লোহিত সাগরে আমিরাতের 'গ্রেট গেম'
আমিরাতের নৌবহর - ছবি : সংগৃহীত
ইসরাইলের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক স্থাপন ছাড়াও উপসাগরীয় অঞ্চলে আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রচেষ্টা এবং যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইয়েমেনে দেশটির কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিয়ন্ত্রকদের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।
গত পাঁচ বছর ধরে বাব এল-মান্দেব ও সোকোত্রা দ্বীপে সামরিক স্থাপনা নির্মাণ ও আরব সাগর জুড়ে ইয়েমেনের দক্ষিণ উপকূলের নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে সংযুক্ত আরব আমিরাত লোহিত সাগরে একটি উচ্চাভিলাষী কৌশলগত এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টায় আছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনে তাদের সামরিক পদক্ষেপ হ্রাস করলেও দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থান পাকাপোক্ত করেছে দেশটি। সিকিউরিটি বেল্ট ফোর্সেস, শাবওয়ানি ও হাদরামি এলিট ফোর্সেস, আবু আল-আব্বাস ব্রিগেড এবং ওয়েস্ট কোস্ট ফোর্সেসের মতো বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাজার হাজার ইয়েমেনি যোদ্ধাদের অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রেখেছে আরব আমিরাত।
এই মিলিশিয়া বাহিনীগুলো বৈধ সরকার ব্যবস্থার বাইরে স্বতন্ত্রভাবে কাজ করে। এমনকি তারা সরকারকে চ্যালেঞ্জও করছে।
২০২০ সালের এপ্রিলে সাউদার্ন ট্রানজিশন কাউন্সিল (এসটিসি) নামে পরিচিত আমিরাত-সমর্থিত বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী দক্ষিণের প্রদেশগুলোতে তাদের স্ব-শাসিত প্রশাসনের ঘোষণা দেয়। ইয়েমেনের সরকার তাদের এই ঘোষণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে এটিকে ‘দেশকে বিভক্ত করা এবং দেশের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের’ প্রচেষ্টা বলে আখ্যায়িত করেছে।
এর আগে এডেনে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত, যাতে ৩০০ জনেরও বেশি সেনা ও বেসামরিক লোক নিহত ও আহত হয়েছিল। সৌদি আরব-সমর্থিত প্রেসিডেন্ট আবদ রাব্বুহ মনসুর হাদির নেতৃত্বাধীন ইয়েমেনের বৈধ সরকার বারবার অভিযোগ করেছে যে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনের সোকোত্রা দ্বীপ দখল করার চেষ্টা করছে এবং এদেন, বাব এল-মান্দেব, মুকাল্লা, হাদিবোহ, মাজুন নামে পরিচিত পেরিম দ্বীপ, এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের একমাত্র এলএনজি গ্যাস টার্মিনাল বালহাফে দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল নিয়ন্ত্রণ করছে।
এই অঞ্চলগুলো নিয়ন্ত্রণকারী মিলিশিয়ারা সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনুগত এবং বৈধ সরকারের বিরোধী। ইয়েমেনের স্থল ও সমুদ্রসীমা নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি, আরব আমিরাত হর্ন অভ আফ্রিকাসহ লোহিত সাগরের কৌশলগত সামুদ্রিক পয়েন্টেও প্রবেশ করেছে। সোমালিল্যান্ডের বার্বেরা বন্দর, ইরিত্রিয়ার আসাব বন্দর, জিবুতির বন্দর, সোমালিয়ার বোসাসো ও মোগাদিসু বন্দরগুলোর উপর প্রভাব বাড়ানোর জন্য এটি লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরের আফ্রিকান দেশগুলোর সাথে চুক্তি নিশ্চিত করেছে।
সরাসরি বাব এল-মান্দেবে অবস্থিত ছোট্ট বন্দর শহর আল-মোখা হলো আরব উপদ্বীপ এবং আফ্রিকার মধ্যবর্তী সবচেয়ে সরু পয়েন্ট এবং লোহিত সাগরের প্রবেশদ্বার। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে হাউছি মিলিশিয়া বাহিনী থেকে দ্বীপটি মুক্ত করেছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত-সমর্থিত ইয়েমেনি বাহিনী। তখন থেকে হোদেইদা এবং তাইজ প্রদেশের মধ্যবর্তী অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো একমাত্র শাসক শক্তি। এটি পশ্চিম উপকূলে জায়ান্টস ব্রিগেড এবং তিহামা ব্রিগেডের নামে মিলিশিয়াদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই মিলিশিয়ারা ইয়েমেনের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহের ভাগ্নে গার্ডস অভ দ্য রিপাবলিকের নেতা তারেক সালেহের অনুগত।
সালেহের মিলিশিয়া বাহিনীকে সমর্থন
আনাদোলু এজেন্সির সাথে কথা বলতে গিয়ে হোদেইদার এক ইয়েমেনি সাংবাদিক আবদুল হাফেজ আলহাতামি বলেছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন অন্যদের বাদ দিয়ে ক্রমাগতভাবে তারেকের বাহিনীকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘সংযুক্ত আরব আমিরাত ২০১৯ সালে জায়ান্ট ব্রিগেড এবং তিহামা ব্রিগেডকে গার্ডস অভ দ্য রিপাবলিকের সাথে দলবদ্ধ করতে বাধ্য করার জন্য তাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং আর্থিক সহায়তাসহ সামরিক সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে।’
তিনি প্রকাশ করেন, সংযুক্ত আরব আমিরাত জায়ান্ট ব্রিগেডের কমান্ডার আবু জারাহ আল-মুহাররামিকে তলব করে এবং সালাহের বাহিনীর হাতে পশ্চিম উপকূলের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। তিনটি বাহিনীর ক্যাডারদের সমন্বয়ে যৌথ মিলিশিয়া বাহিনী গঠনের পিছনেও ছিল দেশটি। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত ইয়েমেনের পশ্চিম উপকূল নিয়ন্ত্রণকারী এই যৌথবাহিনীর একজন নতুন কমান্ডার নিযুক্ত করেছে।
সূত্র জানায়, এই হস্তান্তর প্রক্রিয়াটি উপকূলীয় শহর মোখায় হয়েছিল। নতুন কমান্ডারকে মিলিশিয়া নেতাদের মধ্যে বিরোধের সমাধান এবং এই অঞ্চলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপস্থিতির বিরোধিতাকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে দৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, সংযুক্ত আরব আমিরাতের পদক্ষেপগুলো ইয়েমেনের সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং লোহিত সাগরের পশ্চিম তীরের আফ্রিকান রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বন্দর এবং সামরিক ঘাঁটি সংক্রান্ত চুক্তিগুলো সম্পাদিত হওয়ার পর সংযুক্ত আরব আমিরাতের ইয়েমেনের কাছে এই মূল্যবান বন্দরগুলো ফেরত দেয়ার সম্ভাবনা নিতান্তই কম।
ইয়েমেন ডেটা প্রজেক্টের তথ্য অনুসারে, যুদ্ধের পর থেকে ইয়েমেনের উপর ২২ হাজার ১৮০টিরও বেশি বিমান হামলা চালিয়েছে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বাধীন জোট। যা প্রতিদিন গড়ে ১০টিরও বেশি। অধিকন্তু, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অবৈধ জোটের কমপক্ষে ৯০টি বিমান হামলার দলিল করেছে। যেগুলো বাড়িঘর, বাজার, হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ এবং আটক কেন্দ্রগুলোতে আঘাত করেছিল। কিছু হামলা যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আনাদোলু এজেন্সির সাথে একান্ত বক্তব্যে ইয়েমেনের মানবাধিকার কর্মী তাওফিক আলহামিদি বলেছেন, পশ্চিম উপকূলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাহিনী মোখা বন্দর বন্ধ করে দেয়া, ধুবাবের বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করা এবং পেরিম দ্বীপে সামরিক ঘাঁটি স্থাপনের মতো অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
‘তারা গোপন কারাগার স্থাপন করেছে, মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে এবং চোরাচালানের অনুমোদন দিয়েছে। এই সমস্ত পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে ইয়েমেনকে পৃথক করবে এবং একটি অস্থিতিশীল রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি তৈরি করবে,’ বলছিলেন আলহামিদি।
মিলিশিয়াদের হাতে মার্কিন অস্ত্রশস্ত্র
সিএনএন ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে বিক্রিত মার্কিন অস্ত্র ইয়েমেনের মিলিশিয়াদের নিকট হস্তান্তরের সত্যতা খুঁজে পেয়েছিল। এগুলোর মধ্যে টেক্সাসে নির্মিত অর্ধ ডজন এমআরএপি অল-টেরিয়ান ভেহিকলস অন্তর্ভুক্ত ছিল। এগুলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে জোটবদ্ধ জায়ান্ট ব্রিগেডের নিকট স্থানান্তর করা হয়েছিল।
বৈধ সরকারের বিরোধী শক্তি সংযুক্ত আরব আমিরাতকে খুব কমই হতাশ করেছিল, অনেক সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপর এর শক্তিশালী প্রভাব পড়ে। ‘বৈধ সরকার ক্ষমতাহীন। এটি ইয়েমেনের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করেনি, সেনাবাহিনীকে বোমা মারা এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দ্বীপপুঞ্জ ও শহরগুলোকে রক্ষা তো অনেক দূরের কথা,’ আলঘামদি বলেছিলেন।
বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাহিনীর স্বার্থকে হ্রাস করে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আন্তর্জাতিক নৌ-বাণিজ্য লেনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা লোহিত সাগর জুড়ে জটিল পরিস্থিতির ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। ইয়েমেনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কর্মকাণ্ডগুলো প্রাচীন কথা ‘শেষ অবস্থাই পন্থাগুলোর বৈধতা দেয়’ এর অনুসরণে দেশটির আত্মকেন্দ্রিক কৌশলগত পরিকল্পনার উদাহরণ মাত্র। প্রাচীন কথাটির মানে হলো, চূড়ান্ত লক্ষ্যটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, এটি অর্জনের যেকোনো উপায়ই গ্রহণযোগ্য।
সূত্র : আনাদোলু এজেন্সি