এরিয়া ৫১ : যুক্তরাষ্ট্রের এক রহস্যজনক ঘাঁটি
এরিয়া ৫১ : যুক্তরাষ্ট্রের এক রহস্যজনক ঘাঁটি - ছবি : সংগৃহীত
ড্রিমল্যান্ড, প্যারাডাইস রেঞ্চ, হোম বেস ও ওয়াটার টাউন স্ট্রিপ। একই জায়গার চার-চারটি নাম? আপনি কি ‘এরিয়া ৫১’ নামে আমেরিকার কোনো জায়গার নাম শুনেছেন? যদি শুনে থাকেন, তাহলে জেনে রাখুন, আগের চারটি নামও আসলে এই এরিয়া ৫১-এরই অন্য নাম। মার্কিন বিমান বাহিনীর অত্যন্ত গোপনীয় এই ঘাঁটির অবস্থান আমেরিকার নেভাদা অঙ্গরাজ্যের দক্ষিণাঞ্চলে। যার আয়তন ২৬,০০০ বর্গ কিলোমিটার। ২০১৩ সালের আগে পর্যন্ত ওই জায়গা সম্পর্কে কারোর ধারণা ছিল না। ছিল না মানচিত্রে কোনো সুনির্দিষ্ট চিহ্ন। এমনকী, রাস্তার কোনও নকশাও ছিল না। যার কারণে গুগল ম্যাপেও ঠাঁই দিতে পারেনি গোপন সেই জায়গাটিকে। গোপনীয়তা রক্ষার্থে মার্কিন সরকার এতটাই তৎপর ছিল, যার কারণে সরকারি কাগজপত্র বা দলিলে এর সম্পর্কে কোনো তথ্যই রাখেনি তারা। নির্দিষ্ট বিমান ছাড়া আকাশসীমায় সামরিক বা অসামরিক কোনো ধরণের বিমান প্রবেশের অনুমতিও ছিল না। ওই ঘাঁটি ‘নো-ফ্লাই জোন’ হিসেবে সরকারিভাবে ঘোষিত ছিল। পাইলটরা এই এলাকার আকাশকে বলে ‘দি বক্স’ অথবা ‘দি কন্টেইনার’। এরিয়া ৫১ এমন এক সামরিক ঘাঁটি, যেখানকার কর্মীরা সরাসরি প্রেসিডেন্টের কাছে দায়বদ্ধ।
এরিয়া ৫১-এর মূল গেট ঘাঁটি থেকে প্রায় ২৫ মাইল দূরে অবস্থিত। ‘বুম গেট বা চেন লিঙ্কের বেড়ার মতো দুর্ভেদ্য বেষ্টনী ঘেরা এলাকার প্রবেশপথে লেখা আছে ‘সংরক্ষিত এলাকার দিকে প্রবেশের চেষ্টা করলেই তাকে গুলি করা হবে’। ‘ফটোগ্রাফি নিষিদ্ধ’ এলাকা। আমেরিকার সবচেয়ে রহস্যময় অঞ্চলটি গোপন সামরিক ঘাঁটি বলে কথা। বিভিন্ন অ্যাঙ্গেলে বসানো ক্যামেরা দিয়ে তারা দেখছে সবকিছু। অনেকে বলেন, এখানে চলার রাস্তায় নাকি সেন্সর রাখা আছে। ফলে প্রতিটি পদাঙ্কের শব্দ গুঞ্জিত হয় নিরাপত্তা রক্ষীদের কানে। ২০১৩ সালের ১৮ আগষ্ট সিআইএ রিপোর্টে ‘এরিয়া ৫১’ সম্পর্কে নথি প্রকাশের আগে পর্যন্ত আমেরিকান সরকার এরিয়াটি সম্পর্কে কোনও নথি বা তথ্য প্রকাশ করেনি। এখানে বর্তমানে ঠিক কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে, খোঁজ নিলে বড় জোড় আপনাকে কেউ বলবে যে, বিভিন্ন এয়ারক্রাফট ও ওয়েপন সিস্টেম নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এই ঘাঁটিতে। শুরু থেকেই গোপনীয়তার দুর্ভেদ্য চাদরে মোড়ানো এই এরিয়া ৫১ নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে দিনের পর দিন।
এরিয়া ৫১-এ যে আসলে কী আছে সেই সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা বেশ কম। এই কম ধারণা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে নানা কল্পনার শাখা-প্রশাখা। এই যেমন মাটির তলার বাঙ্কারটির কথা বলা যায়। কেউ কেউ বলেন, এরিয়া ৫১-এ মাটির নিচে নাকি বিশাল বাঙ্কার গড়ে তুলেছে মার্কিন সরকার। আর সেখানেও রয়েছে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক বিমানের আনাগোনা। সেই বিমানগুলোকে সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়, যাতে করে স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও সেগুলোর কোনো সন্ধান কেউ না পায়। কারো মতে, সেই বাঙ্কারগুলো নাকি ৪০ তলা ভবনের সমান উঁচু। মজা করে কেউ কেউ বলেন, এলিয়েনদের সেই স্পেসক্রাফটগুলো লুকিয়ে রাখা হয় পাহাড়ের নিচে। সেই বাঙ্কারের প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল দরজা যার ডিজাইন আশেপাশের মাটির মতোই করা। ফলে দূর থেকে দেখে একে পাহাড়ের অংশই ভাববে যে কেউ!
আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষের দিকে মার্কিন সেনাবাহিনী মেঘের পরিবর্তন করে বৃষ্টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কি না তা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিল। আবার ১৯৬২ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ‘ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর জন্য কাজ করেছিল, যদিও তাদের সেই গবেষণা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ থেকেই অনেকে ধারণা করে থাকে যে, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য এমন বিভিন্ন পরীক্ষাও চলে এরিয়া ৫১-এ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়টা খেয়াল করুন। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের মতিগতি, তারা কী নিয়ে গবেষণা করছে, তারা কোনো আকস্মিক হামলা করে বসবে কি না ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে বেশ উত্তপ্ত ছিল আমেরিকার রাজনীতিবিদদের মস্তিষ্ক। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান পাঠাত আমেরিকা। তবে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে সেগুলো ভূপতিত হওয়ার আশঙ্কা থাকত। অবশেষে ১৯৫৪ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার এক গোপন প্রোজেক্টের অনুমোদন করেন। সেই প্রোজেক্টের লক্ষ্য ছিল এমন যুদ্ধবিমান বানানো যেগুলো অনেক উচ্চতা থেকেও শত্রুপক্ষের বিভিন্ন বিষয়ে নজরদারি করতে পারবে। এই প্রকল্পের ফসল হিসেবেই পরবর্তীতে আমেরিকা তৈরি করেছিল ইউ-২ স্পাই প্লেন। এই প্লেনগুলোর চালনার প্রশিক্ষণ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য দরকার ছিল লোকালয় থেকে দূরবর্তী গোপন কোনও জায়গা। শেষ পর্যন্ত নেভাদা মরুভূমির দক্ষিণে গ্রুম লেকের কাছাকাছি এলাকায় সন্ধান মেলে পছন্দনীয় সেই জায়গার। এই জায়গাটিই আজ সকলের কাছে এরিয়া ৫১ নামে পরিচিত। ১৯৫৫ সালের জুলাই থেকে ইউ-২ স্পাই প্লেনের পরীক্ষামূলক ওড়া শুরু হয়। মজার ব্যাপার হল, এর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমেরিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ইউএফও’ দেখার দাবি করতে শুরু করে অনেকেই। এর পিছনের কারণটা অবশ্য বেশ মজার।
ইউএফও দেখতে পাওয়ার দাবি করা মানুষগুলোর বেশিরভাগই ছিলেন বাণিজ্যিক বিমানের পাইলট। সেই সময় বিমানগুলো সাধারণত ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়ত। মিলিটারি বিমানগুলো উড়ত আরও উঁচু দিয়ে। প্রায় ৪০,০০০ ফুট। অনেকেই ধারণা করত যে, ‘মানুষের তৈরি’ কোনও বিমান এত বেশি উঁচু দিয়ে উড়তে পারবে না! আর ঠিক এই জায়গাতেই লেগে গেল যত গোলমাল। কারণ, ইউ-২ প্লেনটি উড়ে যেত ৬০,০০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতা দিয়ে! ব্যাস, এখানেই মানুষের মনে ঢুকে গেলো অবিশ্বাস। কেউ কেউ বলা শুরু করে দিল, ‘এটা মানুষের বানানো হতেই পারে না। এটা অবশ্যই এলিয়েনদের বানানো কোনো ইউএফও!’ বিমানবাহিনীর শীর্ষকর্তারা অবশ্য জানতেন যে, ইউএফও দাবি করা জিনিসগুলো আসলে তাদের গোপন প্রোজেক্টের ইউ-২ স্পাই প্লেন। কিন্তু, এই সত্যটি জনসম্মুখে বলা নিষেধ ছিল। কারণ, এটি ছিল একটি টপ সিক্রেট প্রোজেক্ট। ফলে লোকমুখে ছড়াতেই থাকে ইউএফও দেখতে পাওয়ার ভিত্তিহীন দাবি।
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে ইউ-২ এর অপারেশন স্থগিত করা হলেও এরিয়া ৫১-এ চলতে থাকে অন্যান্য স্টেলথ এয়ারক্রাফট নিয়ে গবেষণা। এগুলোর মধ্যে ছিল A-12, Bird of Prey, F-117A এবং Tacit Blue। ফলে গুজবের ডালপালার বিস্তৃতি কখনই থেমে থাকেনি। এরপরই আসে ১৯৮৯ সালে বব লেজারের সেই বিষ্ফোরক মন্তব্য, যা সেখানে কাজ করা ইঞ্জিনিয়ারদের অনেকেই ভালোভাবে নেননি। লেজার বলেন, তিনি কিছুদিনের জন্য এরিয়া ৫১-এরই একটি অংশে কাজ করেছিলেন। যার নাম এস-৪। সেই জায়গাটি এতটাই গোপনীয় যে, ওই প্রজেক্টে তিনি এবং তার অন্য সহকর্মীদের যে বাসে করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তার জানালাগুলো বন্ধ ছিল। যাতে ইঞ্জিনিয়াররা যাতায়াতের রাস্তা মনে রাখতে না পারেন। এস-৪-এর বিমান ঘাঁটিতে লেজার এমন সব ফ্লাইং সসার দেখতে পেয়েছিলেন, যেগুলো কোনোভাবেই পৃথিবীতে তৈরি হতে পারে না বলে দাবি করেছিলেন। সেগুলোর শক্তি সরবরাহ করা হতো এন্টিম্যাটার রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে, জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হতো লালচে-কমলা বর্ণের একটি পদার্থ। যার নাম ‘এলিমেন্ট-১১৫’। সসারটি এতটাই শক্তিশালী গ্র্যাভিটি ওয়েভ তৈরি করছিল যে, সেটার দিকে কোনো গলফ বল ছুঁড়ে মারলে সেটাও ফিরে আসছিল! লেজারের মতে, সামরিক খাতে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে মার্কিন সরকার রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করছিল ইউএফও (আনআইডেন্টিফাইড ফ্লায়িং অবজেক্ট)!
ইউএফওর কথা যখন এসেছে, তখন অবধারিতভাবেই আরো একটি যে কথাটি আসে তা হলো এলিয়েন অর্থাৎ ভিনগ্রহের প্রাণী। আর এই ভিনগ্রহের প্রাণীদের নাকি জেলখানার বন্দির মতোই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এরিয়া ৫১-এ! বিতর্কে ছাইয়ের মধ্যে যেন বাতাস ছড়িয়ে দিলেন এরিয়া ৫১-র কর্মরত পদার্থবিজ্ঞানী লেজার। টিভি সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, একবার যখন তিনি এস ৪-এর একটি হলওয়ে ধরে যাচ্ছিলেন, তখন পাশের একটি ঘরের ছোট জানালা দিয়ে সামান্য সময়ের জন্য উঁকি দেন তিনি। তখন ঘরের ভিতরে ছোট, ধূসর বর্ণের একটি প্রাণীকে সাদা কোট পরিহিত দু’জন মানুষের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলেন তিনি! পরে অবশ্য তাঁর পিছন পিছন আসা প্রহরীর বকা খেয়ে সেখান থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। দুর্ভাগ্য বলতে হবে লেজারের। একবার বন্ধুদের নিয়ে তিনি লুকিয়ে সেসব সসারের টেস্ট ফ্লাইট দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে যান। এরপরই তার চাকরি চলে যায়। এরপর পত্র-পত্রিকায় নানা সময়ে রহস্যময় এই জায়গাটিকে কেন্দ্র করে নানা মুখরোচক খবর বের হলেও সেগুলোকে বরাবরই এড়িয়ে গিয়েছে মার্কিন প্রশাসন।
আসলে এরিয়া ৫১-এর কাজ এখনও বহাল তবিয়তেই চলছে। এখন নাকি এর সম্প্রসারণেরও কাজ হচ্ছে। তবে ভিতরে যে ঠিক কী নিয়ে কাজ চলছে তা নিয়ে বাইরের জগতে বসে অনুমান করা খুব কঠিন। আর অনুমান করলেও সেটা সঠিক কি না তা যাচাইয়ের কোনো উপায়ও নেই। প্রায় তিন দশক ধরে এরিয়া ৫১ নিয়ে গবেষণা করা এরোস্পেস ইতিহাসবিদ ও লেখক পিটার মার্লিন বলেছিলেন, এরিয়া ৫১-এ বর্তমানে উন্নততর স্টেলথ টেকনোলজি, অ্যাডভান্সড ওয়েপন, ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার এবং ইউএভি (আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল) নিয়ে কাজ হচ্ছে। আবার ইউ-২ বিষয়ক ইতিহাসবিদ ক্রিস পোককের মতে, এখন সেখানে বিশেষ ধরনের এয়ারক্রাফট, রেডিও কমিউনিকেশনের অত্যাধুনিক কোনও প্রযুক্তি, ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন এবং লেজার নিয়ে গবেষণা চলছে। কী মনে হয় আপনার? আপনি কি মনে করেন ইউএফও, এলিয়েন, ওয়ান-ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট নিয়ে কাজ চলছে এরিয়া ৫১-এ? নাকি মার্লিন, পোককের মতো ইতিহাসবিদদের কথাই সঠিক, যা বানচাল করে দেয় অনেকের স্বপ্নের ইউএফও আর এলিয়েনদের মনগড়া গল্প? কোনটা ঠিক— তা জানতে গোটা মার্কিন মুলুক ঘুরেও এক বর্ণ তথ্য পাবেন না। নিশ্চিত।
সূত্র : বর্তমান