আমেরিকার গণতন্ত্রের মৃত্যু যেভাবে

স্পেঙ্গলার | Jan 09, 2021 04:38 pm
আমেরিকার গণতন্ত্রের মৃত্যু যেভাবে

আমেরিকার গণতন্ত্রের মৃত্যু যেভাবে - ছবি সংগৃহীত

 

ক্যাপিটাল হিলে ৬ জানুয়ারি হামলার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র নিজের যে ক্ষতি নিজে করেছে তা রাশিয়ার সাইবার আক্রমণকারী, চীনের গোয়েন্দা, জিহাদি, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বা বাইরের কোনো শত্রু এত ক্ষতি করতে পারত না। 

হামলার পরদিন সন্ধ্যায় সারা বিশ্বে আমার বন্ধুদের থেকে আসা ফোনকল রিসিভ করি এবং এ বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলেছি। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সিনিয়র কূটনীতিক। তিনি আমেরিকার একটি মিত্র রাষ্ট্রের কূটনীতিক। ১৯১২ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক দখলের পর প্রথমবারের মতো ক্যাপিটল হিলে এ হামলার বিষয়ে আমার অভিমত জানতে চাইলেন তিনি।

ওই কূটনীতিক জানালেন, এ ঘটনায় তিনি আতঙ্কিত; যেমন আতঙ্কিত মুক্ত পৃথিবীর আর সবাই। ক্যাপিটল হিলে আক্রমণের ঘটনায় চীনের হাসিতে দম ফাটার অবস্থা। চীনা সরকারি দৈনিক গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, ‘ওয়াশিংটন ডিসিতে সংঘটিত দাঙ্গা, ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটল ভবন দখল, চার জনের মৃত্যু, ৫২ জনের আটক আর ১৪ পুলিশ আহতের ঘটনায় বিশ্ব মর্মাহত। চীনা বিশেষজ্ঞদের মতে অপ্রত্যাশিত এ ঘটনা ‘গণতন্ত্রের বাতিঘরের’ পতন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আর ‘সিটি আপ অন অ্যা হিল’ বিষয়ে আড়ম্বরপূর্ণ যে সুন্দর ভাষা তাও নস্যাত হবে।

বিশ্ব দেখছে, এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা হতাশ। তারা দেখছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রশংসা তারা করতেন; সে দেশটি এখন ভয়ানক এক গণ্ডগোলে জড়িয়ে পড়েছে। চীনা পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এ ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ইমেজের প্রতি চরম এক আঘাত। আর গণতন্ত্রের অজুহাতে ভবিষ্যতে অপর কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর বৈধতা ও যোগ্যতা পুরোপুরি হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।’

ক্যাপিটল হিলের ঘটনা যদি কেবল ট্রাম্পের ভুলের কারণে হতো তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে পারত। সমস্যা হলো- প্রকৃতপক্ষে একটি বিস্তৃত ও নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রে জনপ্রিয় বিশ্বাসের একটি ভিত্তি রয়েছে। এটা শুরু হয়েছে ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে বসার আগেই। তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা তার প্রচারের অংশে গোয়েন্দা সম্প্রদায়ের নজরদারি ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে। আর এটি তারা করেছে রাশিয়ার সাথে আঁতাত নিয়ে একটি মিথ্যা কাহিনী তৈরি করার জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের মূল ধারার গণমাধ্যম ট্রাম্পবিরোধীদের দ্বারা ঠাসা। তারা বারবার প্রচার করেছেন ট্রাম্পবিরোধী এ কাহিনী।

শুধু ডেমোক্র্যাট নেতৃত্ব আর তাদের মিত্র গণমাধ্যম নয়, বরং ট্রাম্পের নিজ দলের তথা রিপাবলিকান বুশ-রমনি শাখাও চরম ট্রাম্পবিরোধিতায় লিপ্ত থেকেছে।

এর ফলে কংগ্রেস এবং গণমাধ্যমের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হয়েছে। এটি করতে সহায়তা করেছে আমেরিকা যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তাদের অনেকে। এটি এখন আশ্চর্যের কিছু নয় যে, প্রতি পাঁচজন আমেরিকানের দুইজন এখন বিশ্বাস করেন, ২০২০ সালের নির্বাচন হলো বিশাল এক ষড়যন্ত্র আর জোচ্চুুরির নির্বাচন।
কংগ্রেসে যখন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের স্বীকৃতির কার্যক্রম চলছিল ঠিক তখন হোয়াইট হাউজে দায়িত্ব পালনরত প্রেসিডেন্ট কর্তৃক তার অনুসারী দাঙ্গাবাজদের কংগ্রেসে হামলার জন্য লেলিয়ে দেয়ার ঘটনায় বিশ্ব তাজ্জব বনে গেছে। কিন্তু মূল সমস্যা ট্রাম্পের এই কদাচার আর কুখ্যাত কর্মকাণ্ড নয়। সমস্যা হলো- সাংবিধানিক পদ্ধতি যা যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্বে মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে, তার বিরুদ্ধে জনতার বর্ণবাদী বহিঃপ্রকাশ।

এর আগে পরিকল্পিত বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা উচ্ছৃৃঙ্খলতা দেখিয়েছেন। আর এবার ট্রাম্প অনুসারীরা আমেরিকার গণতন্ত্রের পবিত্র থেকে পবিত্র থেকে পবিত্রতম সিনেট চেম্বারকে অপমানিত করেছেন।
ডেমোক্র্যাটদের বক্তব্য, আফ্রো-আমেরিকান, নারী এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুর বিরুদ্ধে সমস্ত সিস্টেম কঠিন করা হয়েছে। আর রিপাবলিকানদের বক্তব্য হলো- বৈশ্বিক একটি অভিজাত শ্রেণী মধ্যম আয়ের আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সিস্টেম কঠিন করেছে।

পরিকল্পিত বর্ণবাদের মতোই নির্বাচন জালিয়াতির বিশ্বাস ছড়িয়ে পড়েছে। পরিকল্পিত বর্ণবাদ আর নির্বাচন জালিয়াতি এই দুই ক্ষেত্রেই প্রাথমিক অপরাধ হলো অবিশ্বাস বা মতবিরোধ। পরিকল্পিত বর্ণবাদ নেই এ কথা বলাও একটি বর্ণবাদ। আবার নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে- এটি অস্বীকার করাও একটি বিশাল চক্রান্তের জটিলতার প্রমাণ।

পিউ সার্ভে অনুসারে, প্রতি চারজন আমেরিকানের একজন বিশ্বাস করে, কোভিড-১৯ হলো একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। প্রতি তিনজনের একজনের বিশ্বাস- ‘ডিপ স্টেট’ (রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে যারা পেছনের শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকেন) ট্রাম্পকে হেয় করার চেষ্টা করছে।

অনেক আমেরিকান বিশ্বাস করে, নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে। কারণ তাদের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি বলেছেন, তাই। নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে- ট্রাম্পের এ অভিযোগ যদি সত্য হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একটি ব্যানানা রিপাবলিকে ( অস্থিতিশীল দেশ) পরিণত হয়েছে। আর আমেরিকার গণতন্ত্রও পরিণত হয়েছে বাঁকা রসিকতায়। এ ক্ষেত্রে আরো সত্য হলো- আমেরিকার জনগণের আস্থা নস্যাত হয়ে গেছে। জনগণের এ আস্থাই গণতন্ত্রকে কার্যকর করে তুলতে সহায়কের ভূমিকা পালন করেছে। গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত হলো- জনগণের আস্থা। আমেরিকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও জনগণের আস্থার পতন ঘটেছে।
ভোট জালিয়াতির হয়তো অনেক প্রমাণ আছে কিন্তু তা শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর বাধাগ্রস্ত করা বা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার পক্ষে মোটেও যথেষ্ট নয়।

যারা ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসী, তাদের মত- ডেমোক্র্যাটদের চেয়েও ট্রাম্পের কট্টরবিরোধী হলো, তার দলের মূল ধারার রিপাবলিকানরা। ট্রাম্পের দলের অর্থাৎ অনেক শক্তিশালী রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পকে একেবারেই আর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দেখতে চান না। তারা ডেমোক্র্যাটদের সাথে মিলে ষড়যন্ত্র করেছেন ট্রাম্পকে পরাজিত করতে। কংগ্রেসে রিপাবলিকানরা অনেক ভালো করলেও সে অনুযায়ী ভোট পাননি ট্রাম্প। অনেক ভোটার হয়তো রিপাবলিকান কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছেন কিন্তু ভোট দেননি ট্রাম্পকে। এটা সম্ভব; কিন্তু অভাবনীয়।

ট্রাম্প, জো বাইডেন, কমলা হ্যারিস বা অন্য কোনো রাজনীতিবিদ সমস্যা নন। আমেরিকার বর্তমান সমস্যা হলো- দেশটি ফাঁপা হয়ে পড়েছে। আমেরিকা ধার করা অর্থের ওপর চলছে। জরুরি অবস্থায় দেশটির জনগণকে রক্ষায় বস্তুগত ও সাংগঠনিক উভয় ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলেস হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি কর্মীদের বলে দেয়া হয়েছে- যাদের অবস্থা একেবারে শোচনীয় তারা ছাড়া অন্যদের যেন অক্সিজেনসেবা না দেয়া হয়। কারণ, করোনা রোগীর বন্যায় শহরে অক্সিজেনের ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হাসপাতালে স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা উপকরণের দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। এখন তারা রোগীদের পর্যাপ্ত অক্সিজেন দিতে পারছেন না।
‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ স্লোগানের আড়ালে ট্রাম্প প্রশাসনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প খাত অব্যাহতভাবে রসাতলে যাচ্ছে। জরুরি পরিস্থিতিতে এবং স্বাস্থ্য খাতে কঠিন সঙ্কট চলাকালে দেশটি অত্যাবশ্যকীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি করতে পারছে না।

যেদিন ওয়াশিংটনের উচ্ছৃঙ্খল জনতা কংগ্রেসম্যান ও সিনেটরদের ধাওয়া দেয়, সেদিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় চার হাজারের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার নতুন রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। আমেরিকার বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত কোভিড ভ্যাকসিন হয়তো এখন পর্যন্ত সবচেয়ে কার্যকর; কিন্তু ৭ জানুয়ারি দেশটি মাত্র আট লাখ ডোজ ভ্যাকসিনের ব্যবস্থা করেছে। তার মানে, দেশটিতে সব লোকের এ টিকা পেতে আরো অনেক সময় লাগবে।
আমেরিকানরা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত। এর সঙ্গত কারণ রয়েছে। তারা দেখছে, গুটিকয়েক প্রযুক্তি কোম্পানি বিপুল সুবিধা পেয়েছে আর দেশের বাকি সব কিছু স্থবির এবং ক্ষয়প্রাপ্ত। তাদের বিশ্বাস, ক্ষতিকারক বৈশ্বিক একটি অভিজাত শ্রেণী তাদের দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। বিশেষ করে, ট্রাম্পপন্থীদের মধ্যে এ বিশ্বাস প্রবল। ট্রাম্প কোনো রাখঢাক না করে এ বিশ্বাসকে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজে লাগিয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলার জন্য।

যুক্তরাষ্ট্র বাকি বিশ্ব থেকে ঋণ গ্রহণ বন্ধ করে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ গত ১০ বছরে ১২ ট্রিলিয়ন বা ১২ লাখ কোটি ডলার হ্রাস পেয়েছে। ফেডারেল ঘাটতি এখন মোট দেশজ উৎপাদনের (গ্রস ডমেস্টিক প্রডাক্ট) ১৫ শতাংশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এটি সর্বোচ্চ ঘাটতি।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ইকোনমিক অ্যানালিসিসের তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র ট্রেজারি এখনো প্রতি আমেরিকানকে দুই হাজার ডলারের চেক পাঠিয়ে নেতিবাচক বাস্তব ফলনে ঋণ নিতে পারে। জনগণের মনোভাব যদি এখন ক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে তবে কী হবে যখন যুক্তরাষ্ট্র আর সস্তায় কোনো ঋণ নিতে পারবে না এবং ব্যয় সঙ্কোচন ও ছাঁটাই পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে?

ভাষান্তর : মেহেদী হাসান

এশিয়া টাইমস অবলম্বনে


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us