২০২১ : যেসব পরিবর্তন অনিবার্য
২০২১ : যেসব পরিবর্তন অনিবার্য - ছবি : সংগৃহীত
রাতের পর দিন, কষ্টের পর স্বাচ্ছন্দ্য, বিশৃঙ্খলার পর সুষ্ঠু বিন্যাস- এসব কিছুকেই সর্বশক্তিমান দুনিয়ার নিয়ম করেছেন বলে ধারণা করা হয়। ব্যতিক্রম ছাড়া এই নিয়মের মধ্যেই ঘটে চলেছে দুনিয়ার বিকাশ ও পরিবর্তন। অনেকে মনে করেন, সংখ্যার মধ্যে শক্তির প্রকাশ বা ইঙ্গিত রয়েছে। সে হিসাবে ২১ নম্বরটিকে ভাগ্য, ঝুঁঁকি, সুযোগ গ্রহণ এবং ‘পাশা’ ঘুরে যাওয়ার সাথে সংযুক্ত বলে মনে করা হয়। এটি শুধু আন্তর্জাতিক বিশ্বের জন্য নয়, বাংলাদেশের জন্য আরো বেশি সত্য মনে করা হচ্ছে। ২০২১ সালের ক্যালেন্ডারটি ঠিক ১৯৭১ সালের মতোই, দিন-তারিখ একই। আর এই সালটিতেই যুদ্ধ-ধ্বংসের পর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। ২০২০ সাল শুধু বাংলাদেশই নয়, গোটা বিশ্বের জন্যই ছিল ভয় আর অনিশ্চয়তার সময়। বাংলাদেশে সুশাসনে ব্যত্যয় এর মধ্যে হয়তো নতুন মাত্রা জুগিয়েছে। তবে বছরের শেষার্ধে গোটা বিশ্বের জন্যই প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য এমন কিছু ঘটনা দৃশ্যমান হয়েছে যাতে মনে হয় বৈশ্বিক ব্যবস্থার নতুন বিন্যাসে বড় কোনো ঘটনা ঘটতে পারে ২০২১ সালে।
এক বছরের অস্বাভাবিক অনিশ্চয়তার পর করোনাভাইরাস মহামারীকে নিয়ন্ত্রণে আনার সুযোগ সামনে আসছে বলে মনে হচ্ছে। স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক জীবনশক্তি এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এর মধ্যে অনেক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। ২০২১ সাল কাছে আসার সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে প্রথমবারের মতো এর ভ্যাকসিনগুলো সহজলভ্য হচ্ছে। সাথে সাথে ভ্যাকসিন বিতরণের ঝুঁকির বিষয়টিও সামনে চলে আসছে। ভ্যাকসিন নিয়ে প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে গোপন বা প্রকাশ্য প্রতিযোগিতাও দেখা দিচ্ছে। এর মধ্যে অনেক লোক টিকা নিতে অস্বীকার করতে শুরু করেছেন। একসময় এসব কিছুর হয়তো নিষ্পত্তি হবে। এ সময় করোনার উৎপত্তি ও ছড়িয়ে যাওয়ার বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ আকৃষ্ট হতে পারে নতুন করে। কারণ এই ধারণায় ব্যাপক ঐকমত্য রয়েছে যে, করোনাভাইরাস মানবসৃষ্ট, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এটি ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বব্যাপী।
মহামারী-উত্তর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ । এই মহামারীতে সরকারি-বেসরকারি খাতের অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়েছে দেশে দেশে। সার্বিক বৈশ্বিক চাহিদার ওপর এর পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। অনেক দেশে অর্থনীতির মহামারী থেকে প্রত্যাবর্তনের পরের পুনরুদ্ধার জটিল হয়ে উঠবে। শক্তিশালী এবং দুর্বল বাণিজ্য সংস্থাগুলোর মধ্যে ব্যবধান আরো প্রশস্ত হবে। নতুন বিকাশের সুযোগটি শক্তিমানরাই হয়তো বেশি করে নিতে পারবেন। বলা যায়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রিক এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নতুন বিন্যাস দেখা দেবে অনেকটা অনিবার্য হয়ে।
বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে এই জানুয়ারিতেই পরিবর্তন আসছে। কেবল তাই নয়। সেই সাথে জো বাইডেনের ক্ষমতারোহণ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি-বিন্যাসে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য হোয়াইট হাউজে নতুনভাবে আরো বড় পদে ফিরে আসা জো বাইডেন একটি বিধ্বস্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে কতটা শৃঙ্খলা ও নিয়মে আনতে পারবেন তা নিয়ে বিশ্লেষকরা একেবারে সংশয়মুক্ত নন। তবে আমেরিকান নীতি ও কার্যক্রমে নিয়ম ও পরিকল্পনা নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ট্রাম্প ছিলেন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের এক প্রতিভূ। অন্য দিকে জো বাইডেনের নীতির মধ্যেও জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয় থাকবে; তবে সেটি হবে সার্বিক আমেরিকান জাতীয়তাবাদ যার সাথে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে আন্তর্জাতিক সমন্বয়। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে এসে এই সমন্বয়ের সূচনা করতে পারেন যার স্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি আগেই দিয়েছেন।
রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র হতে পারে। রাশিয়ার সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক নিয়ে একটি রহস্যময় ধোঁয়াশা সবসময় ছিল। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পকে জয়ী হতে সহযোগিতার বিনিময়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে এবং সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে ক্রেমলিনের বিশেষ অবস্থান তৈরিতে সহযোগিতা অথবা ছাড় দিয়েছেন বলে ডেমোক্র্যাট নেতাদের অনেকেই মনে করেন। ফলে পুতিনের রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের একটি মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব সূচনাতেই থাকবে; যার ইঙ্গিত বাইডেন দায়িত্বে আসার আগে থেকেই পুতিন-ল্যাভরভের নানা বক্তব্যে অনুমিত হয়। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারে যার সাথে বাইডেন যোগসূত্র বাড়াতে পারেন।
ট্রাম্প রাশিয়াকে যতটা ছাড় দিয়েছেন, ততটাই চীনের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন বলে মনে করা হয় বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার কারণে। এই যুদ্ধ চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মধ্যেও যে সহযোগিতার ভিত্তি আগের কয়েক দশকে তৈরি হয়েছিল, তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকান বাজার ও বিনিয়োগ- দু’টিই চীনের জন্য সঙ্কুুচিত হয়ে গেছে। এর জন্য সস্তায় পণ্য প্রাপ্তি এবং লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ায় আমেরিকান ভোক্তা ও করপোরেশনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য দিকে চীনা নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিতি নানা ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। ট্রাম্পের চীনবৈরিতার কথামালা এমন এক অবস্থায় চলে গেছে যে, তিনি করোনাভাইরাসের নাম দিয়েছেন ‘চীনা ভাইরাস’; মানেটা হলো- বেইজিং-ই এই ভাইরাসে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে বলে বার্তা দিতে চেয়েছেন ট্রাম্প। তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেই ক্ষান্ত হননি। সেই সাথে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে চীনবিরোধী নীতি কার্যকর করার পদক্ষেপও নিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো ব্যক্তিও এ নিয়ে চীন-আমেরিকা প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। প্রশ্ন হলো- বাইডেন প্রশাসনের চীনা নীতি শেষ পর্যন্ত আসলেই কেমন হবে?
বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের চীন-রাশিয়ার প্রতি নীতি যত কঠোর হবে, এই দু’টি দেশের মধ্যে কৌশলগত বন্ধন তত দৃঢ় হবে। এর মধ্যে, এ দু’দেশের বিশেষ সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পুতিন বলেছেন, এই সহযোগিতার কোনো সীমারেখা থাকবে না। একই ধরনের কথা বলা হয়েছে বেইজিং থেকেও। এটি ঠিক যে, জো বাইডেন আমেরিকান জাতীয়তাবাদী স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করবেন। তার সময়ে মার্কিন-চীন উত্তেজনা সম্ভবত শেষ হবে না। তবে বাইডেন চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধ না করেও একধরনের কাজের সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। আমেরিকান বিনিয়োগ ও চীনা পণ্যের বাজার বন্ধের ধারা সম্ভবত অব্যাহত থাকবে না। সহনীয় অবস্থায় তিনি এটিকে রেখে দিতে পারেন। তবে তিনি একই সাথে আরো কার্যকরভাবে আমেরিকার মিত্রদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য অনেক কিছু সংশোধন করতে চাইবেন। এশীয় বাণিজ্য সহযোগিতার যে কাঠামো চুক্তি থেকে ট্রাম্প সরে এসেছেন, সেটিকে তিনি সক্রিয় করতে পারেন। কোয়াডকেও তিনি সম্প্রসারণ করতে ও এগিয়ে নিতে চাইতে পারেন। তবে ভারতের মোদি সরকারের সাথে বাইডেন প্রশাসনের মৈত্রী ও টানাপড়েন একই সাথে চলতে পারে। ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে মোদির রাজনীতির ধ্যান-ধারণা মিলে না। আবার এশিয়ায় ভারতের মতো দেশকে মিত্র হিসেবে পাওয়ার কৌশলগত গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বড়।
তবে কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণ করলেও ভারতের চোখ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার নীতি থেকে ওয়াশিংটন সরে আসতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সাথে নিজস্ব স্বার্থকে সামনে রেখে ভারসাম্যের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে পারে ওয়াশিংটন। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে ধারাবাহিকতা বাইডেন প্রশাসন অব্যাহত রাখতে পারে। তবে তার আগে তালেবানের সাথে একটি তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তি করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ওয়াশিংটনের স্বার্থ রক্ষিত হবে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে ওয়াশিংটনপন্থী নীতি অথবা অন্তত ভারসাম্য কামনা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। নেপালকে চীনা বলয় থেকে বের করার ব্যাপারে দিল্লিøর সাথে সমন্বিত নীতি নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান যাতে একবারেই ভারসাম্যহীনভাবে চীনা জোটে চলে না যায়, সেটি চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা ওয়াশিংটনের অগ্রাধিকার পেতে পারে বাইডেন প্রশাসনের সময়। মিয়ানমারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে। চীনের বিপরীতে, ভারত ও ইসরাইলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃনির্মাণে অগ্রাধিকার দিতে পারেন বাইডেন।
২০২১ সালের মধ্যপ্রাচ্য কেমন হবে তার প্রতি সবচেয়ে বেশি নজর দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। ট্রাম্পের আমলে মধ্যপ্রাচ্যের সাথে আমেরিকার সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন আসে। ওয়াশিংটনের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে বরাবরই প্রভাব ছিল ইসরাইলের। কিন্তু ট্রাম্প প্রশাসনের সময় ইসরাইলের স্বার্থ অনেকখানি আমেরিকান স্বার্থে পরিণত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাকে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের শর্ত বানানো হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের পথ ধরে বাহরাইন, সুদান ও সর্বশেষ মরক্কো ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়। বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা রয়েছে। ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে নতুন করে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার চাপ সৃষ্টি করা না-ও হতে পারে যদিও আমেরিকান নীতি প্রণয়নে ইসরাইলের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
একটি বিষয় নিয়ে এখন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে যে, ডোনাল্ড ট্রাম্প বিদায় নেয়ার আগে ইরানের ওপর সামরিক হামলা পরিচালনা করতে পারেন। এটি করা হলে তা হবে ইসরাইলের স্বার্থে ট্রাম্প প্রশাসনের সর্বশেষ পদক্ষেপ। ইসরাইলে দুই বছরের মধ্যে চতুর্থবার নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে নেতানিয়াহু জয়ী হোন, তা ডেমোক্র্যাট নেতারা চান না বলেই মনে হয়। ট্রাম্প ইরানে হামলা চালালে দু’দেশের মধ্যকার সম্পর্কে অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। এতে যুক্তরাষ্ট্র পামাণবিক চুক্তিতে ফেরার বিষয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হতে পারে। ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিনেজাদকে হত্যা করে এক দফা উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা হয়েছিল, কিন্তু এই উসকানিতে ইরান পা না দেয়ায় সেটি সফল হয়নি। এখন নতুন কোনো অজুহাত সৃষ্টি হলে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণ ব্যাহত হতে পারে। তবে বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর ইরানের ওপর আমেরিকান চাপ চলে যাবে এমনটি মনে হয় না।
ইরান ইসলামী বিপ্লবের পর যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বতন্ত্র একটি ব্যবস্থা তৈরি করেছে। পশ্চিমারা এটিকে থিওলজিক্যাল পলিটিক্যাল ইসলাম বা এ ধরনের কিছু দিয়ে চিহ্নিত করতে চায়। বাস্তবতা হলো- অবাধ ভোটাধিকার প্রয়োগের গণতন্ত্র ও শিয়া ইমামত ব্যবস্থার মিশ্রণে একটি রাজনৈতিক পদ্ধতি ইরানে তৈরি হয়েছে। এটিকে সার্বজনীন রাজনৈতিক মডেলে রূপ দেয়া মুসলিম দেশগুলোর জন্য সম্ভব বলে মনে হয় না। ফলে ইরানকেন্দ্রিক যে শক্তির অভ্যুদয় সেটি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী কেন্দ্র হতে পারে, কিন্তু মুসলিম বিশ্বের মূল নেতৃত্ব ইরানের হাতে যাবে না জনসংখ্যা বাস্তবতার কারণে। বিশ্বে মোট মুসলিম জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ সুন্নি আর ২০ শতাংশ শিয়া। ফলে সুন্নি জনগণ ইরানকে একক নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। অন্য দিকে আমেরিকার সর্বাবস্থায় বৈরীসুলভ নীতির (ব্যতিক্রম আফগানিস্তানে তালেবান, ইরাকে সাদ্দাম ও সিরিয়ায় আইএসবিরোধী তৎপরতায় সহযোগিতা) কারণ ইরানকে কৌশলগত মিত্র হিসেবে চীন ও রাশিয়ার অধিকতর নিকটবর্তী করেছে। ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তিতে পুনঃপ্রবেশ না করলে ইরানের চীন-রাশিয়া নির্ভরতা আরো বাড়তে পারে।
মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে তুরস্ক একটি বড় নির্ণায়ক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া এবং সর্বশেষ আজারবাইজানে সামরিক সক্রিয়তার পর এই অঞ্চলে বিদ্যমান ভারসাম্যে বড় পরিবর্তন এসেছে।
এরদোগান নির্বাহী রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তুরস্ক নিজেকে নতুন অবস্থানে নিয়ে গেছে তিনটি ঘটনা দিয়ে।
প্রথমত, আঙ্কারা সিরিয়ায় উদ্বাস্তুদের জন্য একটি ‘নিরাপদ অঞ্চল’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সাথে, একই সাথে সমঝোতা চুক্তি করে। এর বিরুদ্ধে আসাদের সরকারি বাহিনী তৎপরতা শুরু করে একদল তুর্কি সেনাকে হত্যা করলে এর জবাব তুরস্ক এমনভাবে দিয়েছে যাতে আসাদের সরকারি বাহিনী হিজবুল্লাহর সহযোগিতা নিয়েও তুরস্কের ওপর আঘাত করার প্রচেষ্টা আর নেবে না। একই সময়ে পিকেকে’র তৎপরতাকে কেন্দ্র করে এমন কিছু পাল্টা ব্যবস্থা তুরস্ক বিচ্ছিন্নতাবাদী এই গোষ্ঠীর ওপর নিয়েছে যাতে সিরিয়া ও ইরাকের ভূখণ্ড থেকে তুরস্কে আঘাত হানার চিন্তা তারা করবে না।
দ্বিতীয়ত, লিবিয়ায় জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে পতনোন্মুখ অবস্থা থেকে একটি বিজয়ী শক্তি হিসেবে সমঝোতার টেবিলে হাজির করেছে ত্রিপলির সররাজ সরকারকে। আর ভূমধ্যসাগরের পানিসীমার ব্যাপারে চুক্তি করে তুরস্ক এই অতি গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্রাঞ্চলে তার প্রয়োজনীয় এখতিয়ার বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। ১৯২৩ সালের বিতর্কিত লুজান চুক্তির মাধ্যমে ভূমধ্যসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদের এখতিয়ারকে তুরস্কের জন্য অন্যায়ভাবে অতিসীমিত করার প্রচেষ্টার ব্যাপারে প্রথম কার্যকর একটি অবস্থান তৈরি করেছে তুরস্ক। এই বিষয়টি নিয়ে গ্রিস ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কিছুটা টানাপড়েন সৃষ্টি হলেও আলোচনা ছাড়া একতরফা কিছু করা যে এখন সম্ভব হবে না তা নিশ্চিত হয়েছে আঙ্কারা।
তৃতীয় বিষয়টি হলো- আজারবাইজানের নাগরনো কারাবাখ আজারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা পালন করা। এর মধ্য দিয়ে সত্যিকার অর্থে আঞ্চলিক পরাশক্তির মতো একটি অবস্থান তুরস্ক নিশ্চিত করতে পেরেছে। একই সাথে মধ্য এশিয়ার একসময় তুর্কি খেলাফত শাসিত অঞ্চলে প্রভাব তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এর পাশাপাশি, তুর্কি সাইপ্রাসকে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি আনা গেলে তুরস্কের জন্য প্রভাব বিস্তারের বিরাট সুযোগ আসবে।
২০২০ সাল নাগাদ এই অর্জনে একটি প্রচণ্ড বৈরিতার মুখোমুখি তুরস্ককে হতে হবে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দেশের বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, স্পেন ও গ্রিসের নেতারা তুরস্ককে নব্য উসমানীয় রাষ্ট্র’ হিসেবে সমালোচনা শুরু করেছেন। ইসরাইল-আমিরাত বলয়ও তীব্র তুর্কিবিরোধী নীতি গ্রহণের আভাস দিতে শুরু করেছে। এরদোগান ২০২১ সালে শক্রতাকে ন্যূনতম করার নীতি নিতে পারেন; যার কারণে ইসরাইল, সৌদি আরব, মিসর ও আমিরাতের সাথে উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টার আভাস খোদ প্রেসিডেন্ট এরদোগানের বক্তব্যে এসেছে। তবে এ জন্য ফিলিস্তিন ও উম্মাহ এজেন্ডাকে আঙ্কারা পরিত্যাগ করবে বলে মনে হয় না।
ইসরাইল মুসলিম বিশ্বের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের মাধ্যমে দুনিয়ার একটি অংশে প্রভাব বিস্তারের যে কার্যক্রম শুরু করেছে তা আসন্ন নির্বাচনে নেতানিয়াহু জয়ী হোক বা না হোক পুরোপুরি পরিত্যক্ত হবে না। দেশটি আরব বিশ্বের মধ্যে সৌদি স্বীকৃতি লাভের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে, বাদশাহ সালমানের রাজত্বকালে যেটি অর্জন প্রায় অসম্ভব বলে মনে হয়। অনারব মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে চারটি দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তেলআবিব। এর মধ্যে চারটি দেশের নাম উল্লেখ করা হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে- পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশ। বড় কোনো অঘটন না ঘটলে পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। বাকি দু’টি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে অদূর ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে দু’টি দেশেই মধ্যবর্তী একটি নির্বাচন অনিবার্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
মালয়েশিয়ার ক্ষমতার একেবারেই কাছাকাছি গিয়েও আনোয়ার ইব্রাহিম প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ মালয় ‘ডিপস্টেট’ আনোয়ারকে প্রধানমন্ত্রী হতে দিতে সম্মত হয়নি। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ এই কারণে যে, আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া ঠেকানোর জন্য মালয়প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক শক্তির যেমন প্রচণ্ড বিরোধিতা রয়েছে, তেমনিভাবে ইসরাইল, আমিরাত, সৌদি বলয় আর চীন নেপথ্যে থেকে আনোয়ারের বিরোধিতা করছে। ফলে ২০২১ সালে একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়েই মালয়েশিয়ার পরবর্তী রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হতে পারে।
মালয়েশিয়ার মতো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তীব্র অস্থিরতার উপাদান থাকলেও ঢাকার ঝড় এখনো অন্তরালে রয়ে গেছে। এই দ্বন্দ্ব ও সঙ্ঘাত রাজনৈতিক পর্যায়ে যতটা, তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার ভিত্তি হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে। আর বাইরের প্রভাবশালী শক্তিগুলোর আধিপত্য বিস্তারের নেপথ্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা মালয়েশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশে বেশি। এ কারণে আধিপত্য বিস্তারের এই সঙ্ঘাত এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে পর্যবেক্ষকদের আশঙ্কা, যাতে ২০২১ সালে কোনো-না-কোনো অবস্থায় একটি পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। এ জন্য অনেকে ২০ জানুয়ারি জো বাইডেনের যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব গ্রহণের প্রতি বিশেষভাবে নজর রাখছেন।
mrkmmb@gmail.com