নেপালকে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছেন ওলি!
কেপি ওলি - ছবি সংগৃহীত
নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি ওলির সুপারিশ অনুমোদন করে কলমের এক খোঁচায় প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভান্ডারি রোববার নেপালের ২৭৫ আসনের পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়েছেন। ৩০ এপ্রিল ও ১০ মে দুই ধাপে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সারা নেপালে রাস্তায় বিক্ষোভ ও সহিংসতা যদি অন্য কোনো অর্থ বহন করে তাহলে দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ বিপন্ন।
ওলির কাজটি নেপাল কমিউনিস্ট পার্টি (এনসিপি)-কে দ্বিখণ্ডিত হওয়ার মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। মাত্র ৪০ মাস আগে দেশের দুই বামপন্থী দল মাওবাদি ও কমিউনিস্টরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলটি গঠন করে। মাওবাদিদের দশক-ব্যাপী বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে। অন্যদিকে কমিউনিস্টদের রয়েছে ২৫ বছরের সংসদীয় রীতি চর্চার কাহিনী।
দুই কমিউনিস্ট পার্টির এক হওয়া ছিলো ছয় দশকের স্বপ্ন পূরণ, যা ২০১৭ সালের নির্বাচনে দলটিকে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিয়েছিলো।
ওলির কঠোর কর্মকাণ্ড দেশকে আবার গোলযোগের পথে ঠেলে দিতে পারে বলে আগেই স্পষ্ট ইংগিত পাওয়া গিয়েছিলো। নিজ দলে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি। ওলি পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন যেন অন্তত আগামী ছয় মাস কেয়ারটেকার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে থাকতে পারেন। এ সময়টিতে তার ক্ষমতা হবে নিরঙ্কুশ এবং জবাবদিহিতা হবে শূন্য।
প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপগুলোর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এনসিপি-কে নিশ্চিত দুই টুকরা করবে। এনসিপি’র কেন্দ্রিয় কমিটির ৪৪১ সদস্যের মধ্যে ২৪১ জন ওলির নেতৃত্বাধিন কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (ইউনাইটেড মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট) থেকে এবং ২০০ জন পুস্প কমল দহল ওরফে প্রচন্ডের কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (মাওয়িস্ট সেন্টার) থেকে এসেছেন। মঙ্গলবার এনসিপি’র অধিকাংশ সদস্য ওলিকে দলের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বহিষ্কার করেন। তার জায়গায় বসানো হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাধব কুমার নেপালকে। পাল্টা জবাবে ওলি দলের মুখপাত্র নারায়নকাজি সেরেস্তাকে বরখাস্ত করেন।
এটা হলো আরো অনেক বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কারের সূচনা মাত্র। এখন নির্বাচন কমিশন ঠিক করবে কোনটি আসল এনসিপি। আগামী সপ্তাহে এই রায় আসতে পারে।
এর আগে এনসিপির দুটি সংসদীয় আসনে দুই ডজনের মতো সহযোগী সংগঠনকে একীভূত করা নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। এনসিপি’র রাজনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন শেষ হয়নি। চুক্তি মতো প্রধানমন্ত্রীত্বের দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রচন্ডের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করেননি ওলি। দলের দুই চেয়ারম্যানের একজন হওয়ার পরও প্রচন্ডকে ওলি কোন দায়িত্ব দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওলির স্বৈরাচারী আচরণের মধ্যে রয়েছে সব তদন্ত সংস্থাকে সরাসরি নিজের অধীনে নিয়ে আসা। এটাই তার বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করেছে। সিনিয়র ক্ষুদ্ধ নেতা মাধব নেপাল এক বিবৃতিতে বলেন, উনি আমাকে ভূমি কেলেংকারিতে জড়িয়ে আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে চান, আমি তাকে ছাড়বো না। তাছাড়া ওলি তার সহকার্মীদের কোনোরকম সম্মান করেন না।
প্রেসিডেন্ট ভান্ডারির বিলাসী জীবন যাপন মিডিয়ায় হেডলাইন হয়েছে। সারা দেশে রাজতন্ত্রপন্থীরা প্রজাতন্ত্রের এই ‘রাজন্যদের’ নিন্দায় সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
ওলির স্বৈরাচারী মনোভাব দেখে একের পর এক সিনিয়র নেতারা প্রচন্ডের সঙ্গে যোগ দিতে থাকেন। দু্ই মাস আগে এনপিসি’র সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রচন্ড ১৯ পৃষ্ঠার ‘রাজনৈতিক প্রস্তাব’ আনেন, তাতে ওলির বিরুদ্ধে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু অনড় ওলি বলেন, প্রচণ্ড এটা প্রত্যাহার না করলে দল এক থাকবে না। তার ভবিষ্যদ্বাণী ফলে গেছে।
অর্ডিন্যান্স জারি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে থাকেন ওলি। তাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দেন প্রেসিডেন্ট ভান্ডারি। সাবেক এই কমরেড আগাগোড়াই ওলির অনুগত। গত সপ্তাহে ওলির এক অর্ডিন্যান্স অনুমোদন করেন ভান্ডারি। এতে কোন নিয়োগের জন্য সাংবিধানিক পরিষদের বৈঠকের কোরাম সংখ্যা ১৩ জন করা হয়। অর্ডিন্যান্স পাস হওয়ার পরপরই ওলি দ্রুত বিভিন্ন সংস্থায় ৪৫ জনকে নিয়োগ দেন। এদের মধ্যে দুর্নীতি কমিশনের প্রধানও রয়েছেন। এই ব্যক্তি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হয়রানি করার জন্য কুখ্যাত।
সংবিধানে সবরকম সম্ভাবনা খতিয়ে দেখার কথা বলা হলেও ভান্ডারি কোনো বিবেচনা ছাড়াই পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়ার ব্যাপারে ওলির প্রস্তাব অনুমোদন করেন।
সুপ্রিম কোর্টে ওলির সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। তারা সংবিধানের বিরুদ্ধে জালিয়াতি ও ক্যু করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এনসিপি-তে ওলি-বিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে নেপালি কংগ্রেস ও সমাজবাদি জনতা পার্টি।
সব মিলিয়ে নেপাল আগামীতে একই সঙ্গে তিন ধরনের আন্দোলন দেখতে পাবে : ওলির পক্ষে, ওলির বিরুদ্ধে এবং রাজতন্ত্রের পক্ষে। এই তিন গ্রুপ কিভাবে একত্রিত হয়ে সমাধান করতে পারবে তার উপর বর্তমান জটিল সমস্যার সমাধান নিহিত। এতে ব্যর্থ হলে নেপালের রাজনীতিতে বিদেশী শক্তিগুলোর নাক গলানো বেড়ে যাবে।
ওলি লড়াকু মনোভাব নিয়ে আছেন। জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে তিনি বলেছেন কিভাবে ২০১৫ সালে সড়ক অবরোধের সময় ও মানচিত্র নিয়ে শক্তিশালী প্রতিবেশী ভারতের বিরুদ্ধে লড়েছেন। তিনি নিজের জাতীয়তাবাদী ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে চেয়েছেন। তিনি সরাসরি ভারতের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। তবে আগামী নির্বাচনে তার মূল প্লাটফর্ম হবে ‘জাতীয়তাবাদ’, সেটা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আগামী মাসগুলোতে ওলি ও ভান্ডারি প্রধান খেলোয়ার হিসেবে থাকলেও তাদের ক্ষয়িষ্ণু নৈতিক শক্তি সড়ক ও আদালতে বিরোধী দলগুলোকে মোকাবেলা করার মতো শক্তিশালী হবে না বলে মনে হয়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও সেবা সরবরাহের জন্য ওলিকে সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক সহায়তা পেতে হবে। তবে একজন অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল বলেন, বৈধ ও সাংবিধানিক না হলে কোন নির্দেশ পালন করতে নেপাল সেনাবাহিনী বাধ্য নয়। অবশ্য, সুপ্রিম কোর্ট কতটা কার্যকর ও নিরপেক্ষভাবে সংবিধানকে ব্যাখ্যা করে ও রায় দেয় তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করবে।
সূত্র : এসএএম