দুই ভ্যাকসিনে মিল-অমিল
দুই ভ্যাকসিনে মিল-অমিল - ছবি সংগৃহীত
এখন পর্যন্ত ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র বায়োনটেক-ফাইজার ভ্যাকসিন অনুমোদন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র মডার্নার টিকাও অনুমোদন করেছে। ইইউ হয়তো জানুয়ারির মাঝামাঝি নাগাদ মডার্না প্রতিষেধক চালুর অনুমতি দিতে পারে।
করোনার আরো প্রতিষেধকও অনুমোদন পাওয়ার পথে। এখানে ভ্যাকসিন নিয়ে যে সব প্রশ্ন হামেশা করা হয়, তার জবাব দেয়া হলো।
দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভ্যাকসিন আলাদা হয় কীভাবে?
যে দুইটি ভ্যাকসিন চালু হয়েছে, তারা তথাকথিত এমআরএনএ ভ্যাকসিন। তারা মানুষের শরীরে ভ্যাকসিনের প্রোটিন রেপ্লিকেট করে। শরীরে তখন ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু দুটি ভ্যাকসিনের মধ্যে কিছু পার্থক্য আছে। মডার্নার ভ্যাকসিন সাধারণ ঘরোয়া ফ্রিজে ৩০ দিন পর্যন্ত রাখা যায়।
মডার্নার ভ্যাকসিন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য মাইনাস ৭০ ডিগ্রি তাপমান লাগে না। কিন্তু বায়োনটেক-ফাইজারের ভ্যাকসিনের জন্য লাগে। তবে ব্যবহার করার আগে এই ভ্যাকসিন পাঁচ দিন ফ্রিজে রাখা যায়।
কেন এই প্রতিষেধক ভ্যাকসিন সেন্টারে দেয়া হয় বা কেয়ার হোমে মোবাইল টিম দেয়?
আসলে এই ভাবে ফ্রোজেন বায়োনটেক-ফাইজার ভ্যাকসিন পেশাদারভাবে তৈরি করা এবং তা দেয়ার জন্যেও পেশাদার মানুষ প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞেরা পাঁচটি ভ্যাকসিন ডোজ একবারে উষ্ণ করতে পারেন।
এই জটিল প্রক্রিয়ার জন্যই যে সব বয়স্করা একা থাকেন, তাদের বাড়ি গিয়ে ভ্যাকসিন দেয়া হয় না। অন্তত এখন তা দেয়া হচ্ছে না।
তাছাড়া যাদের ভ্যাকসিন নেয়া জরুরি, তাদের পক্ষেও ভ্যাকসিন সেন্টারে যাওয়া সহজ।
কখন দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে?
তিন সপ্তাহের ব্যবধানে দ্বিতীয় ডোজ নিতে হবে। বায়োনটেক-ফাইজার ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ ১৭ থেকে ২১ দিনের মধ্যে নিতে হয়। এর পরেও দ্বিতীয় ডোজ নেয়া যায়। তবে সময়ের মধ্যেই তা নেয়া ভালো।
দ্বিতীয় ডোজে কি অন্য ভ্যাকসিন নেয়া যায়?
না। প্রথম ও দ্বিতীয়বার একই ভ্যাকসিন নিতে হবে। এই মুহূর্তে রেগুলেটরদের কাছে বিভিন্ন ভ্যাকসিন সম্পর্কে খুব বেশি অভিজ্ঞতা বা পরীক্ষার ফল হাতে নেই। তাই মানুষ যেন এই ঝুঁকি না নেন।
করোনা হওয়া সত্ত্বেও কি ভ্যাকসিন নেয়া জরুরি?
যাদের করোনা হয়েছে, তাদেরও ভ্যাকসিন নেয়া জরুরি এবং তাদের প্রতিষেধক দেয়া হচ্ছে। কারণ, একবার করোনা হলে যে তা আবার হবে না বা নির্দিষ্ট সময়ের পরে হবে না, এরকম কোনো পরীক্ষিত তথ্য হাতে নেই।
তবে যাদের করোনা হয়েছে, জ্বর আছে বা সর্দি হয়েছে, তাদের তখনই ভ্যাকসিন দেয়া উচিত নয়। সেরে যাওয়ার পর দেয়া উচিত।
কোয়ারান্টিনে থাকা মানুষদেরও ভ্যাকসিন দেয়া উচিত নয়। কারণ, তারা করোনায় আক্রান্ত এক বা একাধিক মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন। কোয়ারান্টিনের সময় শেষ হলে তাঁদের ভ্যাকসিন দেয়া উচিত।
যারা প্রতিষেধক নিতে চান, তাদের ভ্যাকসিন দিতে কত সময় লাগবে?
সব মানুষকে ভ্যাকসিন দিতে কয়েক বছর সময় লাগবে। উন্নত দেশগুলোতেও সময় লাগবে। ২০২২ এর আগে অন্তত সব মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব নয়।
জার্মানির উদাহরণ নেয়া যাক। স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের আশা, ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে বায়োনটেক-ফাইজারের এক কোটি ৩০ লাখ ভ্যাকসিন তারা পাবেন। প্রত্যেককে দুটি করে ডোজ দিতে হবে। তা হলে ওই সময়ের মধ্যে মোট জনসংখ্যার দশভাগের একভাগকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে।
বায়োনটেকের সিইও ডিডাব্লিউকে বলেছেন, তার কোম্পানি ও ফাইজার আগামী বছর ১৩০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন তৈরি করবে।
যদি আরো ভ্যাকসিন বাজারে আসে, তা হলেও বিশ্বের ৭৮০ কোটি লোককে দিতে অনেক সময় লাগবে। তবে বয়স্ক মানুষ বা যাদের অন্য রোগ আছে, তাদের আগামী বছর গরমের আগে ভ্যাকসিন দেয়া সম্ভব হবে।
কাদের ভ্যাকসিন দেয়া ঠিক নয়?
সাধারণত এই সিদ্ধান্ত চিকিৎসকরা নেবেন। কারো যদি কিছু বিশেষ লক্ষণ থাকে, তা হলে তাঁদের ভ্যাকসিন দেয়া উচিত কি না, সেটা তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে জানাবেন। অর্থাৎ, কারো বিশেষ ধরনের অ্যালার্জি থাকলে বা অ্যানাফিল্যাকটিক শক পেলে তাঁকে ভ্যাকসিন দেয়ার বিষয়টি চিকিৎসকরা ভেবে দেখবেন।
কিন্তু যাদের সাধারণ অ্যালার্জি আছে, তারা এই ভ্যাকসিন নিতে পারবেন। ডায়াবেটিস, ওবেসিটি বা যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে গেছে, তারাও ভ্যাকসিন নেবেন। কারণ, তাদের করোনা হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
বাচ্চাদের ভ্যাকসিন দেয়া যাবে?
বায়োনটেক বা মডার্নার ভ্যাকসিন কেবলমাত্র ১৬ বছরের বেশি বয়সীদের দেয়ার অনুমতি এখনো পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।
গর্ভবতী নারীদের সম্পর্কে কোনো বিশেষ সতর্কতা?
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এমআরএনএ ভ্যাকসিন গর্ভবতী নারীদের কোনো ক্ষতি করবে না। তাদের বাচ্চাদেরও নয়। তবে জন্তুদের উপর এই নিয়ে পরীক্ষা চলছে। এই মুহূর্তে তাই চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করেই এবং করোনা সহ সব ধরনের ঝুঁকির কথা বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত হবে। মায়েরা কতটা মেশেন, তাদের করোনা হওয়ার সম্ভাবনা কতটা, সে সবই বিবেচনা করতে হবে।
ভ্যাকসিনের কি প্রতিক্রিয়া হতে পারে?
ভ্যাকসিন নেয়ার পর এখনো পর্যন্ত খুব হালকা বা মাঝারি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সাময়িকভাবে জায়গাটা ফুলে যাচ্ছে। মাথা ধরছে। ক্লান্ত লাগছে। জ্বরও হচ্ছে। প্রথম তিন দিন এই প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তার পরের দুই দিনের মধ্যে তা ঠিক হয়ে যাচ্ছে।
এর চেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া হয় যে সেন্টার থেকে তিনি ভ্যাকসিন নিয়েছেন, সেখানে বা ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। তারা তখন রেগুলেটরি অথরিটিকে জানাবেন।
নতুন ধরনের করোনা ভাইরাসকেও কি ভ্যাকসিন আটকাবে?
সম্ভবত আটকাবে। বায়োনটেকের সিইও বলেছেন, তাঁরা ২০টি বিভিন্ন ধরনের করোনা ভাইরাসের উপর ভ্যাকসিনের পরীক্ষা করেছেন। শেষতম যে ভ্যাকসিন যুক্তরাজ্যে দ্রুত ছড়াচ্ছে, তার উপরেও পরীক্ষা করা হয়েছে। ভ্যাকসিন কাজ করেছে।
করোনা ভ্যাকসিন নেয়ার পর অন্য রোগের প্রতিষেধক নেয়ার জন্য কতদিন অপেক্ষা করতে হবে?
ইনফ্লুয়েঞ্জা, মাম্পস, মিসলস, রুবেলা, টিটেনাসের ভ্যাকসিন ১৪ দিন পরে নেয়া যাবে। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে এই সময় রাখা হয়েছে।
যদিও চিকিৎসকরা মনে করেন, দুই ধরনের ভ্যাকসিন একসঙ্গে নিলেও কোনো সমস্যা হবে না। তবে এটা প্রমাণ করার মতো কোনো তথ্য হাতে নেই। তাই সাবধান হওয়াই ভালো।
ভ্যাকসিন কি হালাল?
এর জবাব ধর্মীয় বিশেষজ্ঞরা দিতে পারবেন। টাইমস অফ ইন্ডিয়াকে ফাইজার, মডার্না ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, ভ্যাকসিনে শূকরের কোনো প্রোডাক্ট ব্যবহার করা হয়নি।
ভাাকসিন নেয়ার পরও কি হাত ধুয়ে যেতে হবে, মুখে মাস্ক পরতে হবে?
দুই ডোজ ভ্যাকসিন নেয়ার পর করোনার হাত থেকে ৯৫ শতাংশ বাঁচা যাবে বলে প্রস্তুতকারকরা দাবি করছেন। তা সত্ত্বেও ভ্যাকসিন নেয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি পালন করা উচিত এবং মাস্ক পরা উচিত হবে।
ভ্যাকসিনের প্রভাব কত দিন স্থায়ী হবে, সে পরীক্ষা এখনো হয়নি।
সূত্র : ডয়চে ভেলে