করুণ মৃত্যু হয়েছিল মাউন্টব্যাটনের
স্ত্রীর সাথে লর্ড মাউন্টব্যাটন - ছবি সংগৃহীত
ভারতবর্ষের বিভক্তি তথা ভারত ও পাকিস্তান নামে আলাদা রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের সাথে জড়িয়ে আছে লর্ড মাউন্টব্যাটনের নাম। তার বর্ণময় জীবন নিয়ে আলোচনার শেষ নেই। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেনের মৃত্যুও রহস্যাবৃত। কম চর্চিত সেই দিক নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে ওয়েবসিরিজ ‘দ্য ক্রাউন’-এর পঞ্চম সিজনে। আততায়ীর হাতে তার রহস্যমৃত্যুতে পৌঁছনর আগে আসুন ফিরে যাই গোড়ার কথায়।
ব্রিটিশ রাজপরিবারের শাখায় জন্মগ্রহণ করা মাউন্টব্যাটেনের পরিচয় বহু। তার সম্পূর্ণ নাম লুই ফ্রান্সিস অ্যালবার্ট ভিক্টর নিকোলাস মাউন্টব্যাটেন। আর এক পরিচয় ‘ফার্স্ট আর্ল মাউন্টব্যাটেন অব বর্মা’। ইংল্যান্ডের বার্কশায়ারের ফ্রগমোর হাউসে ১৯০০ সালের ২৫ জুন ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় তার নাম ছিল ‘প্রিন্স লুই অব ব্যাটেনবার্গ’।
তাঁ বাবার নামও ছিল ‘প্রিন্স লুই অব ব্যাটেনবার্গ’। মা ছিলেন প্রিন্সেস ভিক্টোরিয়া। জন্মসূত্রে তিনি রানি দ্বিতীয় ভিক্টোরিয়া এবং যুবরাজ ফিলিপের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। প্রিন্স চার্লস তথা মূল ব্রিটিশ রাজপরিবারের তিনি খুবই ঘনিষ্ঠ। নিকোলাস থেকে তাঁর ডাকনাম ছিল ‘নিকি’। কিন্তু নিকোলাস তথা নিকি নাম রুশ জারতন্ত্রে আগে বহু ছিল। তাই প্রমাতামহী রানি ভিক্টোরিয়ার পরামর্শে তার নাম ‘নিকি’ থেকে করা হয় ‘ডিকি’।
ব্রিটিশ রাজনীতিকের পাশাপাশি লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন নৌবাহিনীর অফিসার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাউথ ইস্ট এশিয়া কম্যান্ডের তিনি ছিলেন সু্প্রিম অ্যালায়েড কম্যান্ডার। পরাধীন ভারতের শেষ ভাইসরয় তথা স্বাধীন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন ছিলেন ক্রাইস্ট কলেজের ছাত্র। ১৯১৬ সালে ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি-তে যোগদানের আগে তিনি প্রশিক্ষণ নেন ওসবোর্নের রয়্যাল নেভাল কলেজে।
১৯২২ সালের ১৮ জুলাই মাউন্টব্যাটেন বিয়ে করেছিলেন ব্রিটিশ অভিজাত পরিবারের তরুণী এডুইনা সিন্থিয়া অ্যানেট অ্যাশলেকে। তাদের দুই মেয়ের নাম প্যাট্রিসিয়া এবং প্যামেলা। মাউন্টব্যাটেন-এডুইনার বিয়ে এবং দাম্পত্য ছিল সারা বিশ্বেই চর্চিত। লেডি মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পরলোকগত জওহরলাল নেহরুর সম্পর্ক নিয়ে বহু আলোচনা হয়ে আসছে গত সাত দশকের বেশি সময় ধরে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের জীবনেও বিয়ের পরে এসেছেন একাধিক নারী। ফরাসি অভিজাত এবং ধনী পরিবারের নারী ইয়োলা লেতেলিয়েরের সঙ্গে ৭ বছর ধরে প্রেমের সম্পর্কে ছিলেন তিনি। ১৯৬০ সালে পরলোকগত হন এডুইনা। তার পরে মাউন্টব্যাটেনের জীবনে এসেছিলেন এক তরণী। তার একাধিক সম্পর্ক নিয়ে বলেছেন একদা ঘনিষ্ঠ কর্মচারীরা। এমনকি, মেয়ে প্যাট্রিসিয়াও জানতেন বাবার বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কের কথা।
১৯৪৮ সালে মাউন্টব্যাটেন যখন মাল্টায় ছিলেন, সে সময় তার গাড়িচালক ছিলেন রন পার্কস। তার দাবি, সে সময় রাবতায় নিয়মিত সমকামী যৌনকর্মীদের কাছে যেতেন মাউন্টব্যাটেন। তবে ২০ বছর ধরে মাউন্টব্যাটেনের সচিব হিসেবে কাজ করা রন পার্কস পরে দাবি করেন, মাউন্টব্যাটেন সমকামী ছিলেন না।
ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পরও ব্রিটিশ নৌবাহিনীতে দীর্ঘ দিন দায়িত্বপূ্র্ণ পদে ছিলেন তিনি। গ্রীষ্মকালীন অবসর কাটাতে মাউন্টব্যাটেন যেতেন উত্তর পশ্চিম আয়ারল্যান্ডের কাউন্টি স্লিগো-তে। আইরিশ রিপাবলিকান আর্মি বা আইআরএ এই অঞ্চলে অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। এই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল উত্তর আয়ারল্যান্ড থেকে ব্রিটিশ শাসনের অবসান।
অভিযোগ, ১৯৭৮ সালে আইএরএ-এর সদস্যরা চেষ্টা করেছিলেন লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে হত্যা করার। কিন্তু প্রতিকূল আবহাওয়ার জন্য তারা ব্যর্থ হন।
১৯৭৯ সালের ২৭ অগস্ট মাউন্টব্যাটেন গিয়েছিলেন গলদা চিংড়ি এবং টুনা মাছ ধরতে। সওয়ার হয়েছিলেন কাঠের নৌকৌ ‘শ্যাডো ফাইভ’-এ। তার সঙ্গে ছিলেন বড় মেয়ে প্যাট্রিসিয়া এবং তার স্বামী, তাদের যমজ ছেলে নিকোলাস ও টিমোথি এবং প্যাট্রিসিয়ার শাশুড়ি ডোরিন তথা ডোয়াগের লেডি ব্র্যাবোর্ন। নৌকোর মাঝি ছিল ১৫ বছর বয়সী পল ম্যাক্সওয়েল।
নৌকোবিহার যখন জমে উঠেছে, তখনই বিস্ফোরণে চারদিক কেঁপে ওঠে। অভিযোগ, আগে থেকেই বোমা রাখা ছিল নৌকোয়। ওই সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল না নৌকো ঘিরে। উদ্ধারকারীদের দাবি, বিস্ফোরণের পর পানি থেকে উদ্ধার করার সময়ও জীবিত ছিলেন মাউন্টব্যাটেন। তবে তার দু’টি পা বিস্ফোরণে ক্ষত বিক্ষত হয়ে পড়েছিল। উদ্ধার করার কিছুক্ষণ পরেই তিনি মারা যান।
বিস্ফোরণে মারা যান মাউন্টব্যাটেনের নাতি নিকোলাস এবং মাঝি পল ম্যাক্সওয়েল। দুর্ঘটনার পরের দিন মারা যান প্যাট্রিসিয়ার শাশুড়ি ডোরিন তথা ডোয়াগের লেডি ব্র্যাবোর্ন। এই ঘটনা তথা মাউন্টব্যাটেনকে হত্যার দায় স্বীকার করেছিল আইআরএ। মাউন্টব্যাটেনকে হত্যার দিনই উত্তর আয়ারল্যান্ডের ওয়ারেনপয়েন্টে আরো ১৮ জন ব্রিটিশ সৈন্যকেও হত্যা করেছিল আইআরএ।
উত্তর আয়ারল্যান্ড কি গ্রেট ব্রিটেনের অংশ হয়েই থাকবে? নাকি আয়ারল্যান্ড প্রজাতন্ত্রের অংশ হবে? এই প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বে ওই সময় উত্তর আয়ারল্যান্ড উত্তাল। গোটা আয়ারল্যান্ড দ্বিধাবিভক্ত। সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে ১৯৯৮ সালে, ‘গুড ফ্রাইডে চুক্তির’ মাধ্যমে।
এই চুক্তির মাধ্যমেই তৈরি হয় ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অ্যাক্ট ১৯৯৮’ এবং ‘নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড অ্যাসেম্বলি’। বিভিন্ন নীতি নির্ধারণে এই অ্যাসেম্বলি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়। বাকি ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার ব্রিটিশ সরকারের। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড এবং রিপাবলিক অব আয়ারল্যান্ডও কাজ করে একে অপরের সহায়ক হিসেবে।
১৯৯৮ সালে ‘গুড ফ্রাইডে এগ্রিমেন্ট’-এর পরে মুক্তি পান আইআরএ-এর প্রাক্তন সদস্য টমি ম্যাকমাহোনকে মুক্তি দেয়া হয়। তার আগে মাউন্টব্যাটেনকে হত্যার দায়ে তিনি দণ্ডিত হয়েছিলেন আজীবন কারাদণ্ডে।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন এখন ঘুমিয়ে আছেন ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে। তার বড় মেয়ে প্যাট্রিসিয়া পরলোকগত হয়েছেন ২০১৭ সালে। ছোট মেয়ে প্যামেলা হিকসের বয়স এখন ৯১ বছর। প্যামেলার একমাত্র মেয়ে ইন্ডিয়া হিকস একজন লেখিকা এবং ইন্টিরিয়র ডিজাইনার।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা