করোনার এসব তথ্য জানেন কি?
করোনাভাইরাস - ছবি : সংগৃহীত
গত বছর ৩০ ডিসেম্বরে করোনাভাইরাসের কথা প্রথম জানিয়েছিলেন উহান সেন্ট্রাল হাসপাতালের চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ লি ওয়েনলিয়াং। তিনি বলেছিলেন, সারস-এর মতো ফুসফুসের সংক্রমণ ঘটছে।
সামাজিক মাধ্যম উই চ্যাটে অন্য হাসাপাতালের সহযোগী চিকিৎসকদের এই খবর দিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ তারপর লি-র বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে এবং অভিযোগ করে, তিনি মিথ্যা কথা বলেছেন। পরে অবশ্য তিনি অভিযোগমুক্ত হন।
গত ২ ফেব্রুয়ারি করোনায় আক্রান্ত হয়ে লি-র মৃত্যু হয়।
শুরু হলো করোনাভাইরাসের তাণ্ডব
গত জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে চীনা কর্মকর্তারা প্রথমবার জানান, উহানে একটা নতুন ধরনের ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়েছে।
এখন ২০২০-র শেষ লগ্নে বিশ্ব জুড়ে আট কোটি মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। জার্মানিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ লাখের বেশি।
প্রতিবেদনে এই ভাইরাস সম্পর্কে, তার প্রতিষেধক সম্পর্কে জানানো হলো।
ভাইরাসের উৎপত্তি
যখন এই ভাইরাস সম্পর্কে প্রথম জানানো হয়, তখন বলা হয়, কোনো মেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে তা এসেছে। তবে এই ঘোষণার বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই ভাইরাস মানুষকে আক্রমণ করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
প্রাথমিকভাবে চীনা কর্তৃপক্ষ এই ভাইরাস নিয়ে তথ্য চাপার চেষ্টা করেছে। এটা এখনো পরিস্কার নয়, কবে, কোথায় এই ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রথম আসে। বাদুর বা কুকুর থেকে এই ভাইরাস এসেছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। যার প্রকোপে এখনো নাজেহাল পুরো বিশ্ব।
তবে গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, এই ভাইরাস ২০১৯ সালের গরমের সময় ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
ভাইরাসের বিশ্লেষণ
চীনের ভাইরোলজিস্টরা রেকর্ড সময়ে এই ভাইরাস সম্পর্কে জেনেটিক তথ্য বের করেন। ২১ জানুয়ারি তাঁরা এই ভাইরাসের জিনের গঠন সম্পর্কে তথ্য প্রকাশ করেন। তার তিনদিনের মধ্যে তাঁরা এই ভাইরাসের জিন নিয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেন। এরপর শুরু হয় বিশ্বজুড়ে ওষুধ ও প্রতিষেধক তৈরির কাজ।
এই ভাইরাসের সারফেসে স্পাইক প্রোটিন(এসিই-২) আছে। এটাই ভাইরাসের মূল কোষকে বেঁধে রাখে। তাই যে সব প্রতিষেধক বের হয়েছে বা যে সব ওষুধ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে, তা এই প্রোটিনকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার চেষ্টা করছে।
ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া
জার্মানিতে এই ভাইরাসের প্রথম হটবেড ছিল হেইনসবার্গ। সেখানে সমীক্ষায় দেখা গেছে, এই ভাইরাস প্রথমে গলা ও ফুসফুসকে আক্রমণ করে। ঘটনা হলো, আক্রান্ত মানুষের কাছ থেকে বা কোনো জায়গায় যেখানে ভাইরাস আছে, সেখানে হাত দিলে, সেখান থেকে অন্যের মধ্যে ভাইরাস ছড়ায়। এ সি বা বাতানুকূল ব্যবস্থায় ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে পারে। বিশেষ করে মিট ইন্ডাস্ট্রিতে যে ধরনের বাতানুকূল ব্যবস্থা আছে, তার মাধ্যমে ভাইরাস দ্রুত ছড়াতে পারে।
একটা বদ্ধ ঘরে প্রচুর মানুষ মানে এই ভাইরাসের ছড়ানোর সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া। সে জন্য প্রায় প্রতিটি দেশই লকডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং মানুষকে বাড়িতে থাকতে বলেছিল। ট্রেড ফেয়ার সহ সব ধরনের মেলা, আলোচনাচক্র, সামাজিক অনুষ্ঠানে রাশ পড়েছিল। এ সবই করা হয়েছিল, করোনার প্রকোপ কমানোর জন্য।
মুখ ও নাক ঢেকে রাখার জন্য ফেস মাস্কের ব্যবহার প্রতিটি দেশই শুরু করেছে। তবে চিকিৎসকদের একটা অংশ প্রাথমিকভাবে মাস্ক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁদের সন্দেহ ছিল, সব মানুষ এই মাস্ক পরে প্রতিদিন বাইরে বেরোবেন কি না। তবে প্রায় সব দেশের অধিকাংশ মানুষই মাস্ক পরা মেনে নিয়েছেন।
তবে সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো হাত ধোয়া এবং অন্য মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা।
মানুষের থেকে পোষা জন্তুর কাছে করোনা ভাইরাস গেছে এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিন্তু পোষা প্রাণী থেকে মানুষের করোনা হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে অনেক দেশেই মিংক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং লাখ লাখ মিংককে মেরে ফেলা হয়েছে।
করোনার লক্ষণ ও ঝুঁকি
প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছিল, ফ্লু-র থেকে করোনা বেশি মারাত্মক নয়। কিন্তু এখন চিকিৎসকরা উল্টো কথা বলছেন। ১৯১৮ সালে যে ভয়াবহ স্প্যানিশ ফ্লু হয়েছিল, করোনা ভাইরাস সেরকমই মারাত্মক। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাদের কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি, তবে অনেকেই প্রবলভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
যাঁদের অন্য রোগ আছে, বয়স্ক মানুষ, যাদের ব্লাড গ্রুপ এ, তারা করোনায় বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। হাই ব্লাড প্রেসার, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, কিডনির অসুখ, লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ থাকলে করোনা তাদের ক্ষেত্রে মারাত্মক হয়ে ওঠে। যুবক থেকে শুরু করে যেকোনো মানুষই করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন।
মৃদু করোনার লক্ষণ অনেকটা সর্দি লাগার মতো। গলা খারাপ হবে, স্বাসকষ্ট হবে, গন্ধ পাবেন না, স্বাদও চলে যাবে। করোনা প্রবল হলে বিভিন্ন অঙ্গ কাজ করা বন্ধ করে দেয় এবং জীবন সংশয় হয়। একজন মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা কতটা ভালো তার উপরেই নির্ভর করে করোনার প্রাবল্য কতটা হবে।
চিকিৎসা
এই অতিমারি ছড়ানোর সময় অনেকেরই প্রবল শ্বাসকষ্ট হয় এবং যান্ত্রিকভাবে তাঁদের শ্বাসপ্রশ্বাস চালু রাখা হয়। অনেকে মারা যান।
এখন চিকিৎসার ধরণ বদলেছে।বলা হচ্ছে, এভাবে চিকিৎসা করলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে পারে। এখন বলা হচ্ছে, যতক্ষণ পর্যন্ত রোগীরা নিজে থেকে নিঃশ্বাস নিতে পারছেন, ততক্ষণ ঠিক আছে। খুব জরুরি পরিস্থিতিতে তাঁদের অক্সিজেন দেয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে করোনা ভাইরাস কিডনির ক্ষতি করে। তখন রোগীকে ডায়ালেসিস দিতে হয়। ইনটেনসিভ কেয়ারে সেই সব ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
অনেক জায়গায় যাদের করোনা হয়ে সেরে গেছে, তাদের শরীর থেকে অ্যান্টিবডি নিয়ে অন্য রোগীকে দেয়া হচ্ছে। সেই অ্যান্টিবডি তখন ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করছে।
নিয়ম হলো, যার একবার করোনা হয়েছে., তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে শারীরিক পরীক্ষা করাতে হবে ও চিকিৎসার মধ্যে থাকতে হবে। আগে তাঁর কোনো অসুখ থাকলে তার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। করোনা কোনো অঙ্গের ক্ষতি করছে কি না, সেটাও দেখতে হবে।
কোনো ওষুধ নেই
রেমডেসিভির হলো একমাত্র ওষুধ যা দিয়ে করোনা-কালকে ছোট করা যেতে পারে বলে দাবি করা হয়।
কিন্তু এই ওষুধ করোনা সারাতে পারে না। এই ওষুধ নিলে দিন কয়েক আগে করোনা মুক্তি ঘটতে পারে এই মাত্র। কিন্তু এই ওষুধ নিলে করোনা আক্রান্ত বেঁচে যাবেন, এমন নয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই ওষুধ ব্যবহারের বিরুদ্ধে।
চিকিৎসকরা বাজার চলতি অন্য অনেক ওষুধ নিয়ে পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু সফল হননি। কিছু ওষুধে তো উল্টো বিপত্তি দেখা দিয়েছে।
ভ্যাকসিন
ডিসেম্বরে ইইউ ও অ্যামেরিকায় প্রথম ভ্যাকসিন আসে। ২০২১ সালে আরো অনেক ভ্যাকসিন বাজারে আসবে।
বিপুল সংখ্যায় ভ্যাকসিন তৈরি করা এবং তার প্রচার হলো বড় চ্যালেঞ্জ। জিন ভিত্তিক আরএনএ ভ্যাকসিন দ্রুত উৎপাদন করা যেতে পারে। তবে ২০২২-এর আগে সকলের জন্য ভ্যাকসিনের কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
এখন বিশ্বজুড়ে অন্ততপক্ষে ২১৪টি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব। জার্মানির গবেষক সংস্থার দাবি ২২৭টি ভ্যাকসিন তৈরির কাজ চলছে। বায়োনটেক ও মডার্নার ভ্যাকসিন হলো আরএনএ ভ্যাকসিন।
টিবি-র জন্য একটি ভ্যাকসিন আছে। সেটা নেয়ার পরামর্শও দেয়া হচ্ছে। এই ভ্যাকসিন করোনা রোধ করতে পারে না। তবে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে।
কীভাবে হার্ড ইমিউনিটি হয়?
বিশ্ব জুড়ে আরো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন। এই বছরের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ কোটি ছাড়াবে। বিশ্বের জনসংখ্যা এখন ৭৮০ কোটি। এই রোগের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতে অনেক দূর যেতে হবে।
একবার করোনায় আক্রান্ত রোগীদের আর এই রোগ হবে কি না, তা স্পষ্ট নয়। নিয়মিত পরীক্ষা করে জানা যেতে পারে, অ্যান্টি বডি শরীরে আছে কি না।
সূত্র : ডয়চে ভেলে