বড় ধরনের বিপর্যয়ের দিকে নেপাল!
কে পি ওলি - ছবি : সংগৃহীত
নেপালের মন্ত্রিসভায় ২০ ডিসেম্বর দেশের পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি প্রস্তাব গৃহিত হয়। ওই দিন বিকেলেই প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি মন্ত্রিসভার প্রস্তাব অনুমোদন করেন এবং পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন। প্রেসিডেন্টের দফতর থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল ও ১০ মে দুই দফায় পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেয়া হয়।
এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের পেছনে প্রধানমন্ত্রী ওলির কারণ ছিল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টির (এনপিসি) প্রায় ১০০ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ওলিকে অপসারণ করে তার জায়গায় দলের আরেক নেতা পুস্প কমল দহল (প্রচন্ড)-কে বসানোর প্রস্তাব পেশ করেছিলেন।
পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার এই সিদ্ধান্তের প্রবল বিরোধিতা করছে নেপালের বিরোধীদলগুলো এবং সাতজন মন্ত্রী একযোগে পদত্যাগও করেছেন।
এনসিপি’র কেন্দ্রিয় কমিটির বৈঠক ডাকেন প্রচন্ড এবং সেখানে ওলিকে দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়। নেপালের দুই কমিউনিস্ট পার্টি যখন এক হয় তখন ওলির পক্ষ ছিল প্রভাবশালী। তবে ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রচন্ডের পক্ষ দলের কেন্দ্রিয় কমিটি ও সংসদীয় গ্রুপে প্রভাবশালী হয়ে ওঠে।
বর্তমানে কেন্দ্রিয় কমিটিতে প্রচন্ড ও মাধব কুমার নেপালের যে গ্রুপ রয়েছে তারা ৬৪%, আর ওলির গ্রুপ ৩৬%।
পার্লামেন্ট বিলুপ্তির বিরুদ্ধে দেশটিতে এখন বিক্ষোভ চলছে এবং ক্ষুদ্ধ লোকজন ওলির কুশপুত্তলিকা দাহ করছে।
ওলির পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার ক্ষমতা নেই বলে মনে করেন সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গৃহীত নতুন সংবিধানে বলা হয়েছে যে পার্লামেন্ট কোন প্রস্তাব গ্রহণ করতে ব্যর্থ হলেই কেবল প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্ট বিলুপ্তির প্রস্তাব করতে পারেন। এই মাপকাঠিতে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অধিকারী ওলির দল আসলে পার্লামেন্ট ভাঙ্গার প্রস্তাবই করতে পারে না।
পার্লামেন্ট বিলুপ্তির বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি পিটিশন এখন সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনাধীন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সুপ্রিম কোর্ট দুই সপ্তাহ সময় পাবে।
মনে হচ্ছে, নিকট ভবিষ্যতে নেপাল জুড়ে ওলির বিরুদ্ধে বড় বড় বিক্ষোভ হবে। আর সংবিধানবিরোধী কাজ করায় আরো অনেকে প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। সুপ্রিম কোর্ট বিষয়টি কিভাবে সুরাহা করে তা এখন দেখার বিষয়।
২০১৭ সালের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে দুই কমিউনিস্ট পার্টি – নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) ও নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (মাওয়িস্ট সেন্টার) ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দেয়। দুই দল নির্বাচনে জয়ী হয় এবং ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ওলি।
২০১৮ সালের মে মাসে দুই দল একীভূত হওয়ার ঘোষণা দেয়। আপসচুক্তি অনুযায়ী ওলি ও প্রচন্ড প্রধামন্ত্রীত্বের পাঁচ বছরের মেয়াদে ভাগাভাগি করে দায়িত্ব পালন করবেন বলে কথা ছিল। প্রায় তিন বছর হতে চললেও প্রচন্ডকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ দেননি ওলি। তিনি বরং ক্ষমতা আরো সুসংহত করছেন।
দুই নেতার মধ্যে বিরোধ ক্রমেই গভীর হয়ে সাম্প্রতিক সময়ে একেবারে সমঝোতার অযোগ্য অবস্থায় পৌছে গেছে। শোনা যাচ্ছে পার্লামেন্টে ওলির বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট পাস করাতে প্রচন্ড ও ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট-এর সাবেক নেতা মাধব কুমার নেপাল হাত মিলিয়েছেন।
নেপালের ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কোন্দল এখন জাতীয় সঙ্কটে পরিণত হয়েছে। এই কোন্দল দলটিতে ভাঙ্গন ধরাতে পারে।
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে নেপালে করোনা পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে। ৩ কোটি জনসংখ্যার দেশটিতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে প্রায় ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ। নেপালের অর্থনীতিতে করোনা পরিস্থিতির প্রভাবও গুরুতর। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে নেপালের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৯ সালের ৭.১% শতাংশ থেকে ২০২০ সালে ১.৫%-এ নেমে যেতে পারে। এর জন্য দায়ী রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, বাণিজ্য ও পর্যটনে স্থবিরতা ও মহামারি।
এক দশক গৃহযুদ্ধ দেখেছে নেপাল। ২০০৮ সালে দেশটি রাজতন্ত্র বিলোপ করে ফেডারের গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে রূপ নেয়। বহু বছর ধরে নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ধরনের গোলযোগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তীব্র দলীয় লড়াই, ঘন ঘন সরকার পরিবর্তন, গোলযোগপূর্ণ সামাজিক পরিস্থিতি ও ধীর অর্থনৈতিক উন্নয়ন এ্রর জন্য দায়ি। তাই স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি নেপালি জনগণের খুবই কাম্য।
আমি সাত বছরের বেশি সময় নেপালে কাজ করেছি এবং সামাজিক অশান্তির কারণে মানুষের দুর্দশা আমি দেখেছি। বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী হিসেবে চীন নেপালের পরিস্থিতির উপর ঘনিষ্ঠ নজর রাখছে এবং আশা করছে যে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট সব দলের সঙ্গে মতবিরোধ নিরসনে নেপাল সরকার স্বাধীনভাবে সংলাপ ও আলোচনা করবে। নেপালের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন, জাতীয় ঐক্য, সামাজিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের মৌলিক স্বার্থ রক্ষা জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে।
(চেং শিঝোং সাউথওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি অব পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাণ্ড ল’-এর ভিজিটিং প্রফেসর, চারহার ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো, দক্ষিণ এশিয়া দেশগুলোর সাবেক প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে, এবং চায়না শিল্ড কনসাল্টিং সার্ভিস কো. লিমিটেডের নির্বাহী উপদেষ্টা।)
সূত্র : এসএএম