চালানোর জন্য দুই সপ্তাহের কম সময় বাকি থাকতেই এখন অভিশংসনের মুখে পড়ছেন ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এই দুর্গতি মধ্যপ্রাচ্যে তার কার্যক্রমের ওপর কমবেশি প্রভাব ফেলতে শুরু করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় প্রভাব কমে গিয়ে বাদশাহ সালমানের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ হতে দেখা যাচ্ছে। একই সাথে কাতারের ওপর অবরোধ প্রত্যাহার, তুরস্কের সাথে সমঝোতা, ইসরাইলের নির্দেশিত আমিরাতি পথে গমন- সব ইস্যুতে সৌদি নীতিতে পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে।
মূল্যায়নে দেখা গেছে, ইয়েমেনে যুদ্ধ শুরু করার পর আমিরাত তার ‘নিজস্ব গেম’ খেলতে শুরু করে। সৌদি অবস্থানকে সঙ্ঘাতমুখর অঞ্চলে ঠেলে দিয়ে ইয়েমেনে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এডেন বন্দর ও এর চার পাশের অঞ্চলগুলোতে আমিরাত তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। সৌদি আরব সিরিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর একসময় অনেকটা একক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল। আমিরাতি পরামর্শে রিয়াদ সিরিয়া থেকে হাত গুটিয়ে নেয়ার পর এখন দেখা যাচ্ছে, সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কোনো টুলস আর সৌদি আরবের হাতে নেই।
সিরিয়ার বিদ্রোহীরা যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে ছিল সেই সময়ে আমিরাতের ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন জায়েদ ইসরাইলের নেতানিয়াহু ও মিসরের সিসির সাথে পরিকল্পনা করে রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ পথ তৈরি করেন। আর মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রভাব কমানোর নামে নির্বিচারে বোমা ফেলে ফ্রি সিরিয়ান আর্মির লাখ লাখ যোদ্ধা ও বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছেন। এর ফলে সিরিয়া পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বিদ্রোহী ফ্রি সিরিয়ান আর্মি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তুরস্ক পিকেকে সমর্থক ওয়াইপিজের হাতে সীমান্তবর্তী ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ঠেকাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে সমান্তরাল চুক্তি করে তুরস্ক সিরীয় উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য সিরিয়ার ভেতরে নিরাপদ অঞ্চল গঠন করে। অন্য দিকে, আমিরাত ইসরাইলের গোপন সহায়তায় তুর্কি বিদ্রোহীদের অস্ত্র ও অন্যান্য সহযোগিতা দিয়ে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা চালায় ।
দেখা যায়, সৌদি আরব সিরীয় পরিস্থিতিতে একেবারে নিয়ন্ত্রণ হারানোর অবস্থায় পড়ছে আর কুর্দি বিদ্রোহীদের ওপর ভর করে আমিরাত তার প্রভাব সৃষ্টির কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়েমেন ও সিরিয়ার মতো পুরো মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ন্ত্রকের আসনে বসতে সৌদি শীর্ষ নেতৃত্বকে অন্ধকারে রেখে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় আমিরাত। নানা ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তির নামে ইসরাইলের সাথে যৌথ সামরিক শক্তি গঠনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আবুধাবি। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুকে ব্যবহার করে ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয় আমিরাত। এখন মিসর বাহরাইন সুদান মরক্কোর পাশাপাশি ওমানকেও একই দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। আমিরাতের নিয়ন্ত্রণ মেনে এই বলয়ে একাত্ম হওয়ার মধ্যে সৌদি আরব তার ক্ষমতা ও স্বার্থ কোনোটারই নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছে না।
এমনিতেই যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্র্যাট প্রশাসন সৌদি রাজতন্ত্রের প্রতি খুব একটা সুপ্রসন্ন থাকে না। এ অবস্থায় ট্রাম্প এবং তার ইহুদি জামাতা কুশনারের সাথে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে জো বাইডেনের প্রশাসন রিয়াদের প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ অবস্থায় আগামী মার্চে ইসরাইলে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, তাতে নেতানিয়াহুর আবার প্রধানমন্ত্রী পদে বসার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। আর বৈরী জনমত ও ধর্মীয় নেতৃত্বকে উপেক্ষা করে মুহাম্মদ বিন জায়েদের সাথে পথ মেলানো এ পরিস্থিতিতে বিপর্যয়কর বলে ভাবছেন সৌদি নীতিনির্ধারকদের বড় অংশ।
যে বিকল্প ভাবনা এখন জোরদার হচ্ছে সেটি হলো, সৌদি রাজতন্ত্রকে বহাল রাখার শর্তে তুর্কি-কাতার-ব্রাদারহুড শক্তির সাথে সমঝোতায় পৌঁছানো। এ ধরনের সমঝোতা হলে ইয়েমেন যুদ্ধের অবসানে তুর্কি-কাতার সৌদি আরবকে সহযোগিতা করবে। পাকিস্তানও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করবে। ধারণা পাওয়া যাচ্ছে, ইরানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে ইয়েমেনে লেবানন মডেলের একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া তৈরি করা হবে যেখানে সুন্নি, হুথি ও অন্যান্য শক্তির প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হবে। আর একই সাথে ইয়েমেনের অখণ্ডতা বজায় থাকবে। এ ধরনের একটি পরিকল্পনার ব্যাপারে সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরান একমত হলে আমিরাতের বিরোধিতায় কোনো কাজ হবে না। আর এডেন বন্দর নিয়ন্ত্রণ করে আমিরাতি বন্দরগুলোর গুরুত্ব ধরে রাখার আমিরাতের স্বপ্নও পূরণ হবে না। এ ব্যাপারে ভেতরে ভেতরে আলোচনা অনেক দূর অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।
একই ধরনের একটি টেকসই রাজনৈতিক সমঝোতার বিষয় ভাবা হচ্ছে সিরিয়া নিয়েও। সিরিয়ার পরিস্থিতি কিছুটা জটিল হলেও সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রাশিয়া, তুরস্ক, ইরানের অংশগ্রহণে ‘আস্তানা প্রক্রিয়া’ চলমান রয়েছে। সিরিয়ার নেতা বাশার আসাদের সাথে প্রেসিডেন্ট পুতিনের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মতপার্থক্যও দেখা দিতে শুরু করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, সিরিয়ার রাজনৈতিক সমাধানের সাথে সৌদি আরব যুক্ত হলে সঙ্কটের নিরসন দ্রুততা পাবে।
সিরিয়ার পাশাপাশি লেবাননে সৌদি নীতির অকার্যকারিতার কারণে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। লেবাননের হিজবুল্লাহর ওপর এখনো ইরানের একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এর বিপরীতে, সুন্নি রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল রিয়াদের। মুহাম্মদ বিন জায়েদের পরামর্শে বিন সালমান লেবাননি প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে আটকে রাখলে লেবাননি সুন্নিরা সৌদি আরবের ব্যাপারে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়। তখন থেকে এ শূন্যতা পূরণ করা হচ্ছে তুর্কি প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে। আমিরাত লেবাননে নিজস্ব প্রভাব সৃষ্টিতে ব্যর্থ হয়ে সেখানে ফ্রান্সকে হস্তক্ষেপ করার জন্য ডেকে এনেছে। কিন্তু সৌদি-তুরস্ক অভিন্ন ভূমিকা পালন করলে লেবাননে ফ্রান্স-আমিরাত সিদ্ধান্তকারী কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
সুদানের সামরিক জান্তা আমিরাতের ইন্ধনে আর ট্রাম্প-কুশনারের চাপে সন্ত্রাসী তালিকামুক্তির আশ্বাসে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলেও দেশটির জনগণ এর তীব্র বিরোধী। মধ্যপ্রাচ্যে তুর্কি-সৌদি বলয় তৈরি হলে দেশটির ইসরাইল-আমিরাতপন্থীদের জন্য ক্ষমতা ধরে রাখা কঠিন হবে। এমনকি আমিরাতের পক্ষে এককভাবে ইসরাইলের সহায়তায় মিসরে আবদুল ফাত্তাহ সিসি সরকারকে টিকিয়ে রাখাও কঠিন হতে পারে।
এ কথা সত্যি যে, মধ্যপ্রাচ্যের যেকোনো পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের একটা প্রধান ভূমিকা থাকবে। জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতি কিছুটা হলেও পাল্টাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ডিপ স্টেট’ এমনকি, বাইডেন নিজেও ইসরাইল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু আমেরিকান নীতি ও স্বার্থের নিজস্বতাকে যেভাবে ট্রাম্প-কুশনার ইসরাইলের স্বার্থে বিসর্জন দিয়েছেন সেটি বাইডেন অব্যাহত রাখবেন বলে মনে হয় না। ফিলিস্তিনের দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান আবার সক্রিয়তা লাভ করতে পারে বাইডেন প্রশাসনের সময়।
বাইডেন ইরানের সাথে ছয় জাতির পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে আসার অঙ্গীকার পূরণ করার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হয়। তা হলে ইরান এখন অবরোধের কারণে যে চাপের মধ্যে রয়েছে সেটি থাকবে না। তবে বাইডেন প্রশাসনের সৌদি-তুরস্ক বিরোধী একটি মনোভাব থাকবে বলে অনেকে উল্লেখ করলেও ইরানকে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে একক শক্তিতে পরিণত হতে যুক্তরাষ্ট্র দেবে বলে মনে হয় না। এতে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন মেরুকরণে মোটা দাগে তিনটি বলয় বা পক্ষ থাকতে পারে। একপক্ষে সৌদি আরব, তুরস্ক ও মিত্র রাষ্ট্রগুলো। দ্বিতীয়পক্ষে ইসরাইল, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিত্র দেশগুলো। তৃতীয় পক্ষে ইরান ও তার মিত্র দেশগুলো।
জো বাইডেনের আমলে আমেরিকার নীতিনির্ধারকরা এই তিন পক্ষের কোনোটিকে এককভাবে মধ্যপ্রাচ্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সহযোগিতা করবেন বলে মনে হয় না। তবে তিনটি পক্ষই মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় হলেও আরব জনগণ এবং শক্তির ভরকেন্দ্রগুলোর সমর্থনে সৌদি-তুরস্ক বলয় মূল শক্তিতে পরিণত হতে পারে। মুসলিম উম্মাহ অ্যাজেন্ডার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফিলিস্তিন ইস্যু। আমিরাত বলয় এই ইস্যুকে আর সামনে আনতে চায় না, তাদের প্রধান ইস্যু হলো ‘রাজনৈতিক ইসলাম’কে নির্মূল করা। অন্য দিকে সৌদি আরব তুরস্কসহ বেশির ভাগ মুসলিম দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয় নিশ্চিত করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানের পক্ষে। ইরানসহ কিছু দেশ রয়েছে দৃশ্যত যারা ইসরাইলের অস্তিত্ব মেনে নিতে চাইছে না।
বর্তমান বাস্তবতায় মধ্যপন্থী নীতিটি আন্তর্জাতিক সমর্থন বেশি লাভ করতে পারে। ওআইসি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে এ নীতিকেই সমর্থন করছে। ফলে ২০২১ সালেই আবার ইসরাইল-ফিলিস্তিন শান্তি আলোচনা নতুন অবয়বে শুরু হতে পারে। এর মাধ্যমে কার্যকর ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত হলে সেটি হতে পারে মুসলিম উম্মাহর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এতে ফিলিস্তিন ইস্যুর পাশাপাশি কাশ্মির ও রোহিঙ্গা ইস্যুটিও সামনে চলে আসবে। ওআইসিকে কার্যকর সংস্থা করা গেলে এবং মধ্যপন্থী একটি কর্মপন্থা এসব সমস্যাকে জটিল করে তোলার পরিবর্তে সমাধানমুখী করতে সক্ষম হবে।
তবে এ কথা ঠিক যে, প্রতিটি রাষ্ট্রেরই নিজস্ব কিছু নিরাপত্তা ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের ইস্যু থাকে। ফলে চাইলেই যেকোনো মেরুকরণ সম্পন্ন হওয়া সরল রৈখিক কিছু হয় না। ২০২১ সাল এমনিতেই এক জটিল বিশ্বপরিস্থিতি হাজির করেছে। এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী চীন আর রাশিয়ার পারস্পরিক সমঝোতা ও বোঝাপড়ায় নতুন এক পরিস্থিতি আসবে বলে মনে হচ্ছে। কোভিড-১৯ এর প্রলয়ঙ্করী প্রভাব এবং এর ভবিষ্যৎ নীতিধারা নিয়ে এখনো নিশ্চিত কিছু বলা যাচ্ছে না। এর পরও মুসলিম উম্মাহর সামনে আশাবাদী দৃশ্যপটই রয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তুর্কি-সৌদি সমঝোতার সম্ভাবনা তার মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে হয়।
mrkmmb@gmail.com