তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনি -
ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ১৯৯২ সালে তার বহুল আলোচিত ‘দি এন্ড অব হিস্টরি’ গ্রন্থে ভবিষদ্বাণী করেছিলেন, পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্র সম্ভবত মানবজাতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিবর্তনের সর্বশেষ পর্যায়ে পৌঁছার ইঙ্গিত দিচ্ছে, এটাই হয়তো চূড়ান্ত ধরন। পূর্ব ইউরোপে একের পর এক দেশের সমাজতন্ত্রের জাল ভেদ করে বেরিয়ে আসা এবং সবশেষে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের জয়যাত্রার কথাই বলছিল।
আশা করা হচ্ছিল যে পৃথিবী থেকে যুদ্ধ, হানাহানির অবসান ঘটবে। জনগণের কথাই শেষ কথা। কিন্তু ওই বই প্রকাশের সিকি শতাব্দী পর দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। বিশ্ব বিবর্তিত হয়েছে ফুকুয়ামার বিপরীত গতিতে। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র নিয়ে যে জোশ ছিল, তা অনেকটাই উবে গেছে। এমনকি গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ অনেক দেশও এখন অন্য কিছু ভাবছে।
একই সাথে যুদ্ধ, হানাহানি অনেক বেড়েছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরুর শতবর্ষে এসে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, মাত্র ১১টি দেশ এখন যুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাব থেকে মুক্ত। মিলিয়ন নয়, বিলিয়ন নয়, ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার আর হাজার হাজার সৈন্যের রক্তেও আফগানিস্তান, ইরাকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য বিশ্ব। এখন পাশ্চাত্যেরই অনেক বলতে শুরু করছেন, সাদ্দাম হোসেন, মোয়াম্মার গাদ্দাফিদের শাসনই অনেক ভালো ছিল। তালেবান দমনের নামে আইএসের উত্থান ঘটানো হচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার দেশগুলো থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য একের পর এক যেসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, তাতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পদধ্বনিই শোনা যাচ্ছে। অনেকেই এখন আবার জার্মান সামরিক তাত্ত্বিক কার্ল ফন ক্লাউজেভিটসের (১৮৩২) কথাই স্মরণ করছেন : ‘রাজনীতি হলো যুক্তি, আর যুদ্ধ হলো স্রেফ একটা মাধ্যম, বিপরীতটা নয়।’ তার মতে যুদ্ধ হলো ‘বিকল্প পন্থায় পরিচালিত রাজনৈতিক কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।’
অন্য দিকে কার্ল মার্কসের বহুল কথিত উক্তি হচ্ছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে : ‘প্রথমবার ট্রাজেডি হিসেবে, দ্বিতীয়বার প্রহসন হিসেবে।’ তবে আমরা যদি বর্তমান সময় বিশ্লেষণ করি, আমরা কার্ল মার্কসের কথার যৌক্তিকতা অনুভব করতে কষ্ট হবে। আমরা একটা ট্রাজেডির পর যা দেখছি তা আগেরটির চেয়ে অনেক বেশি ট্রাজেডি। ১৯১৪ সালে সহিংসতা, কপটতা ও প্রবঞ্চনাই বিশ্বকে মহাযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমাদের চারপাশে কেবল এগুলোই দেখছি। যেসব অঞ্চল ওই যুদ্ধে সম্পৃক্ত ছিল, এখনও সেগুলো উত্তপ্ত রয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বদ্ধমূল ধারণা ছিল, মধ্য ইউরোপের সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা সামরিক উপায়ে সমাধান করা সম্ভব। অনেক রাজনীতিবিদই ১৯১৪ সালে ক্লাউজেভিটসের সাথে একমত হয়েছিলেন।
অধ্যাপক ডি. স্যাচসের মতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রমাণ করেছিল ক্লাউজেভিটস মর্মান্তিকভাবে আধুনিক সময়ের জন্য ভ্রান্ত। শিল্প যুগে যুদ্ধ মানে ট্রাজেডি, বিপর্যয় ও দুর্যোগ, এটা কোনো রাজনৈতিক সমাধান দেয় না। যুদ্ধ রাজনীতির ধারাবাহিকতা নয়, বরং রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চারটি সাম্রাজ্যের পতন ঘটিয়েছিল : প্রুসিয়ান (হহেনজোলার্ন) রাজবংশ, রুশ (রোমানভ) রাজবংশ, তুর্কি (উসমানিয়া) রাজবংশ এবং অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান (হাবসবার্গ) রাজবংশ। ওই যুদ্ধ কেবল লাখ লাখ লোকের প্রাণহানিই ঘটায়নি, বিপ্লব, রাষ্ট্রীয় দেউলিয়াত্ব, সংরক্ষণবাদ, আর্থিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছিল যার হাত ধরে হিটলারের উত্থান, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধ সৃষ্টি হয়।
আমরা এখনো ওই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাইনি। এক সময়ে যেসব ভূখণ্ডের সমন্বয়ে বহুজাতিক, বহুরাষ্ট্রিক, বহুধর্মীয় উসমানিয়া সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল, সেখানে আবারো সঙ্ঘাত আর যুদ্ধ বিস্তৃত হচ্ছে। লিবিয়া থেকে ফিলিস্তিন-ইসরাইল, সিরিয়া ও ইরাক উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে। ইসরাইল যে হিংস্রতা নিয়ে নির্দোষ নাগরিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে, তা হিটলারকেও হার মানায়। বলকান অঞ্চলে এখনো গুমোট ভাব রয়ে গেছে, রাজনৈতিক বিভক্তির অবসান ঘটেনি। বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা কার্যকর কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি, ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর বিমান হামলার ক্ষত থেকে সার্বিয়া সেরে ওঠেনি। ২০০৮ সালে কসোভো স্বাধীনতা ঘোষণা করলেও এখন পর্যন্ত তিক্ত বিরোধিতা কাটিয়ে ওঠতে পারেনি।
সাবেক রুশ সাম্রাজও এখন ক্রমবর্ধমান গোলযোগের শিকার হয়ে আছে। এখন সেখানে যা চলছে সেটাকে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের বিলম্বিত প্রতিক্রিয়া হিসেবে অভিহিত করা যায়। ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া, জর্জিয়া, মলডোভা এবং আশপাশের এলাকায় সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।
পূর্ব এশিয়ায় চীন ও জাপানের মধ্যে যে উত্তেজনা চলছে, সেটা আসলে গত শতকের জের। এখন সেখানে বিপদ বরং বাড়ছেই।
১০০ বছর আগে পরিস্থিতি ছিল এমনই। ব্যর্থ ও অজ্ঞ নেতারা ঘটনাস্থলের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রতিবেশগত সমস্যাগুলো উপলব্ধি না করে এবং সমাধানের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও বাস্তবসম্মত পন্থা ছাড়াই যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। অনেক সরকারই এখন আগে গুলি চালিয়ে পরে চিন্তা-ভাবনা করার পন্থা বেছে নিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কথাই ধরা যাক। আমেরিকার তেল সরবরাহপথ হুমকিগ্রস্ত হওয়া, ইসলামি মৌলবাদির আশ্রয়স্থল বা অন্য কোনোভাবেই যেকোনো ধরনের সমস্যাই (যেমন সোমালিয়া উপকূলে জলদস্যূতা) আমেরিকার স্বার্থে আঘাত করার ন্যূনতম শঙ্কা সৃষ্টি হলেও সে সৈন্য, ড্রোন বা যুদ্ধবিমান পাঠিয়ে দিচ্ছে। পরিণতিতে পশ্চিম আফ্রিকা থেকে লিবিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে মার্কিন সৈন্য, সিআইএ, ড্রোন ক্ষেপণাস্ত্র বা মার্কিন-সমর্থিত বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে রয়েছে। এতে লাভ কী হচ্ছে? একটা সমস্যার সমাধান তো হচ্ছেই না, বরং বিশৃঙ্খলা বাড়ছে, আরো বিস্তৃত যুদ্ধের হুমকি সৃষ্টি করছে।
রাশিয়াও এর চেয়ে ভালো পন্থায় কাজ করছে, তেমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অনেক সময় মনে হয়, রাশিয়া আন্তর্জাতিক আইনের সমর্থক। তারা যথার্থভাবেই অভিযোগ করে যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো কসোভো, ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়ায় আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে।
কিন্তু তারপর এই ভøাদিমির পুতিনই আবার ইউক্রেনের দিকে এগিয়ে যায় এই ভয়ে যে দেশটি পাশ্চাত্যের পকেটে চলে যাচ্ছে। ফলে হঠাৎ করে দেখা যায়, তিনি আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করার ব্যাপারে নীরব। তারপর তার সরকার অবৈধভাবে ক্রিমিয়াকে গ্রাস করে নেয়, পূর্ব ইউক্রেনে ক্রমবর্ধমান নৃশংস গেরিলা যুদ্ধে মেতে ওঠে।
এ প্রেক্ষাপটেই ইউক্রেনের আকাশে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ১৭-এর ভয়াবহভাবে বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাটি কেবল আতঙ্কিতই করে না, এটা এই আশঙ্কারই সৃষ্টি করে যে বিশ্ব বুঝি উন্মাদ হয়ে গেছে। এত দিন পরও জানা যায়নি কাদের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। অবশ্য রাশিয়া-সমর্থিত পূর্ব ইউক্রেন বিদ্রোহীদের দিকেই সন্দেহ ঘনীভূত হচ্ছে বেশি। তবে যা নিশ্চিত তা হলো, ইউক্রেনে পুতিনের লাগিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে শত শত নির্দোষ বেসামরিক লোক প্রাণ হারিয়েছে, বিশ্ব বিপর্যয়ের দিকে আরেক ধাপ এগিয়েছে।
বর্তমানে পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কোনো নায়ক নেই। সব পক্ষের মধেই কপটতা ব্যাপক মাত্রায় বিদ্যমান। জাতিসংঘের অনুমোদন ছাড়াই শক্তি প্রয়োগ করে যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করছে। অনধিকার চর্চা করে রাষ্ট্রটি বিভিন্ন স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশে ড্রোন ও গোপন বাহিনী পাঠাচ্ছে। তার গুপ্তচরেরা শত্র“-মিত্র নির্বিশেষে সবার ওপরই নজরদারি চালাচ্ছে। কেউ-ই নিরাপদ বোধ করছে না।
রাশিয়াও একই কাজ করছে। ইউক্রেন, জর্জিয়া ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে মৃত্যু ছড়াচ্ছে। পরাশক্তিগুলোর ব্যাপারে একটি কথাই সত্য, তা হলো তারা সহিংসতার আশ্রয় নিচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে রণসজ্জা বাড়ছেই। প্রতিটি দেশ তার সামরিক বাজেট বাড়াচ্ছে। অস্ত্রগুলো আরো শানিত, আরো বেশি ধ্বংসক্ষম করে তুলছে। কয়েকটি অঞ্চল অত্যন্ত স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকায় বিভিন্ন ইস্যুতে পাকিস্তান-ভারত, ভারত-চীন, চীন-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, জাপান-চীন মুখোমুখি অবস্থায় রয়েছে। বারুদের স্তুপ যেভাবে জমা হয়ে আছে, তাতে দিয়াশলাইয়ের একটি কাঠিই যথেষ্ট। এ ধরনের উত্তেজনা বেশি দিন সামাল দেওয়া যায় না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও এই অবস্থা চলতে চলতে হঠাৎই একটি দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বলে ওঠেছিল।
অবশ্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো অবস্থাই একেবারে পুরোপুরি বিরাজ করছে, তা নয়। ওই আমল এবং এখনকার বিশ্বের মধ্যে প্রধান পার্থক্য হচ্ছে চারটি। প্রথমটি হলো সূচনায়। সেই ঘটনার পর আমরা দুটি বিপর্যয়কর যুদ্ধ, একটি মহামন্দা এবং একটি স্নায়ুযুদ্ধ অতিবাহিত করেছি। মূর্খতা এবং পরিকল্পিত সামষ্টিক সহিংসতার অকার্যকারিতা নিয়ে দুই-একটি শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আমাদের সামনে এসেছে।
দ্বিতীয়টি হলো বর্তমানের পরমাণু যুগে পরবর্তী বৈশ্বিক যুদ্ধ নিশ্চিতভাবেই বিশ্বকে শেষ করে দেবে, এটা সবাই বোঝে।
তৃতীয় প্রধান পার্থক্য হলো এই যে দুর্দান্ত সব প্রযুক্তি আমাদের করায়ত্ত থাকায় দারিদ্র, ক্ষুধা, স্থানচ্যুতি ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফলে যেসব বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমরা সেগুলো সমাধান করার সামর্থ্য অর্জন করেছি। কাজে লাগানো হচ্ছে না, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
পরিশেষে, আমাদের আছে আন্তর্জাতিক আইন। আমরা এর প্রয়োগ করতে পারি। ১০০ বছর আগে ইউরোপ ও এশিয়ার যুধ্যমানেরা রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা সত্যিকার অর্থে অব্যাহত রাখার জন্য কূটনৈতিকভাবে সমাধানের জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যেতে পারতেন না। আর যাতে কখনোই বিশ্বযুদ্ধ না হয়, তা নিশ্চিত করতেই বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠেছে।
এই বিশ্বের নাগরিক হিসেবে আমাদের কাজ হলো কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে শান্তির দাবি জানানো এবং দারিদ্র, রোগ-বালাই ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের অভিশাপ থেকে মুক্তির জন্য বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা।
মানব ইতিহাসের অন্যতম বিপর্যয়ের শতবর্ষ এটা। আমাদের উচিত হবে এই ট্রাজেডিকে প্রহসন বা আরো বড় ট্রাজেডিতে পরিণত না করে বরং সহযোগিতা ও নম্রতা প্রদর্শনে উদ্বুদ্ধ করা। কিন্তু সেটা কে বোঝে?
(২০১৪ সালের প্রেক্ষাপটে)