কেমন আছে থাইল্যান্ডের মুসলিমরা?
কেমন আছে থাইল্যান্ডের মুসলিমরা? - ছবি সংগৃহীত
বিশ্বজুড়ে চলমান অত্যাচারিত জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোর মধ্যে দক্ষিণ থাইল্যান্ডের মালয় মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক বিস্মৃত কাহিনী। ২০০৪ সালে শুরু হওয়া এই সহিংসতা আন্দোলনের জন্ম আরো ১০০ বছর আগে। আর গত দেড় দশক ধরে চলার পরও দক্ষিণ থাইল্যান্ড এখনো শান্তির সুবাতাস ফিরে পায়নি।
১৯০৯ সালের ইঙ্গ-শ্যামীয় চুক্তির মাধ্যমে তৎলীন ব্রিটিশ উপনিবেশ মালয়া ও শ্যামদেশ অর্থাৎ বর্তমান মালয়শিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যকার সীমানা নির্ধারণ করা হয়। ফলে মালয়শিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় মালয় জাতির রাজ্য পাতানি দক্ষিণ থাইল্যান্ডের অংশে পরিণত হয়। বর্তমান থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলীয় নারাথিওয়াত, ইয়ালা, পাত্তানি ও সংখলা প্রদেশ ছিল এই ঐতিহাসিক পাতানি রাজ্যের অংশ। এদের মধ্যে নারাথিওয়াত (৮২%), ইয়ালা (৭২%) ও পাত্তানি (৮৮%) মালয় ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। সংখলা প্রদেশে যদিও মুসলিমরা সংখ্যালঘু, তবে তাদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য (৩৩%)। ইয়ালা, পাত্তানি ও সংখলার একাংশ থাই বৌদ্ধ-মালয় মুসলিম মিশ্র এলাকা। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দক্ষিণী প্রদেশ সাতুন, ত্রাং, ক্রাবি, ফুকেত, ফাং ঙা, রানোং ইত্যাদিতেও বিপুলসংখ্যক মুসলিম আর/বা মালয় বংশোদ্ভূত মানুষের বসবাস। রাজধানী ব্যাংককেও মালয় সম্প্রদায় রয়েছে, যারা মূলত অতীতে নির্বাসিত বা সম্প্রতি অভিবাসী হিসেবে এসেছে। সাতুন প্রদেশ থাইল্যান্ডের চারটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (৭৬%) প্রদেশের একটি হলেও মালয় জাতির লোক এখানে সংখ্যালঘু (৯%)। সাতুনের মুসলিমরা বেশির ভাগই সাম-সাম বা থাই-মালয় মিশ্রজাতির লোক। তাদের মাতৃভাষাও অন্য থাইদের মতো দক্ষিণী থাই উপভাষার অংশ। সাতুনের স্থানীয় মালয়রাও ভাষাগত ও সাংস্কৃতিকভাবে পাতানি নয়, বরং তাদের দক্ষিণে মালয় অঞ্চল কেদাহের সাথে সংশ্লিষ্ট। থাইল্যান্ডের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি কোনো ধরনের বিরাগ বা বিদ্বেষও সাতুন প্রদেশে বিরল।
পাতানি রাজ্য ঐতিহাসিকভাবে মালয় জাতির বাসভূমি হওয়ায় স্থানীয় মালয়রা দক্ষিণে অন্য মালয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখত। কিন্তু স্থানীয় রাজারা বহু দিন ধরে আনুগত্য প্রকাশ করে ভেট পাঠাতেন মধ্য-দক্ষিণ থাইল্যান্ডের শ্যাম রাজ্য আয়ুথায়ার রাজার দরবারে। একপর্যায়ে পাতানির মালয় রাজা আয়ুথায়ার থাই রাজার আনুগত্য অস্বীকার করলে ১৭৮৫ সালে আয়ুথায়া পাতানি আক্রমণ করে দখল করে নেয়। ১৮১৬ সালে ‘বিভেদ ও শাসন নীতি’ অনুসরণ করে আয়ুথায়া রাজা পাতানিকে সাতটি প্রদেশে বিভক্ত করে। ১৮২৬ সালে বার্নি চুক্তির মাধ্যমেব ব্রিটিশ সরকার পাতানিসহ মালয়ার আরো চারটি প্রদেশে থাই রাজার কর্তৃত্ব স্বীকার করে নেয়। ১৯০১ সালে পাতানি অঞ্চলকে আবারো একত্রিত করা হয়। ১৯০৯ সালের চুক্তিতে পাতানি ছাড়া বাকি রাজ্যগুলো আবারো ব্রিটিশ তথা মালয়ার অধীনস্থ হয়, যদিও কেদাহ রাজ্যের অংশবিশেষ নিয়ে সাতুন প্রদেশ গঠিত হয়।
শ্যাম রাজার অধীনে থাকার পরও পাতানির স্থানীয় শাসকরা কার্যত স্বাধীনভাবেই নিজ এলাকা পরিচালনা করতেন। এ কারণেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মালয়দের ধর্মীয় আইন অনুসরণের ক্ষেত্রে ‘থাই নাগরিক আইন’ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। কিন্তু ১৯৩২ সালের বিপ্লব নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের পতনের পর থাইল্যান্ডে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের জন্ম হয়। ১৯৩৩ সালের সেনাভ্যুত্থানের পর থাইল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী সামরিক সরকার নাতসি-ফ্যাসিবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশজুড়ে থাইকরণ কর্মসূচি গ্রহণ করে। মালয় মুসলিমরাও এর শিকার হয়। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে ১২টি অধ্যাদেশ-সংবলিত ‘জাতীয় সাংস্কৃতিক আইন’ জারি করা হয়। এর মধ্যে তৃতীয় অধ্যাদেশে থাইল্যান্ডে বসবাসকারী সকল জাতি ও ধর্মের লোককে ‘থাই’ নাম গ্রহণ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ফলে মালয় মুসলিমরা ‘মালয়’ বা ‘মুসলিম’ নাম ব্যবহার করা থেকে বঞ্চিত হয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে মালয় ভাষার পরিবর্তে থাই ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। ইসলামী আদালতের পরিবর্তে নাগরিক আদালতের প্রবর্তন করা হয়। ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই মালয় জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দেয় পাতানিতে। বামপন্থী মানসিকতার এই রাজনৈতিক দল ও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রধান দাবি ছিল বিচ্ছিন্নতাবাদ। আর এই উদ্দেশ্য পূরণে তারা সহিংসতার আশ্রয় নিতেও পিছপা হয়নি।
কিন্তু ২০০১ সালের পর পাতানির সশস্ত্র সংগ্রাম নতুন মাত্রা নেয়। ৯/১১-এর পর থেকে বিশ্বজুড়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ শুরু হলে পাতানির মালয় মুসলিমদের মধ্যে ইসলামী জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দেয়। ফলে দক্ষিণ থাইল্যান্ডে বিচ্ছিন্নতাবাদ ইসলামীকরণের শিকার হয়। আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একাধিক নতুন সশস্ত্র উগ্রবাদী দলের আবির্ভাব হয় পাতানি অঞ্চলে। আগে মালয় জাতীয়তাবাদীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু সালাফি-উগ্রবাদী সন্ত্রাসীদের মূল লক্ষ্য ইসলামী খিলাফত স্থাপন।
২০০৪ সালে প্রকাশ্যে সহিংসতা শুরু হলে সরকার দক্ষিণ থাইল্যান্ডে সেনা অভিযান শুরু করে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে তা অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রাম দমনে কৌশলগত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার অভাব এবং পুলিশ-সেনাবাহিনী মধ্যে সমণ্বয়তার ঘাটতি সেনা অভিযানের কার্যকারিতাকে হ্রাস করে দিয়েছে। সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সরকার ও সেনাবাহিনীর বাড়াবাড়ি রকম প্রতিক্রিয়ার নীতি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য সহায়ক হয়েছে। কারণ এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত জনসাধারণ সেনাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হচ্ছে এবং সন্ত্রাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়ছে। স্থানীয় সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে অস্বীকার করে থাই সেনারা বিদ্রোহে পরোক্ষভাবে ইন্ধন যুগিয়েছে। পুলিশের প্রতি সেনাবাহিনীর অবজ্ঞাসূচক আচরণ সেনা-পুলিশ দ্বন্দ্বকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সেনাবাহিনীর অভিযোগ, অবৈধ মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে আঁতাত রয়েছে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের।
২০০৫ সালের জুলাইতে প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা সহিংসতা দমনে জরুরি অবস্থাকালীন ব্যাপক বিশেষ ক্ষমতা হাতে নেন। কিন্তু সহিংসতা দমানো সম্ভব হয়নি। ২০০৬ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর সামরিক জান্তা বিদ্রোহীদের ‘মন জয় করা’-র কর্মসূচি গ্রহণ করে। ২০০৮ সালে জান্তা সরকার ঘোষণা দেয়, শিগগিরই পাতানিতে শান্তি ফিরে আসবে। কিন্তু সহিংসতা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পায়। ২০১০ সালে অবিসিত্ ভেজ্জাজিভার সরকার দক্ষিণে শান্তি ফিরে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে। কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকান্ড অব্যহত থাকায় ২০১১ সালে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যর্থতার দায় স্বীকার করা হয়।
স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, পাতানি অঞ্চলকে কিছুটা হলেও স্বায়ত্ত্বশাসন দিতে হবে। একাধিক সশস্ত্র গোষ্ঠী শান্তি আলোচনার জন্য নানা শর্ত দিয়েছে।