ভারতের দিবাস্বপ্ন
বাইডেন ও মোদি - ছবি সংগৃহীত
দুনিয়া নতুন বছরের জানুয়ারি মাসে এসে পড়েছে। তার মানে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের শপথ নেয়ার দিন ২০ জানুয়ারি আরো ঘনিয়ে এলো। প্রায় সব কিছু ঠিক মতোই আগাচ্ছে, তেমন কোনো বাধা দেখা যাচ্ছে না। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্রমে খাঁচার ভেতরে প্রবেশ করে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছেন যেন। কিন্তু তবু একটা ভাগাভাগির লাইন আমেরিকান সমাজ ও মিডিয়ায় টানা হয়ে গেছে। তা সম্ভবত আর মুছবে না কোনো দিন। তা হলো তথাকথিত আমেরিকান জাতিবাদিতা। অলীক জাতিবাদিতার পক্ষে-বিপক্ষের একটা ভাগাভাগির দাগ থেকেই যাবে।
আগেই একে ‘তথাকথিত’ বলে দিলাম, আর সেই সাথে ট্রাম্পের চালু করা এই জাতিবাদিতা অলীক বা কাল্পনিক- তা আগেই বললাম এ জন্য যে, আমেরিকা রাষ্ট্র একবার গ্লোবাল ক্যাপিটালিজমে নেতৃত্ব দিয়েছে, অর্থাৎ এক গ্লোবাল পণ্য বিনিময়বাণিজ্য ব্যবস্থায় প্রবেশে সবকে সুযোগ এনে দিয়েছে, সব রাষ্ট্রকে জড়তা ভেঙে তাতে শামিল করেছে, সে রাস্তায় সবাইকে নামিয়ে গ্লোবাল আইন নিয়মকানুন তৈরি করে ফেলেছে, দুনিয়ার বাণিজ্য বিনিময়ের অভিমুখ নির্ধারণ করে গ্লোবাল পণ্য-পুঁজির বিনিময় বা বাণিজ্য এনে দিয়েছে। সেই রাষ্ট্র এখন বুড়া বয়সে সংরক্ষণবাদিতা দিয়ে, নিজ বাজারে অন্যের ঢোকা বন্ধ করে, চীন ও ইইউর সাথে ট্যারিফ আরোপের যুদ্ধ লাগিয়ে গ্লোবাল বাণিজ্য অসম্ভব করে তুলবে, এটা কিভাবে ঘটল? জাতিবাদী অর্থনীতি, আত্মনির্ভর অর্থনীতি, সংরক্ষণবাদিতা অথবা নিজে আমদানিও করব না রফতানিও করব না- এটা দুনিয়ায় একসময় একমাত্র টিকে ছিল সেসব দেশে ও সে সবকালে (১৬০৭-১৯৪৫) যখন ইউরোপের ওইসব নেতা রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক তৎপরতা বলতে ছিল অন্য দেশকে কলোনি দখল আর সেখান থেকে লুট ও শোষণে সম্পদ উঠিয়ে আনা। এমন রূপের কলোনি দখলদার রাষ্ট্র। কিন্তু আমেরিকা কখনো এমন দখলদার রাষ্ট্র বা তেমন অর্থনৈতিক দেশ ছিল না।
এ ছাড়া ১৯৪৪ সালে ব্রেটনউড বহুরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক) দুনিয়ায় চালু হয়ে যাওয়ার পর সেটা হওয়া শুধু আমেরিকার জন্য নয়, ইউরোপসহ যে কারো জন্যই আরো অসম্ভব হয়ে গেছে। সে কারণে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ ধরনের জাতিবাদিতা মানে, পণ্য-পুঁজি আমদানিও করব না রফতানিও করব না। এ ধরনের বাণিজ্যবিরোধী ধরনের স্বপ্ন আকাক্সক্ষার বাস্তবতার দুনিয়াই নেই। বরং ট্রাম্পের জাতিবাদিতা হলো, চীনকে একঘরে করে বা চীনকে বাদ দিয়ে সর্বোচ্চসংখ্যক বাকি রাষ্ট্রকে নিয়ে আগের মতোই আমেরিকান নেতৃত্বের (চীন বাদে) গ্লোবাল বাণিজ্যের সমাজ কায়েমের এক অলীক প্রচেষ্টা যেটা শতভাগই বাস্তবায়ন-অযোগ্য। তবে জাতিবাদের প্রপাগান্ডা মূল্য ও সুড়সুড়ি তোলার ক্ষমতা অপরিসীম। এ ছাড়া, নিজ দেশে জাতবাদী এক মিথ্যা ঐক্য ধারণা- অথবা ‘আমরাই শ্রেষ্ঠ’ ধারণার জন্ম দেয়া যায় খুব সহজেই। কেবল এখানে এসে মোদি ও ট্রাম্প নীতিতে এক ছিলেন।
তবে মোদিরটা প্রায় খোলাখুলি নিজের সাথেই অসততা বা প্রতারণা। যেমন, লাদাখ সীমান্তে চীনের সাথে সঙ্ঘাতের পর থেকে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক এখনো দেয়া হচ্ছে, প্রপাগান্ডা ও পণ্য আমদানিবিরোধিতা চলছে। কিন্তু বাস্তবে যেটা চলছে তা হলো, আগের চেয়ে চীনা পণ্য ভারতে আমদানি কমা দূরে থাক, এখন তা (গত অক্টোবর থেকে) ৩০% বেশি আমদানি হচ্ছে।
আর আপনার দেশ কাউকে দেশের বাজারে ঢুকতে দেবে না। এর মানে, অন্যেরা রফতানি করতে পারবে না কিন্তু আপনিই কেবল ওসব দেশে পাল্টা রফতানি করতে চান- এই নীতি। এটাই অলীক জাতিবাদিতা, যার কায়েম-বাস্তবায়ন অসম্ভব।
আর এ দিকে মোদির বিপরীতে ট্রাম্পের আমেরিকার বাস্তবতা হলো, এখানে আমেরিকান বাণিজ্যস্বার্থ দুই ভাগে বিভক্ত; দুটি ক্যাম্প তৈরি হয়ে গেছে। স্মল বা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলো মনে করে, স্বপ্ন-কল্পনা দেখে যে চীনের আসন্ন গ্লোবাল প্রভাবে এন্টারপ্রাইজগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারবে না। তাই ট্রাম্পের মিথ্যা প্রতিশ্রুতিই তাদের আত্মরক্ষার উপায়। কিন্তু এটা ‘মনে মনে পোলাও খাওয়া’র মতো। এটা করে দেখা হয়নি, তাই পরীক্ষিত নয়। বাস্তবে ওসব স্বপ্ন-কল্পনা সত্য না হওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল। আর বিপরীতে, চীনের আসন্ন গ্লোবাল প্রভাবে এক ধাক্কা আমেরিকার স্মল বা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজগুলোর ওপর আসবে অবশ্যই। কিন্তু তাতে এগুলো সব বিনাশ বা বন্ধ হয়ে যাবে এটি সত্য নয়। বরং এই ধাক্কায় ঢেলে সাজানো আসন্ন হবে অবশ্যই। তাতে কোনো ধরনের স্মল বা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ বন্ধ হয়ে যাবে আবার নতুন ধরনের কিছু স্মল বা মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ জন্মানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে। তাই ব্যাপারটা বিদেশীর বিরুদ্ধে দেশীর সংরক্ষণবাদী হওয়ার বিষয় নয়। বরং নতুন অর্থনৈতিক নেতা আসন্ন হবে বলে তার সাথে নিজেকে টিকানোর জন্য ঢেলে সাজানো, খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য কিছু পরিবর্তন- এরকমই হবে। তবু জাতিবাদী প্রপাগান্ডায় সফল সুড়সুড়িতে অলীক শত্রুর বিরুদ্ধে জাতিঐক্যের গানই সফলতা পাবে, অন্তত প্রথম কয়েক বছরে।
এর বিপরীতে আমেরিকায় যারা বড় এন্টারপ্রাইজ, যারা গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান মানে গ্লোবাল রফতানি বাণিজ্যভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান; এরা বাইডেনের আমলকে স্বাগত জানাবেন। কারণ এখনই যা ঘোষিত বা বাইডেনের নির্ধারিত নীতি তা হলো, ট্রাম্পের জাতিবাদিতায় আমেরিকার অনেক ক্ষতি হয়েছে; তাই আমাদের যত দ্রুততায় আগের সময়ের গ্লোবাল বাণিজ্য সম্পর্ক এবং পারলে যতটা সম্ভব গ্লোবাল নেতা থাকার নীতি ফিরিয়ে আনতে হবে। এটাকে বাইডেনের পরামর্শকরা বলছেন, ডেমোক্র্যাট দলের পুরনো বা ক্লাসিক নীতি অথবা ওবামার নীতিতে ফিরে যাওয়াই বাইডেনের সাধারণ নীতি হবে এবং এই বার্তাটাই সে চীনকে দিতে চায় বলে যতটা সম্ভব ওবামার আমলের যত পুরনো লোক (উপদেষ্টা, সচিব) আছেন তাদের দিয়েই বাইডেনের স্টাফ মূলত সাজানো হচ্ছে। আর তারা যেহেতু চীনের সাথে কাজ করেছেন, পূর্ব-পরিচয় অভিজ্ঞতা আছে ফলে তা আমেরিকার ওপর চীনা আস্থা (ট্রাম্পের কারণে যেটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে) ফিরানোর একটা আলাদা মাইলেজ হতে পারে। অর্থাৎ আমেরিকা সেই গ্লোবাল বাণিজ্যের ট্রাকেই ফিরে যাবে; কথিত জাতিবাদিতায় নয়। তাই সবখানেই সেটা পুনরুদ্ধার করাই বাইডেনের মৌলিক নীতি হবে।
কিন্তু বাইডেনের আমেরিকা ফিরতে পারবে কী?
সেটা এক বিরাট প্রশ্ন। পুরনো জায়গায় ওবামার লেভেলে আবার ফিরতে না পারার শঙ্কা ক্রমে বাড়ছে। ব্যাপারটা বুঝতে সবার আগে প্রশ্ন করা যাক, আসলে ‘ফিরতে পারা’ মানে কী?
সংক্ষেপে বললে আমেরিকা গ্লোবাল নেতৃত্ব নিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে ১৯৪২ সাল থেকে। সুনির্দিষ্ট সে যা করেছিল তা হলো, ওই বিশ্বযুদ্ধের মূল নির্ধারক নেতৃত্ব নেয়া, হিটলারবিরোধী অক্ষশক্তি জোট গড়া; তাতে সোভিয়েত ইউনিয়নকেও শামিল করা, ওই বিশ্বযুদ্ধে নিজেদের বিজয় ঘটানো, যুদ্ধের মেজর খরচ হিসেবে পক্ষের সব রাষ্ট্রকে আমেরিকা কোনো চুক্তি ছাড়াই অর্থ জুগিয়ে চলা, যুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বাদে সবাইকেই আবার যুদ্ধ-পুনর্বাসন ও অবকাঠামো নির্মাণের জন্য, এবার জাপান-জার্মানি-ইটালিসহ সারা ইউরোপকে নতুন বিনিয়োগ দেয়া। আর সেই সাথে ইউরোপ যেন কমিউনিস্ট দ্বারা দখল না হয়ে যায় তাই জার্মানি বা জাপানে স্থানীয় সামরিক ব্যারাকে আমেরিকান সৈন্য রেখে দেয়া।
আর এসব কিছুর খরচ আমেরিকা একা বহন করা। কিন্তু আমেরিকা কখনোই এই নিরাপত্তাদানের খরচ ইউরোপের কাছে চায়নি। এরই বিনিময়ে আমেরিকা ইউরোপের মন পেয়েছিল। আর সেই থেকে পায় নিজে গ্লোবাল (অর্থনীতি তো বটেই) পলিটিক্যাল একচ্ছত্র লিডারের স্বীকৃতি। তা দিয়েছিল অ-কমিউনিস্ট সারা ইউরোপ। পরে যুদ্ধে আমেরিকা খরচ বা বিনিয়োগ যা কিছু করেছিল কিস্তিতে হলেও সেসব খরচের অর্থ ফিরিয়ে দিয়েছিল। আর অবকাঠামো ঋণও তারা স্বল্প সুদসহ ফেরত দিয়েছিল কিস্তিতে। তবে সামরিক ব্যয় যেমন ইউরোপে সব ব্যারাক রাখার খরচ বা সামরিক জোট ন্যাটো পরিচালনার খরচের কমপক্ষে নব্বই ভাগ একা আমেরিকা বহন করে এসেছে, এ পর্যন্ত। কেবল ট্রাম্প এইবার ইউরোপের কাছে সামরিক ব্যারাক রাখার খরচ চেয়েছিলেন। এর চেয়েও ‘শকিং’ ব্যাপারটা হলো, ট্রাম্প নিজেই আমেরিকার গ্লোবাল বাণিজ্যের নেতা অবস্থান ছেড়ে সরে গিয়েছিলেন। ওই বছর (২০১৭) গ্লোবাল ইকোনমিক ফোরামে তার দেশ অংশ নেয়নি বা যেখানেই অংশ নিয়েছে (যেমন জি৭ বা জি২০) সেখানে জাতিবাদী ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিতে চলতে চেয়ে কথা বলে গেছে। এসব মিলিয়ে গত ৭৫ বছরের যে আমেরিকা গ্লোবাল নেতার পরিচয় পেয়েছিল তা ট্রাম্প তার শেষ চার বছরে সদম্ভেই সব মুছে ফেলেছিলেন।
সে কারণে, আসন্ন বাইডেন প্রশাসনের সাধারণ নীতি হবে আমেরিকাকে যতটা সম্ভব আগের গ্লোবাল নেতার আসনে ফিরিয়ে নেয়া। এ কাজে এবার মূলত তার আগানোর পথ হবে নীতিগত জায়গায় শক্ত করে দাঁড়িয়ে সব কিছুকে ফিরিয়ে আনা। আর এ কাজে সবার উপরে থাকবে হিউম্যান রাইট ইস্যুতে এক শক্ত আপসহীন অবস্থান। মোদির ভারত এতে ‘সাফার’ করবে অবশ্যই, কিন্তু ভারতকে কষ্ট দিতে হবে, এটা বাইডেনের কোনো পলিসি নয়। বরং হিউম্যান রাইট ইস্যুতে শক্ত আপসহীন অবস্থান নিলে গ্লোবাল অর্থনৈতিক নেতৃত্বের প্রশ্নে আমেরিকা চীনের কাছে পরাজিত হয়ে গেলেও গ্লোবাল রাজনৈতিক নেতৃত্ব সহসাই আমেরিকার হাত থেকে চলে যাওয়া তবেই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে এবং তা সম্ভবত অনেক দীর্ঘ দিন আমেরিকার হাতে থাকবে। এবার প্রকাশিত এক গবেষণা-স্টাডি রিপোর্ট বলছে, করোনাভাইরাসকে কঠোরভাবে মোকাবেলা করতে এবং এই ম্যানেজমেন্ট সাকসেসের কারণে ২০৩৫ সালে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে অর্থনৈতিক নেতৃত্ব চীনের পাওয়ার কথা ছিল। সেটা এখন ২০২৮ সালের মধ্যেই চীন অর্জন করে ফেলবে বলে অনুমিত হচ্ছে। তাই অন্তত গ্লোবাল রাজনৈতিক নেতার আসন ধরে রাখতে বাইডেন নিজ দেশের হিউম্যান রাইট ইস্যুতে শক্ত আপসহীন অবস্থানের কথা বলছেন। তিনি শুধু ভারতের কাশ্মির নীতিই নয়, ভারতের নাগরিকত্ব আইন এবং মুসলমানদের প্রতি নিপীড়ন ও বৈষম্য নিয়েও উচ্চকিত হবেন বলে জানিয়ে আসছেন। একই অবস্থান নেবেন বাংলাদেশের হিউম্যান রাইট ইস্যুতেও। এ কারণে এসব দেশের নেতৃত্ব চিন্তিত হয়ে পড়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
এ দিকে গত ২৪ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক টাইমসে এমন এক প্রো-ভারতীয় রিপোর্ট ছাপা হয়েছে যাকে বলা চলে, বাইডেনের নীতির চাপের কথা ভেবে ভারতীয় মিডিয়া ও রাজনীতিতে যে দম বন্ধ অবস্থা তৈরি হয়েছে তা থেকে ভান করে হলেও যেন তাদের সাময়িক নিঃশ্বাস নিতে দিতেই এই রিপোর্ট লেখা হয়েছে।
ওই রিপোর্টের শিরোনাম, ‘বাইডেন হিউম্যান রাইট ইস্যুতে জোর দিলেও আমেরিকা-ভারত সম্পর্ককেও বিস্তারে নেবেন’। এই শিরোনামটা নিজেই এক হার-স্বীকার করা সান্ত¡নামূলক শিরোনাম। কারণ হিউম্যান রাইট ইস্যুর ব্যাপক ‘খামতিওয়ালা’ মোদি বাইডেনের সাথে আলাপে গেলে বলাই বাহুল্য, প্রতিটা পদেই সমালোচিত হবেন আর এই সমালোচনার ভয় ও মনমরা অনৈতিক অবস্থানের ছাপ সবার ওপর সব ইস্যুতেও থাকবে। তাই বাইডেনের পক্ষে সম্পর্ক কোনো দিকে এগিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে যাবে। এ ছাড়া এমন দুই নেতার বৈঠকে যদি একজনের চোখে অপরজন খাটো হয়ে থাকেন ওই আলোচনাই আগাবে না। শুধু তা নয়, সেটি একটি বেইজ্জতির কাণ্ড হয়ে যেকোনো সময় হাজির হয়ে যেতে পারে এই ভয় ঢুকবে সবার মনে। আর এই ভয়েই সম্ভবত মোদি বাইডেনের সামনে আসতেই চাইবেন না। তাই, মোদি সাক্ষাতের কোনো মিটিং এড়িয়ে চলতে চাইবেন।
তবে ওই রিপোর্ট এসব প্রশ্নের মীমাংসা না করতে পেরে শেষে স্বাভাবিকভাবে এবার রিপাবলিক থিংকট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের কিছু মন্তব্য নিয়ে এসেছে, নিজেদের মনোবল বাড়াতে। যেমন কার্নেগি ইন্ডিয়ার অ্যাশলে, ট্রাম্পের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টেফান বিগান বা থিংকট্যাঙ্ক ব্যক্তিত্ব রিচার্ড ফনটেইন- এদের কথা উদ্ধৃতিতে আনা হয়েছে। কিন্তু কোথাও পরিষ্কার বলা নেই তারা এসব কথা কবে বলেছেন? নভেম্বরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে, না পরে? তা স্পষ্ট নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা, তারা কি বাইডেন জিতার পরে তার সম্ভাব্য নীতি সম্পর্কে বলছেন, সেটাও নিশ্চিত করেননি। এমনকি দাবি করা হয়েছে, বাইডেন নাকি এশিয়ায় চীনের ক্ষমতার ভারসাম্য হিসেবে কোয়াড জোট নিয়েও আগাবেনই।
এমন অনুমানের ভিত্তি নেই। কারণ বাইডেন চীনের বিরুদ্ধে অনেকের সাথে পলিসিগত জোট বা ঐকমত্য করবেন হয়তো। কিন্তু কোয়াড তো সামরিক জোট আর তা এক আলাদা প্রতিষ্ঠান। কোনো দেশের অন্য দেশের সাথে পলিসিগত মিলের ভিত্তি খুঁজে পেয়ে ঘনিষ্ঠ হওয়া আর সামরিক জোটে তৎপর ও যুক্ত হওয়া- এ দুটো কোনোভাবেই এক নয়। অথচ এমন উদ্ভট দাবি এখানে করা হয়েছে চাতুরির সাথে। শেষে রেফারেন্স টানা হয়েছে ভারতের ট্রাম্প অনুসারী এক আমেরিকান থিংকট্যাঙ্কের প্রধান, ব্রহ্ম চেলানির। চেলানির দাবি একেবারে হুমকির মতন। তিনি নাকি বলেছেন, বাইডেন যদি চীনের প্রতি নরম অবস্থানে কথা বলেন তবে তা ভারতকে ‘দ্বিতীয় চিন্তা’ করতে ঠেলে দিবে। তবে এটা বিরাট হুমকি দেয়ার মতো কথা। কিন্তু ভারত ‘দ্বিতীয় চিন্তা’ করে কোথায় যাবে? ভারতের কাছে আমেরিকা ছাড়া আর কে বিকল্প আছে? আসলে ভারতের জন্য একটাই আমেরিকার বিকল্প আছে; সেটা হলো, এবার উল্টা আরো বেশি করে চীনের ঘনিষ্ঠ হয়ে যাওয়া! এ ছাড়া ভারতের জন্য আমেরিকার বিকল্প আর কই?
আবার সবশেষ ওই রিপোর্টে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, ‘আমেরিকার কিছু অ্যাক্টিভিস্ট বরং দাবি করেছেন বাইডেন যেন ভারতের সরকারকে হুঁশিয়ার করে দেয় ভারতের হিউম্যান রাইটের ব্যাপারে সতর্ক না হলে সেই ভারত হবে আমেরিকার জন্য ভীষণ বিপদের।’ অর্থাৎ এই রিপোর্ট শেষবিচারে ভারতের জন্য সান্ত¡নামূলক কিছু বাক্যও তুলে ধরতে পারেনি।
এ দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীন মিলে এক ভার্চুয়াল ভিডিও শীর্ষ বৈঠক সম্পন্ন করেছে। এটা হলো, চীনের সাথে ইইউর মূলত বিনিয়োগ ও বাণিজ্যবিষয়ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি। এর আনুষ্ঠানিক নাম ‘কম্প্রিহেনসিভ এগ্রিমেন্ট অন ইনভেস্টমেন্ট’ (সিএই)।
এতে সার কথাটা হলো, ট্রাম্প যেভাবে ইইউকে দূরে ঠেলে দিয়েছেন, তা বাইডেন এসে মেরামত করে আগের জায়গায় নেবেন বলে যে নীতি ঘোষণা করেছিলেন, তা আর এখন কার্যকর হওয়ার সুযোগ পাবে না। এর আগেই চীন-ইইউর এই চুক্তি আমেরিকাকে চিরদিনের জন্য পাশে ও বহু পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল।
এই ফাইনাল আলোচনায় ভার্চুয়ালি উপস্থিত ছিলেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং আর অপরপক্ষে ইইউর দুই প্রধান নেতা রাষ্ট্র জার্মান চ্যান্সেলর মার্কেল আর ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রো; আর এদের সাথে ছিলেন ইইউ কমিশন ও কাউন্সিলের প্রেসিডেন্টদ্বয়।
স্বাক্ষর শেষে ইইউ কর্তৃক চীনের প্রশংসাসূচক একটা শব্দই বহু কথাই বলে দিয়েছে। তা হলো, ইইউ এই চুক্তিকে চীনের দিক থেকে করা ‘অতুলনীয় এক প্রতিশ্রুতি’ বলে মনে করছে যা চীনে ইইউর বাণিজ্যকে নিশ্চয়তা ও আগাম বোঝা সম্ভব- এমন সব আস্থা দিবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com