ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতের হিসাব
জামায়াতে ইসলামী - ছবি সংগৃহীত
১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টি ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হয়। সে নির্বাচনে জামায়াত ১০টি আসন লাভ করেছিল এবং আওয়ামী লীগের সাথে একাট্টা হয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসমেত চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে বিরত থাকে। চতুর্থ সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে যে গণআন্দোলন পরিচালিত হয়েছিল তাতে জামায়াতকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয়ের আন্দোলনের সাথী হিসেবে দেখা গেছে।
পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের ভোটপ্রাপ্তির হার ছিল যথাক্রমে ১২.১৩, ৮.৬১, ৪.২৮ ও ৪.৭০ শতাংশ। এ চারটি নির্বাচনে জামায়াত ১২২, ৩০০, ৩১ ও ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যথাক্রমে ১৮, ০৩, ১৭ ও ০২টি আসন প্রাপ্ত হয়। উপরোক্ত চারটি নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনায় দেখা যায় পঞ্চম ও অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৮ শতাংশ হ্রাস ঘটলেও আসন প্রাপ্তির সংখ্যা প্রায় সমরূপ ছিল। অপর দিকে সপ্তম ও নবম এ দু’টি নির্বাচনে ভোটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস ঘটলেও আসনপ্রাপ্তি অস্বাভাবিক পরিমাণ হ্রাস পেয়ে প্রায় সমরূপ ছিল।
২০১৪ সালের প্রারম্ভে যে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তাতে বিএনপি ও জামায়াত অংশগ্রহণ না করায় এ নির্বাচনটি একতরফা ও প্রতিদ্বন্দ্বীহীন ছিল। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি সমঝোতার ভিত্তিতে আসন ভাগাভাগি করে নেয়। নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের আসন সংখ্যা ও ভোটপ্রাপ্তির হার অপ্রত্যাশিতভাবে হ্রাস পাওয়ায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন বামঘরানার রাজনৈতিক দলের নেতারা দাবি করতে থাকেন যে, জামায়াতের জনসমর্থন দু’শতাংশের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে এবং এককভাবে নির্বাচন করলে তাদের আসন পাওয়ার সম্ভাবনা শূন্য। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তির হার ও আসনপ্রাপ্তির হার উভয় ক্ষেত্রে ব্যাপক হ্রাস ঘটে। এ দুটি নির্বাচনের প্রথমোক্তটিতে জামায়াত এককভাবে ৩০০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল; অপর দিকে শেষোক্তটিতে বিএনপির সাথে জোটবদ্ধ হয়ে ৩৯টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল।
দশম সংসদ নির্বাচন পরবর্তী উপজেলা নির্বাচনে দেশের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতসহ অন্যান্য দল অংশ নেয়। এ নির্বাচনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বিএনপি ও জামায়াতের ভোটপ্রাপ্তির হার এবং চেয়ারম্যান, ভাইস- চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে আসনপ্রাপ্তির হার পর্যালোচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় প্রতিকূল পরিবেশে নির্বাচনে অংশ নিয়েও বিএনপি ও জামায়াত এককভাবে প্রদত্ত ভোটের যথাক্রমে প্রায় ৪০ ও ২০ শতাংশ পেয়েছে। অন্যদিকে চেয়ারম্যান পদে জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা মাত্র একটি। বিভিন্ন বামঘরানার রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যান পদে আসন প্রাপ্তির সংখ্যা শূন্য এবং ভোটপ্রাপ্তির সংখ্যা এত নগণ্য, যা উল্লেখ করার মতো নয়।
উপজেলা নির্বাচনে জামায়াত যেভাবে সাফল্য পেয়েছে তা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, যে হারে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রতি জনমানুষের সমর্থন বাড়ছে তাতে অচিরেই জামায়াতসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাজনীতির মাঠে নিজেদের অবস্থান আরো দৃঢ় ও শক্তিশালী হওয়ার পথে এগিয়ে যাবে। এ কথাটি বিবেচনায় নেয়া প্রয়োজন, যে কোনো দেশের জনগণ সবসময় অত্যাচারিত ও নিষ্পেষিতের পক্ষে থাকে। সম্প্রতি জামায়াতের জনসমর্থনে যে ঊর্ধ্বমুখী ধারা দেখা যাচ্ছে তা যে এরই বহিঃপ্রকাশ এমন ধারণা অমূলক নয়। ২০০১ এর অষ্টম সংসদ নির্বাচন এবং ২০০৮ এর নবম সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিএনপির ভাগ্যে যেভাবে বিপর্যয় ঘটেছে তা থেকে ধারণা করা যায় তৃতীয় শক্তি হিসেবে অন্য কোনো দল আবির্ভূত হতে ব্যর্থ হলে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল তাকে জামায়াত বা অপর যে কোনো নামেই ডাকা হোক না কেন এর সম্ভাবনা সমুজ্জ্বল।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
e-mail: iktederahmed@yahoo.com