ভারতে যা হচ্ছে
মোদি - ছবি সংগৃহীত
‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ভারতের মোদি সরকারের এই আমলে বিভিন্ন রাজ্যে হিন্দুত্ববাদীদের নানামুখী তৎপরতায় অব্যাহতভাবে চলছে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা হরণের মহোৎসব। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় মদদে নানা ধরনের সন্ত্রাসী হামলা। প্রশাসনের নাকের ডগায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই হচ্ছে হত্যার শিকার। এখন রাজ্যে রাজ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে মানুষের ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকার কেড়ে নেয়ার লক্ষ্যে সংবিধান-বিরোধী আইন প্রণয়নের অপতৎপরতা। কোথাও কোথাও ধর্মান্তর ও ‘লাভ’ জিহাদের অজুহাত তুলে সংখ্যালঘুদের পরিণত করা হচ্ছে হয়রানি ও নির্যাতনের শিকারে। সময়ের সাথে জোরদার করে তোলা হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের ‘ঘর ওয়াপসি’ নামের কৌশলী অপতৎপরতার মাধ্যমে সামাজিক ও আর্থনীতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের জোর করে হিন্দু বানানোর গ্রুপ। হিন্দুত্ববাদী নেতারা প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন, যত দিন না ভারতে অন্যসব ধর্ম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ হচ্ছে, তত দিন চলবে ঘর ওয়াপসি অভিযান। ইত্যাদি নানা কারণে ভারতে এখন ধর্মীয় স্বাধীনতা চরম বিপন্ন। ব্যাপারটি ভারতের ভেতরে ও আন্তর্জাতিক মহলেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।
২০২০ সালের এপ্রিলের দিকে ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হওয়ার অভিযোগ তুলে ভারতকে কার্যত কালো-তালিকাভুক্ত করে ‘ইউনাইটেড স্টেটস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম’ (ইউএসসিআইআরএফ)। ভারতকে এই কমিশন ‘কান্ট্রিজ অব পার্টিকুলার কনসার্ন’ তালিকভুক্ত করেছে। অর্থাৎ তাদের দৃষ্টিতে যেসব দেশের ধর্মীয় স্বাধীনতা-পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, ভারত সেসব দেশের একটি। আর এই কমিশন মার্কিন প্রশাসনের কাছে সুপারিশ করেছে, এ কারণে ভারতের বিরুদ্ধে ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেয়া হোক। এই ‘যথাযথ ব্যবস্থা’ নেয়ার অর্থ ভারতের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে এবং যাদের কারণে এই ধর্মীয় স্বাধীনতা বিপন্ন হয়েছে, তাদেরকে মার্কিন ভিসা দেয়া যাবে না। ২০০৪ সালের পর থেকে ভারতের নাম কখনো এই তালিকায় ছিল না।
ইউএসসিআইআরএফ-এর এবারের রিপোর্টে বলা হয়েছে- ‘ভারতে নাগরিকত্ব সংশোধন করে আইন পাস করা হয়েছে। এর ওপর পার্লামেন্টে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, সারা দেশে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি করা হবে। আসামের অভিজ্ঞতা বলছে, দেশজুড়ে এনআরসি হলে বহু মানুষ নাগরিকত্ব হারাবে। অমুসলিমদের জন্য সুরক্ষা রয়েছে। কিন্তু মুসলমানদের জন্য নেই। এ ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে দেশজুড়ে এনআরসি হলে শুধু মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। নরেন্দ্র মোদি সরকার অবশ্য এই রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, ‘রিপোর্টটি পুরোপুরি একপেশে। ভারতের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই কমিশনের রিপোর্ট নতুন কিছু নয়। কিন্তু এবার মিথ্যা বর্ণনা নতুন স্তরে চলে গেছে।’
একই সময়ে কুয়েত অনুরোধ জানিয়েছে ভারতে ক্রমবর্ধমান মুসলিমবিরোধী মনোভাব মোকাবেলার জন্য ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ‘ওআইসি’র কাছে। কুয়েত এক বিবৃতি প্রকাশ করে বিজেপিশাসিত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতে ইসলামোফোবিয়া সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং সেই সাথে ওআইসিকে এ ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানায়। কুয়েতের ওয়াকফ ও ইসলামবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, ‘যারা ভারতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ করে এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘন করে, তারা কি ভাবছেনÑ বিশ্বে মুসলমানেরা এ ব্যাপারে নীরব থাকবে? বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক, আইনি ও আর্থনীতিকভাবে আন্দোলন করবে।’
ভারতীয় সংবিধান সে দেশের প্রতিটি নাগরিককে তার নিজের পছন্দ অনুসারে যে কোনো ধর্ম গ্রহণ, অনুশীলন, প্রচার ও প্রসারে স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার দিয়েছে। দেশটিতে সবাইকে কোনো ধর্ম অনুসরণ করা এবং স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হওয়ার অধিকারও দিয়েছে। এর ফলে সেখানে এক ধরনের সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু নানা কারণে সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বেড়ে গেছে। বেড়ে গেছে সাম্প্রদায়িক বিভেদ। এর ফলে, এখন ভারতের মানুষ দেখছে- দেশে বাড়ছে সামাজিক অস্থিতিশীলতা। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও। তাদের জিডিপির হার কমছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। বাড়ছে বেকারত্ব ও কৃষকদের আত্মহত্যার প্রবণতা। সারা দেশে চলছে অভূতপূর্ব কৃষক বিক্ষোভ। ভারতের অনেক রাজ্যে উদ্বেগ চলছে আন্তঃধর্ম বিয়ে ও ধর্মান্তর নিয়ে। অনেক রাজ্য ব্যস্ত-সমস্ত ধর্মান্তর ঠেকানোর আইন প্রণয়নে। কারণ, বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতে ধর্মান্তর বিবেচিত হচ্ছে একটি ‘খুঁত খুঁতে’ বিষয় হিসেবে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে, ধর্মান্তরের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রেখে। রাজ্য সরকারগুলোর এসব তৎপরতার সমান্তরাল পদক্ষেপ হিসেবে উগ্র হিন্দুরা তাদের ধর্মরক্ষার নাম করে আন্তঃধর্ম দম্পতির ওপর নানা ধরনের হয়রানি-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
ধর্মান্তর প্রধানত চলছে হিন্দুধর্ম থেকে অন্য ধর্মে। উত্তর প্রদেশ সরকার পরিকল্পনা করছে- একটি অধ্যাদেশ জারি করে ধর্মান্তরিত বিয়ের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা কার্যকর করতে। সে অনুযায়ী, যেসব প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ধর্মান্তর প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট থাকবে, সেগুলোর নিবন্ধন বাতিল করা হবে। তাদের করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। অর্ডিন্যান্সের দাবি মতে, বিয়ের প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোকে দুই মাস আগে এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসনকে জানাতে হবে। স্থানীয় প্রশাসনের ক্ষমতা থাকবে এই বিয়ে বৈধ না অবৈধ, তা নির্ধারণের। অবশ্য তা প্রমাণের দায় থাকবে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি ও ধর্মান্তর করার সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের। অর্ডিন্যান্সে বিশেষ উল্লেখ রয়েছে, শিডিউল কাস্ট/শিডিউল ট্রাইব ও নারীদের বিষয়ে। অনেক রাজ্যে প্রতিযোগিতা চলছে ‘লাভ-জিহাদ-বিরোধী’ ও ‘ধর্মন্তর-বিরোধী’ আইন পাসের ব্যাপারে। বিভিন্ন রাজ্যের এসব আইনের অনেক ধারা ভারতীয় সংবিধানের পরিপন্থী। অনেক ঘটনা রয়েছে, যেখানে দম্পতি ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের ওপর ধর্মান্তর ও লাভ জিহাদের অভিযোগ এনে নির্যাতন-নিপীড়ন চালানো হয়েছে। উল্লেখ্য, ‘লাভ জিহাদ’ বা ‘রোমিও জিহাদ’ কথাটি ভারতে ব্যবহার করা হচ্ছে এটা বুঝাতে- মুসলমানেরা ভালোবাসার ভান করে অমুসলিমদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করছে।
উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় আর্য সমাজ শুরু করেছিল ‘শুদ্ধি আন্দোলন’। এ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল- হিন্দু ধর্ম ছেড়ে যারা অন্য ধর্মে চলে গিয়েছিল, তাদেরকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা। একইভাবে মানুষকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করার লক্ষ্য নিয়ে তাবলিগ জামাত সমান্তরালভাবে সক্রিয় ছিল ‘তানজিম’ অভিযান নিয়ে। বিংশ শতাব্দীতে হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটান ড: ভীমরাও আম্বেদকার। এ ঘটনা আমাদের জানিয়ে দেয়, হিন্দু ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার মূল কারণটি কী, তখন আম্বেদকার তার সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। কিন্তু তিনি ‘অস্পৃশ্য দলিত’ হওয়ার কারণে ভারতে অমর্যাদার শিকার হন। তিনি আন্দোলন শুরু করেন দলিত শ্রেণির সামাজিক মর্যাদা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তার মুখ্য অভিমত ছিল, বর্ণপ্রথার উচ্চ-নীচ ভেদাভেদের কারণে হিন্দুরা একজাতি হতে পারেনি। হিন্দু ধর্মে প্রাধান্য বিস্তার করে আছে ব্রাহ্মণ্যবাদী মূল্যবোধ। এ কারণেই তিনি ঘোষণা দেন: ‘I was born a Hindu that was not in my hands but I will not die a Hindu’.
তার এই উদঘাটন তাকে বাধ্য করে হিন্দু ধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে। তিনি তার অনুসারী তিন লাখ দলিত হিন্দুসহ এক যোগে বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হন। আজ ধর্মান্তরের যেসব আইন প্রণয়নের কথা শুনছি, সেব আইন তখন চালু থাকলে আম্বেদকারকে নিশ্চিত জেলে যেতে হতো। ‘ভারতীয় সংবিধানের স্থপতি’ হিসেবে বিবেচিত এই আম্বেদকার ছিলেন মানুষের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। এই স্বাধীনতার মাঝেই নিহিত মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্মবিশ্বাস বেছে নেয়ার অধিকার এবং এর লালনের অধিকারও। একই সাথে এই স্বাধীনতার মাঝেই রয়েছে কারো ঈশ্বরবাদী কিংবা নিরীশ্ববাদী হওয়া না হওয়ার অধিকার। অর্থাৎ মানুষের স্বাধীনতায় ধর্মসম্পর্কিত সব ধরনের অধিকার রয়েছে। ভারতে অতীতে সে অধিকার চর্চিত হয়েছে। এভাবেই ভারতে প্রসার লাভ করেছে ইসলাম, খ্রিষ্টান, শিখ, বৌদ্ধ, হিন্দু ও অন্যান্য ধর্ম। সে কারণেই ভারত হতে পেরেছে একটি প্লুরালিস্টিক কান্ট্রি তথা বহু ধর্মমত, পথের মানুষের দেশ।
কিন্তু আজকের বাস্তবতা হচ্ছে- এই ভারতে কেউ তার ধর্ম পরিবর্তন করতে চাইলে তাকে নানা বাধার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। উপমহাদেশের ইতিহাসে ইসলাম ও খ্রিষ্টান ধর্মে ছোট-বড় নানা ধর্মান্তরের সুস্পষ্ট উদাহরণ রয়েছে। ভারতের ইতিহাসে এই ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে মূলত দু’টি কারণে। একটা কারণ, হিন্দু ধর্মের পবিত্র গ্রন্থে বর্ণিত বর্ণপ্রথার কারণে এক বর্ণশ্রেণীর মানুষ আরেক বর্ণশ্রেণীর মানুষের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মুসলমানদের ভারত বিজয় আসে উৎপীড়িত গরিব মানুষের মুক্তি হিসেবে। এ কারণেই, আমাদের এক-চঞ্চমাংশ মানুষ মুসলমান হয়ে যায়। এসব কিছু ঘটেনি তরবারির জোরে। এসব ঘটেছে তরবারির জোরে- এমনটি চিন্তা করাও বড় ধরনের এক পাগলামি। এমনটি ঘটেছে জমিদার ও পুরোহিতদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এবং এর পরিণতিতেই বাংলার কৃষকদের মধ্যে হিন্দুদের তুলনায় মুসলমান বেশি। কারণ, সেখানে জমিদারের সংখ্যা ছিল অনেক’- স্বামী বিবেকানন্দের এসব উপলব্ধির সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘সিলেক্টেড ওয়ার্কস অব স্বামী বিকোনন্দ’-এর তুতীয় খণ্ডের দ্বাদশ সংস্করণের ২৯৪ নম্বর পৃষ্ঠায়।
এই উপমহাদেশে অনেক ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে সামাজিক মিথষ্ক্রিয়া ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের পথ ধরেও। এ কথাও ঠিক, অনেক বিজয়ী রাজা বিজিত রাজাকে অবমাননাকরভাবে ধর্মান্তর করতে বাধ্য করেছেন। কিন্তু ভারতে প্রধানত ধর্মান্তরের মাধ্যমে মুসলমান হওয়ার ঘটনা ঘটেছে সুফি-দরবেশদের প্রভাবে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে প্রখ্যাত ভারতীয় গায়ক, গীতিকার ও সঙ্গীত প্রযোজক এ.আর. রহমান। তিনি হিন্দু থেকে মুসলমান হয়ে এআর রহমান হয়েছেন একান্তভাবেই সুফি-সাধকের প্রভাবে।
দ্বিতীয় প্রপঞ্চটি হচ্ছে খ্রিষ্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এসব মিশনারি ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা নানা জনগোষ্ঠীর মাঝে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য উন্নয়নের কাজে ব্যস্ত। তাদের মাধ্যমে অনেকে ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিষ্টান হয়েছে। ১৯৯৯ সালে পাদ্রী স্টেইসকে হত্যা করা হয় তার বিরুদ্ধে হিন্দুদের ধর্মান্তর করার অজুহাত তুলে। ২০০৮ সালে বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে কান্ধামালে খ্রিষ্টানবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। খ্রিষ্টান মিশনারীদের মাধ্যমে ধর্মান্তরের ঘটনা ঘটেছে- এ কথা ঠিক, তবে ততটা ব্যাপকভাবে নয়। কয়েক শতাব্দী ধরেই ভারতে খ্রিষ্টান মিশনারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। এর পরও ২০১১ সালের লোকগণনা অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার মাত্র ২.৩ শতাংশ খ্রিষ্টান। ভারতে প্রথম চার্চ প্রতিষ্ঠা করেন সেন্ট থমাস, সেই ৫২ সালে।
হিন্দুধর্মে ধর্মন্তরিত করার রাজনৈতিক প্রপঞ্চ ‘ঘর ওয়াপসি’ খুব বেশি পুরনো নয়। এর শুরু নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর। এর পেছনে রয়েছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি) এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘ (আরএসএস)। এরা এই ঘর ওয়াপসির মাধ্যমে মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের নানা অপকৌশলে অনেকটা ভয়-ভীতি সৃষ্টি করে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করছে; যদিও বলা হচ্ছে- এদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা হচ্ছে না, বরং এদেরকে এদের পুরনো ধর্মে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তাদের মতে, এরা আগে হিন্দুই ছিল এবং এদের জোর করে মুসলমান কিংবা খ্রিষ্টান বানানো হয়েছিল। এখন তাদের হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। তখন বিজেপি নেতা আদিত্য নারায়ণ বলেছিলেন, ঘর ওয়াপসি অভিযান অব্যাহত থাকবে, যদ্দিন না ভারতে অন্যান্য ধর্ম পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা হয়; তখন এই ঘর ওয়াপসি অভিযান নিয়ে ভারতের ভেতরে ও বাইরে প্রবল সমালোচনার ঝড় ওঠে। কিন্তু ভিএইচপি ও আরএসএস তাদের এই অভিযান বন্ধ করেনি।
ঘর ওয়াপসির ঘটনার খবর পাওয়া যায় তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র প্রদেশ, কেরালা, গোয়া, আগ্রা প্রভৃতি রাজ্য থেকে। ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা খ্রিষ্টান ও মুসলমানদের বিপিএল কার্ড ও রেশনকার্ডসহ উন্নততর শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার লোভ দেখিয়ে পূজা উৎসবে ডেকে নিয়ে হিন্দুধর্মে দীক্ষিত হতে বাধ্য করা হচ্ছে। ভিএইচপির দাবি, তা শুধু ২০১৮ সালেই ২৫ হাজার মুসলমান ও খ্রিষ্টানকে ঘরওয়াপসির মাধ্যমে হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে এনেছে। আসলে এদের আবারো বর্ণপ্রথার অধীনেই ফিরিয়ে আনতে নানা কৌশলে বাধ্য করা হচ্ছে। বিজেপি সরকারের সক্রিয় সহযোগিতায় পরিচালিত এই ‘ঘর ওয়াপসি’ অভিযান ভারতজুড়ে প্রবলভাবে সমালোচিত হলেও আদালতও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত এ কাজে সহায়ক ভূমিকা পালন করছেন। অথচ এ ধরনের কর্মকাণ্ড ভারতীয় সংবিধানেরও পরিপন্থী। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এক রুল জারি করে বলেছে- ‘হিন্দুধর্মে এই প্রত্যাবর্তনের ফলে প্রত্যাবর্তনকারীর কোটা-সুবিধা বহাল থাকবে। এদের খ্রিষ্টান ধর্র্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল উন্নত শিক্ষা ও আর্থিক সুযোগ-সুবিধা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। এরা রয়ে গেছে আগের মতোই গরিব।’