ইভিএম : কী হয়েছে ভারতের নির্বাচনে!

গৌতম দাস | Dec 26, 2020 04:10 pm
ইভিএম

ইভিএম - ছবি সংগৃহীত

 

ইভিএম মেশিন বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন নিয়ে বিতর্ক শুধু বাংলাদেশে না, ভারতেও ব্যাপক। আর ভারতে এর ব্যবহার প্রায় শতভাগ আসনে, মানে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। এই মেশিনের প্রোগ্রামিংয়ের ম্যানিপুলেট করে কারচুপি করার অভিযোগ সবচেয়ে ব্যাপক। এরই মধ্যে ভারতে গত ২০১৯ সালের মে মাসের কেন্দ্রের নির্বাচনের ফলাফল থেকে সর্বশেষ গত অক্টোবর মাসে বিহারের রাজ্যনির্বাচন পর্যন্ত প্রায় সব নির্বাচনেই মেশিন কারচুপির অভিযোগ অনেক জোরদার হয়ে উঠেছে। বিশেষত ২০১৯ সালের নির্বাচনে তা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সাত পর্বে। এর শেষ পর্বের আগের দিন অমিতশাহ আর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন। হিমালয়ের এক হিন্দু তীর্থস্থানে মোদি ধ্যানে বসেছিলেন, শেষ নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের আগে। সেটা শেষ করে এসেছেন- এই অজুহাতে মোদি সংবাদ সম্মেলনে সৌজন্যের কিছু কথা ছাড়া কিছুই বলেননি। পুরো অনুষ্ঠানে অমিত শাহ একাই কথা বলেছিলেন। অমিতের কথার মূল ফোকাস ছিল কত আসনে বিজেপি জিতবে, এর দাবি। তিনি দাবি করেছিলেন, মোট ৫৪৩ আসনের মধ্যে বিজেপি একাই তিন শ'এর বেশি আসন পাবে। হয়েছিলও তাই, পেয়েছিল ৩০৩ যেটা গত ২০১৪ সালের নির্বাচনের চেয়ে ৩৬ আসন বেশি। বিজেপি জোট হিসাবে ২০১৯ সালে মোট পেয়েছিল ৩৫৩ আসন। আর এখান থেকেই কারচুপি বা সফটওয়ার প্রোগ্রাম ম্যানিপুলেশন করার অনুমান জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায় যা এখন ক্রমশ বাড়ছে।

ওই সময় মূলত দুটা কারণে অভিযোগ, সন্দেহ জোরদার হয়েছিল, এক. অমিত শাহের মোট আসনের প্রেডিকশন বা অনুমিত প্রাপ্ত আসন সংখ্যা আর ২০১৪ সালের চেয়ে বেশি আসন পেয়ে বিজয়ী হওয়া, যেটা অস্বাভাবিক ঠেকেছিল। কারণ, ২০১৪ সালের নির্বাচনে মোদি বেশি জনপ্রিয় ছিলেন। ২০১৯ সালের সময় বিগত পাঁচ বছরে মোদির শাসনে ইতোমধ্যে ভারতের অর্থনীতি ডুবেছে অনেক বেশি যা মোদি পরিসংখ্যান লুকানোর প্রবল চেষ্টার পরেও তা উন্মোচিত হয়ে পড়েছিল। আর এই পতন শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালে পাঁচ শ ও এক হাজার রুপির নোট হঠাৎ বাতিল ঘোষণার ধাক্কায়। ভারতের অর্থনীতির বড় অংশটাই হলো ইনফরমাল। আর এই অংশেই নোট বাতিলের প্রভাবে তা গুটিয়ে যাওয়া; এটা ঘটেছিল মারাত্মকভাবে। তাই সেবার আসন কমে হেরে যেত অথবা কম মার্জিনে হয়তো বিজেপি জিতত, কিন্তু হয়েছিল এর উলটা। সন্দেহ-অবিশ্বাসের শুরু সেই থেকে।

একজন রবি কান্তের দুঃখ ও হতাশা
রবি কান্ত, ভারতের একজন কলামিস্ট, জার্নালিস্টও বলা যায়। তার মূল আগ্রহের বিষয় অর্থনীতি। আর মূলত ভারতের বাইরের পত্রিকায় তিনি লেখেন যদিও নিজেরই ভাষ্যমতে তিনি টেকনোলজি, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা সাইবার-সিকিউরিটি নিয়ে লিখতে পছন্দ করেন। তার এবারের উদ্বেগ এই সাইবার সিকিউরিটির প্রশ্নে।
এদিকে ‘এশিয়ান টাইমস’ হংকং থেকে প্রকাশিত ওয়েবভিত্তিক একটা দৈনিক সাম্প্রতিককালে যার আরেকটা সিস্টার কনসার্ন আরেক ওয়েবভিত্তিক দৈনিক প্রকাশিত হওয়া শুরু হয়েছে- ‘এশিয়ান টাইমস ফাইন্যান্সিয়াল’ নামে। ভারতের রবি কান্ত ভারতের মিডিয়ায় বিশেষত ভারতের ইকোনমিক টাইমস ধরনের অর্থনীতিভিত্তিক পত্রিকায়ও অনেক লিখে থাকেন। তিনি এশিয়ান টাইমসে একটা আর্টিকেল লিখেছেন যেখানে তার লেখার বিষয় ‘ভারত-রাষ্ট্র ভেঙে পড়ছে’ বলে তার হতাশা আর দুঃখ।

‘ভেঙে পড়ছে’ মানে কী অর্থে?

একটা রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকে ও দীর্ঘস্থায়ী হয় স্থায়ী ও সুগঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কারণে সে হিসেবে, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগ আর সংসদীয় (জনপ্রতিনিধিদের) ক্ষমতা ইত্যাদি খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মানা হয়; যেখানে বিভিন্ন মতামতকে জায়গা দিয়ে একটা সমন্বিত ব্যবস্থা ও আইনের কাঠামোর মধ্যে থেকে একে অভ্যাস ও চর্চাকে সবল করা ও নিয়মিত রেওয়াজে নিয়ে যাওয়া হয় ইত্যাদি।

গায়ের জোর খাটানোর অথবা কখনো চাতুরীর সুযোগ পেয়ে বা বের করে আপনি যখন রাজনৈতিক বিরোধীদের দাবড়িয়ে কোণঠাসা করে রাখবেন আর সেটাই মূলধারা বানিয়ে ফেলবেন- এটাই হলো উলটা কাজ। গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ধারক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এবার দুর্বল ও অসংগঠিতভাবেই গড়ে উঠবে। এতে, দুর্বল ও অসংগঠিত প্রতিষ্ঠানগুলো আপাতত ও খুবই সাময়িক আপনার বিরাট বিজয় এনে দিচ্ছে মনে হলেও নিশ্চিত থাকতে পারেন, অচিরেই আপনি আপনার রাষ্ট্রকে ক্রমশ ভেঙে পড়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন; সেদিকে নিয়ে যাচ্ছেন এবং যাবেনই। সেটা তখন কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে যাবে যে, আপনার রাষ্ট্রটা কখন ভেঙে পড়বে। এসব দিক থেকে দেখে তাই রবি কান্তের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ভারতের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আর অনুষঙ্গ হিসেবে ভারতের সুপ্রিম কোর্টও- এসব প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে। আর এ নিয়েই তার যত আশঙ্কা ও যেটা তার হতাশার মূল প্রসঙ্গ।

লেখার শুরুতে প্রথম-অর্ধে তিনি ভারতের ‘গণতন্ত্র’ কত মহান, তা নিয়ে প্রায় অর্ধেক জায়গাই ব্যবহার করে ফেলেছেন। যেমন তার লেখার মূল শিরোনাম দিয়েছেন, ‘বিশ্বের সর্ববৃহৎ ডেমোক্রাসিকে সিস্টেমেটিকভাবে ভেঙ্গে ফেলা’। অনেক পাঠক এই ‘সর্ববৃহৎ ডেমোক্রাসি’ ধরনের ফাঁকা ও খামোখা প্রশংসা শুনেই বিরক্ত হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারেন এবং সেটাই উচিত সম্ভবত। কারণ শব্দটা বাগাড়ম্বর ধরনের। এমনিতেই, শুধু ‘ডেমোক্রাসি’ শব্দ ব্যবহার করে কেউ ফাঁপা গর্ব করা কথা বললে সেটা বাকচাতুরীতে প্রতারণা ও ফাঁকির আয়োজন হচ্ছে বলে সন্দেহ হতে শুরু হয়। কারণ একটা দেশে নির্বাচন হলেই সেখানে ডেমোক্রাসির জয়জয়কার চলছে বলা বা মনে করা ভিত্তিহীন। ফলে সেখান থেকে অসততার ইঙ্গিতের শুরু। এটা এক বাগাড়ম্বর আর প্রপাগান্ডা। অথচ ভিতরে খুঁজে দেখলে হয়তো পাওয়া যাবে যে, সবচেয়ে জঘন্য নাগরিক বৈষম্যের রাষ্ট্র হয়তো সেটাই; অথচ সেদিকটার খবর নাই।

এছাড়াও ‘ডেমোক্রাসি’ শব্দ ব্যবহার করে যারা নিজেকে প্রকাশ করতে ভালোবাসেন এদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সবল অভিযোগ হলো, রাষ্ট্রের আসল গুণ-বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে এদের ন্যূনতম জ্ঞান ও ধারণা নাই বা থাকে না। কারণ রাষ্ট্রের মুখ্য গুণ-বৈশিষ্ট্য সংশ্লিষ্ট অরিজিনাল শব্দ ও ধারণাটা হলো ‘রিপাবলিক’।

এর প্রমাণ একমাত্র রাজা-বাদশাদের রাজতান্ত্রিক দেশ ছাড়া, বাকি প্রায় সব দেশের নামের মধ্যে কমন যে শব্দটা সবাই বয়ে বেড়ায়, তা হলো ‘রিপাবলিক’। সেই রাষ্ট্র কমিউনিস্ট কি ইসলামিস্ট কিংবা আধুনিক রাষ্ট্র যাই হোক না কেন। এসব রাষ্ট্র যখন প্রথম কায়েম হয়েছিল- এমন সবখানেই নামের মধ্যে রিপাবলিক শব্দ থাকতে দেখা যায়, এটা এমনই কমন। আসলে ডেমোক্রেসি শব্দটার পিছনে বড় সক্রিয়তা ছিল আমেরিকার –তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে বেকায়দা ফেলার দরকারি স্বার্থ। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নও নিজেকে এক ‘রিপাবলিক’ রাষ্ট্র মনে করে ও দাবি করে এবং শব্দটা তার রাষ্ট্রের নামের মধ্যেই ছিল। ওর পুরা নাম ছিল ইউএসএসআর এবং এই ‘আর’ মানে হলো রিপাবলিক। কিন্তু কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে জন্ম থেকেই ওপেন সর্বজনীন অবাধ নির্বাচন অথবা পাবলিক রিপ্রেজেন্টেশন (জনপ্রতিনিধি নির্বাচন) বলতে কিছুই ছিল না। আর সেটাকেই পুঁজি করে একে নেতিবাচক হাইলাইট করতে আমেরিকার গণতন্ত্র শব্দটাকে সামনে আনা যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের মতোই এক রিপাবলিক রাষ্ট্র বলে দাবি করতে পারে; কিন্তু এখানে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ নেই- মানে নির্বাচন নাই; দেখ! অর্থাৎ আমেরিকার দাবি হলো রাষ্ট্রের নামে রিপাবলিক শব্দ থাকলেও এদের রাষ্ট্রে তথাকথিত ‘গণতন্ত্র’ নেই।

এ কারণে, জেনে না জেনে ভারত ‘সর্ববৃহৎ ডেমোক্রাসির’ দেশ বলে গর্ব করা- এটা হচ্ছে এখানে নাগরিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয় কিনা, এটা নাগরিক নির্বিশেষে সমকালে সমান মর্যাদা ও অধিকারের রিপাবলিক কিনা এসব কিছু বাদ দেয় ও অগুরুত্বপূর্ণ করে ফেলে। ভারতে কেবল একটা নির্বাচন হয় কী না এটাই একমাত্র বিবেচ্য করাই হচ্ছে এই ‘সর্ববৃহৎ ডেমোক্রাসি’ বলার না বুঝ বা অবুঝদের বলাবলি। অথচ স্বাধীন ভারত জন্ম থেকে তো বটেই, এমনকি অখণ্ড ভারতের রাষ্ট্রবিষয়ক চিন্তার প্রথম উন্মেষের সময় (১৮১৫) থেকেই রাষ্ট্র বলতে বুঝা হয়েছিল কেবল এক হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র ধারণাকেই। অর্থাৎ শুধু জাতি-রাষ্ট্র নয়, বরং এখানে ‘জাতি’ বলতে মনে করা হয়েছে একটা ধর্মীয় জাতি। ফলে এরপর এই রাষ্ট্রের নাগরিকের তো আর সর্বজনীনভাবে এবং সমান নাগরিক-অধিকারের নাগরিক হওয়ার আর সুযোগ থাকেনি। বরং বৈষম্যমূলকই হবে। এক কথায়, ভারত জন্ম থেকেই সম-নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। কারণ হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র করে গড়ে তোলা রাষ্ট্র মানে, তা আর নাগরিক অধিকারভিত্তিক রাষ্ট্র নয়। এ কারণে সেই হিন্দু জাতি-রাষ্ট্র ধারণাকেই আকড়ে ধরার মাধ্যমে সেকালে হবু পাকিস্তানকেও যেন ঠেলে দেয়া হয়েছিল আরেক ধর্মভিত্তিক জাতি-রাষ্ট্র হতে; বাধ্য করা হয়েছিল।

অথচ এই চরম বৈষম্যমূলক অসম-নাগরিকের এই রাষ্ট্রেও যেহেতু নিয়মিত নির্বাচন হয় কাজের এটা দুনিয়ার ‘সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের’ বলে মিথ্যা ঢোল পিটানোর সুযোগ নেয়া চলছে। আরএসএস বা বিজেপির মতো দল চালু করে ফেলা যাচ্ছে সহজেই, বিনা বাধায়। ভারতের কনস্টিটিউশন, আদালত অথবা নির্বাচন কমিশনের কোনো বাধা ছাড়াই মোদির মতো লোক দল খুলছেন, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। অথচ কেউ মুসলমান নাগরিক হলে তাকে রাস্তায় ফেলে মাটিতে শুইয়ে বুকের খাঁচার ওপর লাফ দিয়ে উঠে তাকে নির্যাতন-জবরদস্তিতে ‘জয় শ্রীরাম’ বলাতে চেষ্টা করছে বিজেপি-আরএসএস।

তবু রবি কান্তের দুনিয়ার ‘সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের’ রাষ্ট্র বলে করা অন্ধ প্রশংসাকে পাশ কাটিয়ে যাবো, মূল প্রসঙ্গে প্রবেশ করার খাতিরে। রবির মূল অভিযোগ কোনো রাষ্ট্র মুখ্য যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগত প্রতিষ্ঠানের উপরে ও কারণে টিকে থাকে, যেমন বিচার বিভাগ বা নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি; ভারতে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোর আর পাবলিক বিশ্বাসযোগ্যতা নেই, শেষ হয়ে গেছে (বলেছেন, ডেথ অব ইন্ডিয়াস ক্রেডিবল ইসস্টিটিউশন্স)।
ভারতে নির্বাচন কমিশনের ভোট নেবার পদ্ধতি ইভিএম বা ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনভিত্তিক। এই মেশিন নিয়ে কারচুপির অভিযোগ অনেক দিনের, বিশেষ করে মোদি সরকারের ক্ষমতায় আসার পর থেকে এই সন্দেহ-অভিযোগ আরো সুনির্দিষ্ট। আগামীতে হঠাৎ কোনো একদিন যদি গত ২০১৯ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সাধারণ নির্বাচনে মোদি ইভিএম মেশিন ম্যানিপুলেট করে ক্ষমতায় এসেছিলেন বলে প্রমাণ সামনে হাজির হয়ে যায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

‘মোদির নির্বাচনী সফলতার গোপন দিক’ এই উপ-শিরোনামে রবি কান্ত লিখছেন, ‘সাম্প্রতিককালে নির্বাচন কমিশন ও ইভিএমের বিরুদ্ধে তোলা সব অভিযোগ কমিশন কেবল ভিত্তিহীন বলে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এতে সর্বশেষ বিহারের নির্বাচনে (অনুষ্ঠিত হয় গত অক্টোবর শেষে, যার ফলাফল আসে ১০ নভেম্বর) কমিশনের ওপর মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সে আর নিরপক্ষে কিনা সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে। এই নির্বাচনে বিজেপি ও তার জোট ছাড়া প্রায় সবাই ব্যাপক ভোটবাক্স কারচুপির অভিযোগ তুলেছিল। এখানে আগে ক্ষমতাসীন ছিল মুখ্যমন্ত্রী নীতিশের স্থানীয় ‘জনতা দল’ আর এর সাথে বিজেপির জোট মিলে তারা ক্ষমতায় ছিল। আর এবার কারচুপির অভিযোগ নিয়ে নীতিশের দলের জোট জিতেছে বলে দেখানো হয়েছে এভাবে যে, নীতিশের দলে হারের ঢল নেমেছে কিন্তু একা বিজেপি এবার তার চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। তাই জোট হিসেবে নীতিশ জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। তাই রবি কান্ত প্রশ্ন তুলেছেন, নীতিশের দল ভোট না পেয়ে গোহারা হারলে সেই ভোট কিভাবে একই জোটসঙ্গী একাই ততোধিক আসন পেয়ে যায়?

তাই রবি কান্ত ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে বলছেন, ‘ভোটিং মেশিনের সবচেয়ে অস্বচ্ছ অংশটা হলো ওর সফটওয়্যার যা টেকনিক্যাল, জটিল ও প্রায়শ যাচাই পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ নেই।’ আসলে প্রত্যেকটা সফটওয়্যার মানে, ওর সোর্স কোড থাকবে। আর সোর্স কোডে কে কে ঢুকেছে (এর অটো রেকর্ড থেকে যায়) তা দিয়ে জানা যাবে কে কে এ মেশিনে হাত ঢুকিয়েছে। এ কারণে রবি বলছেন, ‘উন্নত দেশে নির্বাচনী মেশিনের সফটওয়্যারের সোর্স কোড অ্যাকসেস-এর নিরপেক্ষ বিশ্বাসযোগ্য থার্ড পার্টিকে দিয়ে ইন্সপেকশন করিয়ে সেই রিপোর্টটাও কমিশনের সাইটের প্রথম পাতায় লটকে দেয়া থাকে। এর সোজা মানে হলো, পাবলিক কেউ না চাইতেই কমিশন নিজেই দায়িত্ব অনুভব করে নিজের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার প্রমাণ প্রকাশ্যে হাজির করে রাখে।

রবি কান্তের তাই দাবি, ‘ভারতের ইভিএম প্রচণ্ড মাত্রায় এক অস্বচ্ছ ব্যবস্থা।’ এ কারণে ‘এখানে এসব অডিট রিপোর্টের কোনো হদিসই নেই, পাবলিককে কোনো তথ্যও দেখা হয় না’- এটা চলতে পারে না। ভারতের নির্বাচন কমিশন এটা করতেই পারে না।

‘সম্প্রতি এ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটা মামলা হয়েছিল যে, এসব ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্য কোনো থার্ড পার্টিকে দিয়ে ইন্সপেকশনের ব্যবস্থা করানো ও সেই রিপোর্ট প্রকাশ না করাতে কমিশনের স্বচ্ছতা নিয়ে নির্বাচনী বিধিভঙ্গ করা হচ্ছে যাতে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। আর এটা না করাতে ইচ্ছামতো নির্বাচনী ফলাফল বের করার সুযোগ রেখে দেয়া হয়েছে।’ রবি বলছেন, ‘অথচ এত শক্ত যুক্তি তুলে ধরার পরও সুপ্রিম কোর্ট ওই আবেদন খারিজ করে দিয়েছে। আর এরপর, নির্বাচন কমিশনের ওপর করণীয় বলে কোনো আদেশ না দিয়েই বরং উলটা ওই আবেদনকারীকে আবার নির্বাচন কমিশনের কাছে ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছিল। আবেদনকারীকে পরামর্শ দিয়েছিল, কমিশনকে নিরপেক্ষ অডিট করানোর আর ফলাফল পাবলিক করতে যেন তিনি সদয় আবেদন করেন। কোর্ট বাদিকে ফিরিয়ে দিয়েছে এই বলে যে, বাদি যেন কমিশনের কাছে আবার আবেদন জানায়।

আর এতে কমিশনের ব্যবস্থা নিলে আর তা থেকে নতুন যে ফলাফল প্রকাশিত হবে এর তিন সপ্তাহের পরে আবেদনকারী চাইলে আবার আদালতে এসে কোনো আবেদন করতে পারবে।’ তাই এবার রবি কান্তের পিনপয়েন্ট করে অভিযোগ করেছেন, কিন্তু সেই থেকে বাদি কমিশনে আবেদন করলেও ‘আজ পর্যন্ত কমিশনই এ নিয়ে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এতে কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ।’

এদিকে আরেক ঘটনা হলো, গত প্রায় তিন-চার বছর ধরে বিশেষ করে গত ২০১৯ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের একমাত্র এক কমিশনার অশোক লাভাসা তিনি বাকি কমিশনারের সাথে দ্বিমত পোষণ করে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে যাচ্ছিলেন। ইস্যুটা ছিল, মোদি-শাহের বিরুদ্ধে ওঠা নানান নির্বাচনী আইনভঙ্গের কমপ্লেন যার অধিকাংশের ওপর বাকি কমিশনারেরা মোদি-শাহকে ক্লিনচিট দিলেও লাভাসা তাদের এই কাজের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে চলছিলেন উপনির্বাচন কমিশনার অশোক লাভাসা। আর এতেই মোদি সরকার লাভাসার স্ত্রীর যিনি ব্যাংক কর্মকর্তা তার বিরুদ্ধে ভারতের সিবিআই (আমাদের দুদুকের মতো তবে বড় ও সিরিয়াস ভার্সান বলা চলে) লাগিয়ে হেনস্থা করতে থাকেন। শেষে এ বছর জানা যাচ্ছে শেষে নিজেকে বাঁচাতে নির্বাচন কমিশনার লাভাসা এবার কমিশন ছেড়ে অন্য সমতুল্য সরকারি পোস্টে ট্রান্সফার নিয়েছেন।

আর এখান থেকেই আশঙ্কা তৈরি হয়েছে যে আগামী পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে কারচুপি হবে এবং মোদির বিজেপি জিতেছে এমন ফলাফল আসছে। কারণ, এই অবস্থায় একই কারচুপির কায়দায় এরপর আগামী বছরের সম্ভবত এপ্রিলে কলকাতায় রাজ্য নির্বাচনে যদি মোদি রাজ্য সরকারে নিজ দলকে বিজয়ী দেখান তাতে অবাক হওয়ার কিছু কি থাকবে?

দেখা যাচ্ছে, রবি কান্তের ভারত, যেটা ‘সর্ববৃহৎ ডেমোক্রাসির’- এমন ফুটা গর্ব যাই থাক সেই গৌরবের ভারত নিয়ে তিনি এখন কী করবেন সে এক বিরাট প্রশ্ন হয়ে উঠে আসছে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

goutamdas1958@hotmail.com

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us