যেভাবে বদলে যেতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
ট্রাম্প ও বাইডেন - ছবি : সংগৃহীত
বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি হিসেবে পরিচিত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনে এই জানুয়ারিতেই পরিবর্তন আসছে। কেবল তাই নয়। সেই সাথে জো বাইডেনের ক্ষমতারোহণ যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নীতি-বিন্যাসে বড় রকমের প্রভাব ফেলবে বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য হোয়াইট হাউজে নতুনভাবে আরো বড় পদে ফিরে আসা জো বাইডেন একটি বিধ্বস্ত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে কতটা শৃঙ্খলা ও নিয়মে আনতে পারবেন তা নিয়ে বিশ্লেষকরা একেবারে সংশয়মুক্ত নন। তবে আমেরিকান নীতি ও কার্যক্রমে নিয়ম ও পরিকল্পনা নতুন করে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
ট্রাম্প ছিলেন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীদের এক প্রতিভূ। অন্য দিকে জো বাইডেনের নীতির মধ্যেও জাতীয়তাবাদের প্রশ্রয় থাকবে; তবে সেটি হবে সার্বিক আমেরিকান জাতীয়তাবাদ যার সাথে থাকার সম্ভাবনা রয়েছে আন্তর্জাতিক সমন্বয়। তিনি প্যারিস জলবায়ু চুক্তি এবং ইরানের সাথে পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে এসে এই সমন্বয়ের সূচনা করতে পারেন যার স্পষ্ট ইঙ্গিত তিনি আগেই দিয়েছেন।
রাশিয়া ও চীনের সাথে সম্পর্ক বাইডেন প্রশাসনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র হতে পারে। রাশিয়ার সাথে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্ক নিয়ে একটি রহস্যময় ধোঁয়াশা সবসময় ছিল। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্পকে জয়ী হতে সহযোগিতার বিনিময়ে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে এবং সাবেক সোভিয়েত অঞ্চলে ক্রেমলিনের বিশেষ অবস্থান তৈরিতে সহযোগিতা অথবা ছাড় দিয়েছেন বলে ডেমোক্র্যাট নেতাদের অনেকেই মনে করেন। ফলে পুতিনের রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের একটি মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব সূচনাতেই থাকবে; যার ইঙ্গিত বাইডেন দায়িত্বে আসার আগে থেকেই পুতিন-ল্যাভরভের নানা বক্তব্যে অনুমিত হয়। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেন একটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারে যার সাথে বাইডেন যোগসূত্র বাড়াতে পারেন।
ট্রাম্প রাশিয়াকে যতটা ছাড় দিয়েছেন, ততটাই চীনের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন বলে মনে করা হয় বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে বড় ধরনের বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করার কারণে। এই যুদ্ধ চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মধ্যেও যে সহযোগিতার ভিত্তি আগের কয়েক দশকে তৈরি হয়েছিল, তাকে নাড়িয়ে দিয়েছে। আমেরিকান বাজার ও বিনিয়োগ- দু’টিই চীনের জন্য সঙ্কুুচিত হয়ে গেছে। এর জন্য সস্তায় পণ্য প্রাপ্তি এবং লাভজনক বিনিয়োগক্ষেত্র সঙ্কুচিত হওয়ায় আমেরিকান ভোক্তা ও করপোরেশনগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অন্য দিকে চীনা নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিতি নানা ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। ট্রাম্পের চীনবৈরিতার কথামালা এমন এক অবস্থায় চলে গেছে যে, তিনি করোনাভাইরাসের নাম দিয়েছেন ‘চীনা ভাইরাস’; মানেটা হলো- বেইজিং-ই এই ভাইরাসে বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছে বলে বার্তা দিতে চেয়েছেন ট্রাম্প। তিনি এ ব্যাপারে কথা বলেই ক্ষান্ত হননি। সেই সাথে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদে চীনবিরোধী নীতি কার্যকর করার পদক্ষেপও নিয়েছেন। হেনরি কিসিঞ্জারের মতো ব্যক্তিও এ নিয়ে চীন-আমেরিকা প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধের শঙ্কা ব্যক্ত করেছেন। প্রশ্ন হলো- বাইডেন প্রশাসনের চীনা নীতি শেষ পর্যন্ত আসলেই কেমন হবে?
বলার অপেক্ষা রাখে না, যুক্তরাষ্ট্রের চীন-রাশিয়ার প্রতি নীতি যত কঠোর হবে, এই দু’টি দেশের মধ্যে কৌশলগত বন্ধন তত দৃঢ় হবে। এর মধ্যে, এ দু’দেশের বিশেষ সহযোগিতার চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। পুতিন বলেছেন, এই সহযোগিতার কোনো সীমারেখা থাকবে না। একই ধরনের কথা বলা হয়েছে বেইজিং থেকেও। এটি ঠিক যে, জো বাইডেন আমেরিকান জাতীয়তাবাদী স্বার্থের প্রতিভূ হিসেবে কাজ করবেন। তার সময়ে মার্কিন-চীন উত্তেজনা সম্ভবত শেষ হবে না। তবে বাইডেন চীনের সাথে বাণিজ্যযুদ্ধ বন্ধ না করেও একধরনের কাজের সম্পর্ক তৈরি করতে পারেন। আমেরিকান বিনিয়োগ ও চীনা পণ্যের বাজার বন্ধের ধারা সম্ভবত অব্যাহত থাকবে না। সহনীয় অবস্থায় তিনি এটিকে রেখে দিতে পারেন। তবে তিনি একই সাথে আরো কার্যকরভাবে আমেরিকার মিত্রদের সাথে সম্পর্ক মজবুত করার জন্য অনেক কিছু সংশোধন করতে চাইবেন। এশীয় বাণিজ্য সহযোগিতার যে কাঠামো চুক্তি থেকে ট্রাম্প সরে এসেছেন, সেটিকে তিনি সক্রিয় করতে পারেন। কোয়াডকেও তিনি সম্প্রসারণ করতে ও এগিয়ে নিতে চাইতে পারেন। তবে ভারতের মোদি সরকারের সাথে বাইডেন প্রশাসনের মৈত্রী ও টানাপড়েন একই সাথে চলতে পারে। ডেমোক্র্যাটদের রাজনৈতিক দর্শনের সাথে মোদির রাজনীতির ধ্যান-ধারণা মিলে না। আবার এশিয়ায় ভারতের মতো দেশকে মিত্র হিসেবে পাওয়ার কৌশলগত গুরুত্ব যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অনেক বড়।
তবে কৌশলগত মিত্র হিসেবে গ্রহণ করলেও ভারতের চোখ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে দেখার নীতি থেকে ওয়াশিংটন সরে আসতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের সাথে নিজস্ব স্বার্থকে সামনে রেখে ভারসাম্যের পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে পারে ওয়াশিংটন। আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে ধারাবাহিকতা বাইডেন প্রশাসন অব্যাহত রাখতে পারে। তবে তার আগে তালেবানের সাথে একটি তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তি করতে চাইবে যুক্তরাষ্ট্র, যেখানে ওয়াশিংটনের স্বার্থ রক্ষিত হবে। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার ব্যাপারে ওয়াশিংটনপন্থী নীতি অথবা অন্তত ভারসাম্য কামনা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। নেপালকে চীনা বলয় থেকে বের করার ব্যাপারে দিল্লিøর সাথে সমন্বিত নীতি নিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তান যাতে একবারেই ভারসাম্যহীনভাবে চীনা জোটে চলে না যায়, সেটি চাইবে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশে কার্যকর গণতন্ত্র চর্চা ওয়াশিংটনের অগ্রাধিকার পেতে পারে বাইডেন প্রশাসনের সময়। মিয়ানমারের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র চর্চাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেবে। চীনের বিপরীতে, ভারত ও ইসরাইলের প্রভাব কাজে লাগিয়ে মিয়ানমারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক পুনঃনির্মাণে অগ্রাধিকার দিতে পারেন বাইডেন।