চোখের যেসব সমস্যা ফেলে রাখবেন না
চোখের যেসব সমস্যা ফেলে রাখবেন না - ছবি সংগৃহীত
ঘটনা এক- মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোক। রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে নেই। রয়েছে ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথির মতো চোখের জটিল রোগ। অসুখ পৌঁছে গিয়েছিল অ্যাডভান্স স্টেজে। প্রতি তিন মাস অন্তর তার চেক-আপে আসার কথা। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তিনি নির্দিষ্ট সময়ে হাসপাতালে আসেননি। ফল হলো খুবই খারাপ। এরপর যখন তিনি হাসপাতাল এলেন, তত দিনে হারিয়ে গিয়েছে চোখের দৃষ্টি। অপারেশন করেও উন্নতির আশা থাকল না।
ঘটনা দুই- লকডাউনের মধ্যেই ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির একটি চোখের দৃষ্টি কমে এসেছিল। কিন্তু পরিবারের সকলে এই রোগটির থেকেও করোনা নিয়ে বেশি সতর্ক ছিলেন। ফলে হাসপাতাল আসা হয়নি। এরপর ধীরে ধীরে চোখের দৃষ্টি আরও কমতে থাকে। কয়েক মাস পর তিনি যখন হাসপাতালে আসলেন, ততদিনে চোখের দৃষ্টি অনেকটাই কমে গেছে। চিকিৎসা করেও খুব বেশি লাভ হল না।
ঘটনা তিন—কথা ছিল ছানি অপারেশন করার। কোভিডের বাড়বাড়ন্তে পিছিয়ে গেল অপারেশন। এরপর সবকিছু স্বাভাবিক ছন্দে ফিরলেও রোগী আর সার্জারি করালেন না। ছানি পেকে গেল। অবস্থা এখন অনেকটাই গুরুতর।
এগুলো কয়েকটি উদাহরণ মাত্র। করোনার সঙ্কট চলাকালীন এমন বহু ঘটনার সাক্ষী থেকেছে চোখের হাসপাতালগুলো। লকডাউনে বন্ধ হয়ে গেল সবকিছু। অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলেন সকলে। এরপর মাসের পর পর অবহেলিত হতে থাকল বহু পুরানো অসুখবিসুখ। দাঁত, চোখ, নাক-কান-গলার ডাক্তারসাহেবরাও সতর্ক ছিলেন। সংক্রমণের আশঙ্কায় অনেকের চেম্বারও বন্ধ ছিল।
এরপর কয়েক মাস কাটিয়ে নানা সতর্কতা নিয়ে জনজীবন স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। তারপরও কিছু মানুষ হাসপাতালে আসতে চাইছেন না। ভাবছেন হাসপাতালে ঢুকলেই বোধহয় করোনা জাপটে ধরবে। পুরানো অসুখবিসুখগুলিকে অবহেলা করেই যাচ্ছেন। ভাবছেন, আরও কিছুদিন যাক। তারপর নয় যাবেন। তত দিনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে, একবারও ভেবেছেন? ভেবে দেখেছেন, আরও সময় নষ্ট করলে আমাদের পক্ষেও কিছু হয়তো করারই থাকবে না।
এবার জেনে নেয়া যাক, চোখের কোন কোন রোগের চিকিৎসা এখনই করতে হবে—
ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি— ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথিতে আক্রান্তের সংখ্যা। এই অসুখে রেটিনার উপর শিরা তৈরি হয়। সঠিক সময়ে ব্যবস্থা না নিলে সেই শিরা ফেটে রক্তক্ষরণ হয়। অন্ধ হয়ে যেতে পারেন রোগী। তাই এই রোগাক্রান্তদের নিয়মিত চিকিৎসার আওতায় থাকতে হয়। প্রয়োজনে লেজার সার্জারি করতে হবে। তাহলেই রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই অসুখ থাকলে রোগ ফেলে রাখবেন না। অবিলম্বে ডাক্তারসাহেবের পরামর্শ নিন।
রেটিনাল ডিটাচমেন্ট— কিছু মানুষের রেটিনা ছিঁড়ে যায়। এই সমস্যারই নাম রেটিনাল ডিটাচমেন্ট। হঠাৎ করে চোখে কম দেখাই এই রোগের অন্যতম লক্ষণ। মাইনাস পাওয়ার থাকা মানুষের এই রোগ বেশি হয়। রেটিনাল ডিটাচমেন্টের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা প্রয়োজন। অপারেশন করতে হয়। দেরি হলে দৃষ্টিশক্তির খুব বেশি উন্নতি করা সম্ভব হয় না। মুশকিল হলো, ভুক্তভোগীরাও সমস্যা দেখা দেয়ার এক-দুই মাস পরে চিকিৎসকের কাছে আসছেন। এমনটা করলে কিন্তু বিপদ বাড়বে।
চোখে স্ট্রোক— উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, ট্রাইগ্লিসারাইডস-এর মাত্রা বেশি থাকা, এইসব কারণে চোখে স্ট্রোক হতে পারে। এই সমস্যার প্রধান লক্ষণ হলো চোখে কম দেখা ও যন্ত্রণা। এক্ষেত্রে যত দ্রুত সম্ভব চোখে ইঞ্জেকশন দিতে হয়। তখনই কিছুটা দৃষ্টিশক্তি ফেরে।
ছানি— এখন ছানি অপারেশনের ক্ষেত্রে ফেকো সার্জারি করা হয়। খুব সুরক্ষিত এই সার্জারিতে সহজেই ছানির সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তবে মুশকিল হলো, ছানি পেকে গেলে ফেকো করার সময় নানা জটিলতা আসতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে দৃষ্টিশক্তিও। এছাড়া এক ধরনের ছানি আছে যা সম্পূর্ণ সাদা হয়ে যায়। এই ছানি পাকলে ফেটে গিয়ে ফেকোলাইটিক গ্লকোমা হয়। চোখে অসহ্য ব্যথা নিয়ে রোগী হাসপাতালে আসেন। এই ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতি এড়াতে চাইলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ক্যাটারাক্ট সার্জারি করিয়ে নিতে হবে।
বাচ্চাদের মাইনাস পাওয়ার বৃদ্ধি— এমনিতেই ছোটদের মায়োপিয়া, অর্থাৎ মাইনাস পাওয়ার দ্রুত বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। এর উপর লকডাউনে অনলাইন শিক্ষার সুবাদে মোবাইল ও কম্পিউটারের স্ক্রিন টাইম অনেকটাই বেড়েছে। ফলে পাওয়ার বাড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।
মুশকিল হলো, পাওয়ার বাড়ার পরও কম পাওয়ারের চশমা পরে দেখতে থাকলে পাওয়ার আরো দ্রুত বাড়ে। তাই কোনোভাবে যদি বুঝতে পারেন যে চশমা পরার পরও বাচ্চার দেখতে সমস্যা হচ্ছে, তাহলে আর দেরি নয়। হাসপাতালে এসে পাওয়ার চেক করিয়ে নিন।
যখন চিকিৎসা চাই-ই চাই
চোখে কোনো জোরদার আঘাত লাগলে, কিছু ঢুকে গেলে, অ্যাসিড বা অন্য কোনো রাসায়নিক পড়লে, রক্তপাত হলে ইত্যাদি।
হঠাৎ করে দৃষ্টিশক্তি কমে গেলে।
চোখে হঠাৎ ব্যথা হলে।
সার্জারি বা ইঞ্জেকশনের তারিখ ঠিক করা থাকলে।
গ্লকোমা, ডায়াবেটিস রেটিনোপ্যাথি বা চোখের অন্য কোনো জটিল অসুখ থাকলে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে চিকিৎসা না করালে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
সূত্র : বর্তমান