তুর্কি রাজনীতিতে তুরগুত ওজাল
তুর্কি রাজনীতিতে তুরগুত ওজাল - ছবি সংগৃহীত
তুরস্কে ১৯৭৩ সালের ১৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। ফলে একধরনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। দেখা গেল, ডান, বাম, সমাজতান্ত্রিক ও ইসলামি ভাবধারার প্রভৃতি দল মিলে একাধিকবার সরকার গঠন করে এবং কয়েকদিনের মধ্যেই তা ভেঙে যায়। কোনো সরকারই বেশি দিন দেশ পরিচালনা করতে পারছিল না।
একবার মুস্তফা কামাল পাশাপন্থী রিপাবলিকান পিপল’স পার্টির (কুমহুরিয়েত হাল্ক পার্টিসি বা সিএইচপি) ও ইসলামী দল ন্যাশনাল স্যালভেশন পার্টি (মিল্লি সালামত পার্টি বা এমএসপি) কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। সিএইচপির প্রধান বুলেন্ট এজেবিত প্রধানমন্ত্রী এবং এমএসপি প্রধান ড. নাজমুদ্দিন আরবাকান উপপ্রধানমন্ত্রী হন। মাত্র ৮ মাসের মাথায় কট্টর ডান ও বামপন্থিদের এ কোয়ালিশন সরকারের পতন হয়। বিশ্লেষকরা একে মেলন কোয়ালিশন (তরমুজ যুক্তফ্রন্ট) হিসেবে আখ্যায়িত করেন। কেননা সমাজতান্ত্রিক দল জেহেপের দলীয় পতাকার রং লাল এবং ইসলামপন্থিদের দলীয় পতাকার রং সবুজ।
এই অচলাবস্থার সুযোগে দেশে বামপন্থীদের কারণে নানা অরাজকতা দেখা দেয়। পাঁচ মাস দেশ পরিচালনা করে একটি অস্থায়ী সরকার। এরপর সুলেমান দেমিরেলের ডেমোক্রেটিক পার্টি, মিল্লি সালামত পার্টি এবং জেহেপের নেতারা জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট (মিল্লিয়াতচি জেহেপে) গঠনে সম্মত হন। এ যুক্তফ্রন্ট সরকার ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত টিকে থাকে। ওই নির্বাচনে জেহেপে ৪১ দশমিক ৪, আদালত পার্টি ৩৬ এবং মিল্লি সালামত পার্টি পায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ ভোট। স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে সরকার গঠন করে জেহেপে।
অন্যদিকে মেহেপে আর মিল্লি সালামত পার্টিকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট করল আদালত পার্টি। বুলেন্ট এজবিতের নেতৃত্বে গঠিত সরকার এক মাসের মতো ক্ষমতায় থাকার পর সরকার গঠন করেন সুলেমান দেমিরেল। পাঁচ মাসের মধ্যে এ সরকারেরও পতন ঘটে। আবারও সরকার গঠন করেন বুলেন্ট এজবিত। ১১ মাসের মধ্যে পদত্যাগ করতে হয় তাকেও।
স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠদের সরকার গঠন করেন সুলেমান দেমিরেল।
এভাবে বারবার সরকার পরিবর্তনে দেশের পরিস্থিতি অবনতি হতে থাকে। অস্থিতিশীলতা ও রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধের সুযোগ কাজে লাগায় সেনাবাহিনী। ১৯৮০ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জারি করা হয় সামরিক শাসন। এ নিয়ে ওই দেশে তৃতীয়বার সামরিক শাসন। ১৪ সেপ্টেম্বর চিফ অব জেনারেল স্টাফ জেনারেল কেনান এভরানকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদকে সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়।
সামরিক সরকার প্রশাসন, শিক্ষা, শিল্প ব্যবসাসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় আধিপত্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃত্ব নিজেদের কব্জায় নেয়। গণমাধ্যম বন্ধ করে। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিষিদ্ধ করা হয়। এই প্রথমবারের মতো সামরিক শাসকরা বামপন্থিদের প্রতি কঠোর হয় এবং তাদের অনেক নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করে। অসংখ্য নেতাকর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ড দেয়া হয়। অসংখ্য লোকের ফাঁসির হুকুম হয়ে সর্বশেষ ২০ জনে নেমে আসে।
এই সামরিক অভ্যুত্থান তুরস্কের রাজনীতির ওপর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ঐতিহ্যগতভাবে বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাঘেঁষা সেনাবাহিনী এবার তাদের প্রতিও কিছুটা অনমনীয় ছিল। তাই বলে ডানপন্থি দলগুলো এবং এসব দলের নেতারা রেহাই পেয়েছেন, তা নয়। বরং ডানপন্থিদের প্রতি সেনাবাহিনী খড়্্গহস্ত ছিল বেশি।
সেনাবাহিনী সমর্থিত সরকারের অধীনে নতুন সংবিধান গৃহীত হয় এবং জেনারেল কেনান এভরান প্রেসিডেন্ট হন। ১৯৮৩ সালে শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক দল গঠনের অনুমোদন দেয়া হয়। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পূর্বানুমোদন অত্যাবশ্যক করা হয়। নতুন-পুরোনো অনেকগুলো দল রাজনৈতিক কার্যক্রমের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করে। অনুমোদন পায় তিনটি দল। তš§ধ্যে তুরগুত ওজালের নেতৃত্বে আনাভাতান পার্টি (মাদারল্যান্ড পার্টি) অনুমোদন পায়। ১৯৮৩ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তুরগুত ওজালের আনাভাতান পার্টি ৪৫ শতাংশ ভোট পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। মুস্তফা কামালপন্থি দল হালকচি পার্টি (এইচপি) ৩০ শতাংশ এবং সেনাসমর্থিত মিল্লিয়েতচি ডেমোক্রেটিক পার্টি (এমডিপি) পায় ২৩ শতাংশ ভোট।
সংখ্যাগরিষ্ঠ আনাভাতান পার্টির নেতা তুরগুত ওজাল প্রধানমন্ত্রী হন। তিনি অর্থনীতিবিদ ছিলেন, তাই সরকার গঠন করার পরই অর্থনীতিতে বিভিন্ন সংস্কার আনার চেষ্টা শুরু করলেন। এ কারণে অনেকেই তুরগুত ওজালকে ‘তুরস্কে অর্থনৈতিক সংস্কারের পথিকৃৎ’ আখ্যা দিয়েছেন।
মূলত অর্থনৈতিক সমস্যাজর্জরিত তুরস্কের অর্থনৈতিক উন্নতি শুরু হয়েছিল তুরগুত ওজালের সময়েই। এছাড়া তিনি ইসলামের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করতেন না। তিনি ধর্মনিরপেক্ষ (সেক্যুলার) ছিলেন না, বরং ইসলামপন্থিই ছিলেন বলা যায়। তিনি ছাত্রজীবনে ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানের মিল্লি গুরুস ও মিল্লি সালামত পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে মনোনয়ন না পেয়ে আনাভাতান পার্টি গঠন করেন।
তুরগুত ওজাল প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে রাজনীতিবিদদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে তিনি গণভোটের (রেফারেন্ডাম) আয়োজন করেন। এ ভোটে মাধ্যমে সামান্য ব্যবধানে (৫০.২% ও ৪৯.৮%) জিতে সামরিক শাসনামলে নিষিদ্ধ সব রাজনৈতিক নেতা ও রাজনীতির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে দেন এবং সুলেমান দেমিরেল, বুলেন্ট এজেবিত ও ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানসহ সব নেতাকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিলেন। ১৯৮৭ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনেও তুরগুত ওজালের আনাভাতান পার্টি একক সংখ্যগরিষ্ঠতা অর্জন করে সরকার গঠন করে। শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় দেশটির পার্লামেন্ট গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সদস্যদের ভোটে তিনি ১৯৮৯ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ওজাল।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে সুলেমান দেমিরেলের দরয়ু ইয়ুল পার্টি ১৭৮টি আসন (২৭ শতাংশ ভোট), আনাভাতান পার্টি ১১৫টি (২৮ শতাংশ), সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পপুলিস্ট পার্টি (সেহেপে) ৮৮টি (২০ দশমিক ৮ শতাংশ), রেফা পার্টি ৬২টি (১৬ দশমিক ৯ শতাংশ) এবং ডেসেপে ৭টি আসন (১০ দশমিক ৭ শতাংশ) পায়। দরয়ু ইয়ুল পার্টি সর্বাধিক ১৭৮টি আসন পেলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সেহেপের সঙ্গে জোট করে যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন করে দলটি। প্রধানমন্ত্রী হন সুলেমান দেমিরেল। ১৯৯৩ সালে তুরগুত ওজাল মৃত্যুবরণ করার পর সুলেমান দেমিরেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তুরগুত ওজালকে রাশিয়ার গুপ্তচররা বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে বলে সন্দেহ করা হয়। সুলেমান দেমিরেল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তার দলের প্রার্থী তানসু সিলার প্রধানমন্ত্রী হন।
১৯৯৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রেফা পার্টি ১৫৮টি (২১ দশমিক ৪ শতাংশ), দরয়ু ইয়ল পার্টি ১৩৫টি (১৯ দশমিক ২ শতাংশ), আনাভাতান পার্টি ১৩২টি (১৯ দশমিক ৭ শতাংশ), দেসেপে ৭৮টি (১৪ দশমিক ৬ শতাংশ) এবং জেহেপে ১০ দশমিক ৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ৪৯টি আসনে জয়লাভ করে। রেফা পার্টি বেশি ভোট ও আসন পেলেও সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় আসন পায়নি। তার ওপর ইসলামি আদর্শভিত্তিক হওয়ায় রেফা পার্টিকে ক্ষমতায় আনতে রাজনৈতিক দলগুলো আগ্রহী ছিল না। এ অবস্থায় দরয়ু ইয়ল ও আনাভাতান পার্টি মিলে সরকার গঠন করে। আনাভাতান পার্টির নেতা মাসুদ এলমাজের নেতৃত্বে গঠিত এ সরকার প্রায় তিন মাস ক্ষমতায় ছিল।
অচলাবস্থা নিরসনে এগিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট সুলেমান দেমিরেল। দুটি শর্ত দেন তিনি, হয় ভালো যুক্তফ্রন্ট করে সরকার গঠন করতে হবে নতুবা বড় দল হিসেবে রেফা পার্টির নেতা ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানকে সরকার গঠন করতে দিতে হবে।
এবার ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানকে সরকার গঠনে সমর্থন দিল দরয়ু ইয়ল। ড. আরবাকান প্রধানমন্ত্রী এবং তানসু সিলারকে উপপ্রধানমন্ত্রী করে ১৯৯৬ সালের ২৮ জুন সরকার গঠিত হলো। ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্কে প্রথমবারের মতো অধিষ্ঠিত হলেন ইসলামি আদর্শের প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিতে পারেননি তিনি। তুরস্কের দায়িত্ব পেয়ে নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে প্রমাণ করতে চাইলেন। কেবল তুরস্ক নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না। জাতিসংঘের আদলে মুসলিম জাতিসংঘ, ন্যাটোর অনুকরণে মতো মুসলিম দেশগুলোর সামরিক জোট, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের মতো মুসলিম দেশগুলোর কমন মার্কেট, ইউরোর মতো মুসলিম দেশগুলোর একক মুদ্রা, উন্নত সাত দেশের জোট জি-সেভেনের মতো প্রভাবশালী আট মুসলিম দেশ (মালয়েশিয়া, মিসর, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশ) নিয়ে গাবুগান নেজারা উমাত ইসলাম বা ডেভেলাপিং এইট (ডি-এইট) প্রভৃতি গঠনের পরিকল্পনা করলেন।
তার পরিকল্পনাকে সামরিক বাহিনী, বিরোধী দলগুলো ভালোভাবে নেয়নি। জনগণের বিশাল অংশও এটি মেনে নিতে পারেনি। দল নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি, একথা যেন ড. আরবাকান ভুলে গিয়েছেন। তার দল ১৫৮টি আসন পেয়েছে, যা শতাংশের হিসাবে ২১ দশমিক চার। (পাঠক লক্ষ্য করেছেন, তার এসব সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পরবর্তী নির্বাচনে)।
এ ধরনের আরও কিছু কারণে আরবাকানের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর দূরত্ব বাড়ে। একপর্যায়ে রেফা পার্টির সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রম নজরদারি শুরু করে সেনাবাহিনী। ফলে টিকল না এ সরকারও। ১৮ জুন ১৯৯৭ প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দেন আরবাকান। উপপ্রধানমন্ত্রী তানসু সিলারকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন।
তবে তানসু সিলারকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিতে অসম্মত হন প্রেসিডেন্ট সুলেমান দেমিরেল। এরপর আনাভাতানের মেসুত এলমাজের নেতৃত্বে কোয়ালিশন সরকার গঠিত হয়। দেসেপের বুলেন্ট এজেবিত উপপ্রধানমন্ত্রী হন।
ড. নাজমুদ্দিন আরবাকানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার সামরিক বাহিনীর এ খেলাকে ‘পোস্ট মডার্ন ক্যু’ হিসেবে আখ্যা দেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
এ অভ্যুত্থানের পর তুরস্কে ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ইসলামি রাজনীতি বড় ধরনের সংকটে পড়ে। ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে রেফা পার্টি নিষিদ্ধ করা হয়। আরবাকান সরকারের নেওয়া অনেক প্রকল্প বাতিল করে দেয় সরকার। হিজাব পরিহিত শিক্ষার্থীদের বহিষ্কার করা হয়। ইমাম হাতিব স্কুলগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়।
পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৯ সালে। এ নির্বাচনে দেসেপে ১৩৮টি, মেহেপে ১২৯টি, ফজিলত পার্টি (রেফা পার্টি বিলুপ্ত করে গঠিত দল) ১১১টি, আনাভাতান ৮৬টি এবং দরয়ু ইয়ুল পার্টি ৮৫টি আসনে জয়লাভ করে। ফজিলত পার্টিকে ঠেকাতে মেহেপে ও আনাভাতানকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট করে দেসেপে। প্রধানমন্ত্রী হন বুলেন্ট এজেবিত।