নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির হিস্যা
নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির হিস্যা - ছবি সংগৃহীত
ভারতবর্ষ ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বিভাজিত হয়ে ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি পৃথক রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল। ভারতবর্ষ বিভাজনের ৪২ বছর আগে একই ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে বাংলা বিভাজিত হয়ে পূর্ব-বাংলা ও আসাম সমন্বয়ে একটি পৃথক শাসনতান্ত্রিক কাঠামো গঠিত হয়েছিল। ভারতবর্ষ বিভাজন পূর্ববর্তী কংগ্রেস দল হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায় সমন্বয়ে একটি একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনড় থাকলেও পরবর্তীতে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে একাধিক স্থানে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হলে বাস্তবতা মেনে নিয়ে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দল দেশ বিভাজনে সম্মত হয়। ভারতবর্ষ বিভাজন পূর্ববর্তী অবিভক্ত বাংলা ও অবিভক্ত পাঞ্জাব মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রদেশ ছিল। ভারতবর্ষ বিভাজন বিষয়ে ব্রিটিশদের সাথে কংগ্রেস ও মুসলিম নেতাদের যে আলোচনা হয় তাতে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে। সে সিদ্ধান্ত মোতাবেক পাঞ্জাব ও বাংলা অবিভাজিতভাবে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কংগ্রেস দল ভারত বিভাজনে সম্মত হওয়ার পরপরই দাবি তোলে যে, ভারতের মতো বাংলা ও পাঞ্জাব হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চল সমন্বয়ে বিভাজিত হতে হবে।
এ দুটি অঞ্চলে বিভাজন পূর্ববর্তী যে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল তা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক ভয়াবহ ছিল। ভারতবর্ষ বিভাজনের পর কংগ্রেস দল ভারতের শাসনক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে, অপর দিকে মুসিলম লীগ পাকিস্তানের শাসনক্ষমতা পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৭ সাল থেকে ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসৃত হতে থাকলেও সেখানে কখনো সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থকে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের সমঅবস্থানে ঠাঁই দেয়া হয়নি। কংগ্রেস নিজেকে ধর্মনিরপেক্ষ দল দাবি করলেও রাজনীতি ও অর্থনীতি উভয় ক্ষেত্রে সবসময় হিন্দুদের স্বার্থকে মুসলিমদের স্বার্থের উপর প্রাধান্য দিয়ে এসেছে। ধর্ম বিষয়ে কংগ্রেসের দ্বিমুখী নীতির কারণেই ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রসার ঘটেছে এবং একাধিকবার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ কংগ্রেসকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে সরকার গঠন করেছে। এরই বহিঃপ্রকাশে দেখা গেল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের ষোড়শ লোকসভা নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিজেপি সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সমর্থ হয়েছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের অনন্য অবদান ছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা পরবর্তী পূর্ব-পাকিস্তানে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে যে দলটি আবির্ভূত হয়েছিল ধর্মীয় জাতিসত্তার কথা মাথায় রেখে সে দলটির নামকরণ করা হয়েছিল আওয়ামী মুসলিম লীগ, যা বর্তমানের আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে দলটিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে ‘মসুলিম’ শব্দটি বাদ দেয়া হয়। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রভাষা বাংলা আন্দোলন ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অনন্য ভূমিকা রাখলেও দলটির নাম এখনো কেন একটি উর্দু ও একটি ইংরেজি শব্দ সমন্বয়ে অক্ষুণ্ন আছে এ বিষয়ে দলের নেতৃস্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের যে সংবিধান রচিত হয় ওই সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ ছিল। এ বিষয়ে সংবিধানের ৩৮নং অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল যে, ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে; তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনো সমিতি বা সংঘ গঠন করার বা তার সদস্য হওয়ার বা অন্য কোনো প্রকারে তার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করার অধিকার কোনো ব্যক্তির থাকবে না।’
সংবিধানের এ বিধানটির কারণে ১৯৭৫ সালে মর্মান্তিক ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দু’কন্যা ব্যতীত সপরিবারে নিহত হওয়ার পূর্ববর্তী এ দেশে ধর্মভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দলের জন্মলাভের সুযোগ ঘটেনি।
বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশ, ১৯৭৮ দ্বারা ৩৮নং অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে সংবিধানে যে বিধি-নিষেধ ছিল তা অবলুপ্ত করা হয়। দ্বিতীয় ঘোষণাপত্র (পঞ্চদশ সংশোধন) আদেশটিকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেয়া হয়।
সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বাকশাল ব্যতীত অপর সব রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব বিলোপ করা হলে ধর্মভিত্তিক দলের বাইরের দলগুলোরও অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সামরিক ফরমানের মাধ্যমে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রথা চালু করা হলে ধর্মভিত্তিকসহ সব ধরনের রাজনৈতিক দল সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার অধিকার লাভ করে।
১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়ে সাতটি আসনে বিজয়ী হয়। পরবর্তীতে ইসলামিক ডেমোক্রেটিক লীগের শরিক জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বর্তমানে জামায়াতসহ দেশে আরো বেশকিছু ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এ দলগুলো ডানপন্থী ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী।
বিএনপি ও জাতীয় পার্টি বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হলেও এ দুটি দল ধর্মভিত্তিক দল নয়। তাই নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ দেশে জামায়াতসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলে এ দলগুলোর সমর্থকদের ভোট ডানপন্থী অথবা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী দলের অনুকূলে গিয়ে পড়বে। এরূপ দলের অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনৈতিক দলের ভোটবাক্সে গিয়ে পড়বে যেমন ’৭৩-এর প্রথম সংসদ নির্বাচনে সে সময় নিষিদ্ধ মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের ভোট জাসদ (জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল) লাভ করেছিল।
বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া ও চীনে সাম্যবাদীদের উত্থানে সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের যে উন্মেষ ঘটেছিল একবিংশ শতাব্দীতে সেটি অনেকটা স্তিমিত হয়ে পড়েছে। রাশিয়া, চীন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে বর্তমানে ধর্মচর্চার ব্যাপারে আগের মতো কঠোরতা আর নেই। ইউরোপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ নয়। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে খ্রিষ্টানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল স্পর্শ করে শপথ পাঠ করতে হয়। তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় কোনো মুসলিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন সে ক্ষেত্রে তিনি শপথ পাঠের সময় বাইবেল স্পর্শ করবেন কিনা, কেননা বাইবেল ছুঁয়ে শপথ নিলে তার ধর্মবিশ্বাসের হানি ঘটবে। সে ক্ষেত্রে নতুন প্রশ্ন উঠবে তাহলে কি সংবিধান সংশোধন করা হবে?
আমাদের সংবিধানে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৩৮নং অনুচ্ছেদে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠন বিষয়ে পুনঃশর্তারোপ করে সংশোধনী আনয়নপূর্বক বলা হয়- ‘জনশৃঙ্খলা ও নৈতিককতার স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তসঙ্গত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তির উক্তরূপ সমিতি বা সংঘ গঠন করার কিংবা উহার সদস্য হওয়ার অধিকার থাকবে না যদি- (ক) উহা নাগরিকদের মধ্যে ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (খ) উহা ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষ, জন্মস্থান বা ভাষার ক্ষেত্রে নাগরিকদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; (গ) উহা রাষ্ট্র বা নাগরিকদের বিরুদ্ধে কিংবা অন্য কোনো দেশের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হয়; বা (ঘ) উহার গঠন ও উদ্দেশ্য সংবিধানের পরিপন্থী হয়।’
অনুচ্ছেদ নম্বর ৩৮-এ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বিষয়ে ’৭২-এর সংবিধানে যে বিধি-নিষেধ ছিল তাতে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক দল গঠনের অধিকার খর্ব করা হয়েছিল। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয় তাতে বলা হয় ধর্মীয়, সামাজিক এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট বা জঙ্গি কার্য পরিচালনার উদ্দেশ্যে গঠিত হলে সে ক্ষেত্রে দল গঠনের অধিকার থাকবে না। ৩৮নং অনুচ্ছেদটির পূর্বোক্ত দুটি অবস্থান পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, প্রথমোক্ত অবস্থানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা ছিল তা পূর্ণাঙ্গ। আর বর্তমানে যে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে তাকে আংশিক বলা যায় এ কারণে যে, গঠন পরবর্তী বা পূর্ববর্তী যদি দেখা যায় কোন দল অনুচ্ছেদটিতে উল্লেখিত শর্তাংশের লঙ্ঘনপূর্বক পরিচালিত হবে বা হচ্ছে সে ক্ষেত্রে গঠনের অনুমতি প্রদান হতে বিরত থাকার বা অনুমতি প্রদান না করার অবকাশ আছে।
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে জামায়াত ১০টি আসন লাভ করেছিল এবং আওয়ামী লীগের সাথে একাট্টা হয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসমেত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তাতে জামায়াতকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের আন্দোলনের সাথী হিসেবে দেখা গেছে।
পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে ১২.১৩, ৮.৬১, ৪.২৮ ও ৪.৭০ শতাংশ। এ চারটি নির্বাচনে জামায়াত ১২২, ৩০০, ৩১ ও ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথাক্রমে ১৮, ০৩, ১৭ ও ০২টি আসন প্রাপ্ত হয়। উপরোক্ত চারটি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় পঞ্চম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৮ শতাংশ হ্রাস ঘটলেও আসন প্রাপ্তির সংখ্যা প্রায় সমরূপ ছিল। অপর দিকে সপ্তম ও নবম এ দু’টি নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস ঘটলেও আসনপ্রাপ্তি অস্বাভাবিক পরিমাণ হ্রাস পেয়ে প্রায় সমরূপ ছিল।
২০১৪ সালের প্রারম্ভে যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ না করায় এ নির্বাচনটি একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ছিল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি করে নেয়। নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের আসন সংখ্যা ও ভোটপ্রাপ্তির হার অপ্রত্যাশিতভাবে হ্রাস পাওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বামঘরানার রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করতে থাকেন যে, জামায়াতের জনসমর্থন দু’শতাংশের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং এককভাবে নির্বাচন করলে তাদের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তির হার ও আসনপ্রাপ্তির হার উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক হ্রাস ঘটে। এ দুটি নির্বাচনের প্রথমোক্তটিতে জামায়াত এককভাবে ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল; অপর দিকে শেষোক্তটিতে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
দশম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনে দেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দল অংশ নেয়। এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিএনপি ও জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তির হার এবং চেয়ারম্যান, ভাইস- চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে আসনপ্রাপ্তির হার পর্যালোচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে অংশ নিয়েও বিএনপি ও জামায়াত এককভাবে প্রদত্ত ভোটের যথাক্রমে প্রায় ৪০ ও ২০ শতাংশ পেয়েছে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা মাত্র একটি। বিভিন্ন বামঘরানার রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান পদে আসন প্রাপ্তির সংখ্যা শূন্য এবং ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যা এত নগণ্য, যা উল্লেখ করার মতো নয়।
উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত যেভাবে সাফল্য পেয়েছে তা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, যে হারে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জনমানুষের সমর্থন বাড়ছে তাতে অচিরেই জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। এ কথাটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যে কোনো দেশের জনগণ সবসময় অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিতের পক্ষে থাকে। সম্প্রতি জামায়াতের জনসমর্থনে যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা যাচ্ছে তা যে এরই বহিঃপ্রকাশ এমন ধারণা অমূলক নয়। ২০০১ এর অষ্টম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ এর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির ভাগ্যে যেভাবে বিপর্যয় ঘটেছে তা থেকে ধারণা করা যায় তৃতীয় শক্তি হিসেবে অন্য কোনো দল আবির্ভূত হতে ব্যর্থ হলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তাকে জামায়াত বা অপর যে কোনো নামেই ডাকা হোক না কেন এর সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
e-mail: iktederahmed@yahoo.com