তুরস্ককে প্রতিরোধ করা কেন সহজ হবে না?
এরদোগান - ছবি সংগৃহীত
তুরস্ককে আটকে রাখার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণের কাজ নানা কারণে সহজ সমীকরণ হবে না। প্রথমত, তুরস্ক ন্যাটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক শক্তি। সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে অপারমাণবিক শক্তির দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দেশটি। দ্বিতীয়ত, তুরস্কের ভূরাজনৈতিক অবস্থান ইউরোপ-এশিয়ার সংযোগস্থলে। দেশটি একসময় এশিয়ার বিশাল একটি অংশের পাশাপাশি প্রায় অর্ধেক ইউরোপ শাসন করেছে। প্রথম মহাযুদ্ধের ‘পরাজিত’ শক্তি হিসেবে তুর্কি খেলাফতের রাষ্ট্রগুলোকে বিচ্ছিন্ন, উপনেবিশীকরণ এবং ‘স্বাধীন’ দেশে পরিণত করা হয়। তুর্কি বংশোদ্ভূত জাতিগোষ্ঠীও অনেকগুলো স্বাধীন দেশে বিভক্ত হয়ে আছে। এই নৃতাত্ত্বিক যোগসূত্রও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তৃতীয়ত, তুরস্কের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ ও অর্থনৈতিক বিকাশকে যে চুক্তির অধীনে সীমিত করে ফেলা হয় সেই ‘লুজান চুক্তি’র ১০০ বছর মেয়াদ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। শতক পার হলে চুক্তি কার্যকর করার জন্য নবায়ন করতে হয়। এর অর্থ অবশ্য এই নয় যে, লুজান চুক্তির অধীনে যে ভূখণ্ড স্বাধীনে রাষ্ট্রে পরিণত রয়েছে সেসব দেশ আবার তুরস্কের অংশ হয়ে যাবে। তবে বসফরাস প্রণালী থেকে রাজস্ব আহরণ অথবা ভূমধ্যসাগরের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে যে বাধা বিপত্তি সেগুলো আর নাও থাকতে পারে। চতুর্থত, জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও সামরিক শক্তি দিয়ে যে কোনো দেশ যেভাবে প্রতিপত্তিশালী হয়ে ওঠে, সেসব ক্ষেত্রে তুরস্কের তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি হয়েছে। জ্ঞানবিজ্ঞান প্রযুক্তিতে ও শিক্ষা গবেষণায় দেশটির অর্জন ইউরোপের শীর্ষ দেশগুলোর সাথে তুলনীয়। অন্য দিকে, তুরস্কের আবিষ্কৃত সামরিক ড্রোন যুদ্ধক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
এর মধ্যে সিরিয়ার শরণার্থীদের জন্য দেশটিতে একটি নিরাপদ অঞ্চল গঠন এবং আইএস ও কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী হুমকি দূর করার ক্ষেত্রে সাফল্য পেয়েছে আঙ্কারা। লিবিয়ায় খলিফা হাফতার বাহিনী কর্তৃক জাতিসঙ্ঘ সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে অভিযান ব্যর্থ হয়েছে তুর্কি সহায়তায়। সর্বশেষ। আজারবাইজান ৩০ বছর পর নাগরনো কারাবাখ অঞ্চল আর্মেনিয়া থেকে ফিরে পেয়েছে তুরস্কের সামরিক সহায়তায়।
অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তুরস্কের একেপি সরকার ২০০২ সাল থেকে একনাগাড়ে ক্ষমতায় রয়েছে। একেপি প্রথমবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর থেকে তাদের ভোটের অংশীদারিত্ব বেড়েছে। রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে এ দলের রাজনৈতিক প্রভাব বেড়েছে বিশেষভাবে। সর্বশেষ, ২০১৬ সালে গুলেন মুভমেন্টের সমর্থনে সামরিক অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে একেপিকে প্রতিরোধ করার মতো শক্তি দুর্বল হয়ে যায়।
এসব বাস্তবতার কারণে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান বা তার দর্শনকে অপছন্দ করলেও তুরস্কের অখণ্ডতা ও জাতিগতভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়াকে যারা পছন্দ করেন, তারা এরদোগানের রাজনীতির বিরোধিতা করতে পারছেন না। সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজাইবাইজানে তুরস্কের সামরিক ভূমিকার বিষয়টি সংসদে নিরঙ্কুশভাবে পাস হয়েছে। এমনকি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সাথে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের যে টানাপড়েন দেখা দেয়, সে ক্ষেত্রে তুর্কি রাজনৈতিক দলগুলো ফ্রান্সকে সমর্থন করেনি।
এ ধরনের একটি অবস্থায় রাশিয়ার সাথে একটি ন্যাটো সদস্য দেশ হিসাবে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় যে চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেটি এরদোগান জানতেন। কিন্তু তিনি এও জানতেন, ন্যাটোর অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশগুলোর অঙ্গীকার তুরস্কের অখণ্ডতা ও নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশ্নাতীত নয়। কুর্দি দল পিকেকের সিরীয় মিত্রকে সমর্থন দিয়ে তাদের বড় এক সিরীয় ভূখণ্ডে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুযোগদানের পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা তুরস্ককে সরবরাহে অস্বীকৃতি ও এস৩৫ বিমান অগ্রিম অর্থ নেয়ার পরও সরবরাহ না করা আর সে দেশে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে গোপন মদদ তুর্কি নেতৃত্বকে ন্যাটোর নেতৃস্থানীয় দেশ, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সন্দিহান করেছে। তুর্কি বিমানবাহিনীর আঘাতে দুটি রুশ বিমান ভূপাতিত হওয়ার ঘটনায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হলে ন্যাটোর পক্ষ থেকে তুরস্ক কাক্সিক্ষত সহযোগিতা পায়নি।
এসব কারণে এরদোগান ন্যাটো জোট ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ওপর একক নির্ভরতাকে দেশটির নিরাপত্তার জন্য কল্যাণকর মনে করেননি। ফলে রাশিয়া এবং ক্ষেত্র বিশেষে চীনের সাথেও সম্পর্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে নতুন পরিস্থিতিতে উত্তেজনা বা বৈরিতাকে বাড়তে দেয়া আঙ্কারার কৌশলগত সমীকরণের জন্য ইতিবাচক হবে বলে মনে হয় না।