নেপাল সঙ্কটের নেপথ্যে
নেপাল সঙ্কটের নেপথ্যে - ছবি সংগৃহীত
নেপালে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর পরিস্থিতি ভিন্ন রূপ নিয়েছে। শাসক দল নেপাল কমিউনিস্ট পার্টিতে ক্ষমতার অন্তর্দ্বন্দ্বের জেরে বিরোধী নেপাল কংগ্রেসের সাথে মিলে শাসক দলের প্রচন্ড-মাধবপন্থীদের অনাস্থা প্রস্তাব পেশের আয়োজন হচ্ছিল। এর ঠিক আগেই প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলি প্রেসিডেন্টের কাছে সংসদ ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচনের সুপারিশ করেন। প্রেসিডেন্ট বিদ্যাদেবী ভান্ডারি কালবিলম্ব না করে সেই প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন।
এর আগে ওলির ২৫ সদস্যের মন্ত্রিসভা থেকে মাওবাদী সমর্থক সাত মন্ত্রী একযোগে পদত্যাগ করেন। তারা নেপালি কংগ্রেসের সাথে মিলে নতুন কোয়ালিশন গঠনের দিকে যাচ্ছিলেন বলে মনে করা হয়। কে পি ওলির প্রধানমন্ত্রিত্বের আগের মেয়াদের ঘটনার পুনরাবৃত্তির আগেই তিনি সংসদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ করেন। দিল্লি থেকে ভারতীয় সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাদের ঘন ঘন কাঠমান্ডু সফরে মনে হচ্ছিল সেখানে রাজনৈতিক অভ্যুত্থান আসন্ন। চীনের প্রভাবশালী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সফরের পর অস্থিরতা অজ্ঞাত কারণে আরো বেড়ে যায়। আর এখন রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরেছে দেশটিকে। বাইরের শক্তির প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্র বানিয়েছে দেশটিকে। কিন্তু এরপর সংবিধান তৈরিতে সময় নেয়া হয় আট বছর। এরপরও স্থিতি ব্যাহত হচ্ছে বারবার।
দল-উপদলে লড়াই
সংসদ ভেঙে দেয়ার পরদিনই তিনটি পৃথক বৈঠক হয়েছে নেপালে। কে পি ওলি তার অনুগত মন্ত্রীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে বৈঠক করেছেন। পুষ্প কুমার দাহল প্রচন্ড ও মাধব চন্দ্র নেপাল বৈঠক করেছেন তাদের উপদলের মন্ত্রী ও নেতাদের নিয়ে। দল থেকে বহিষ্কার করেছেন প্রধানমন্ত্রী ওলিকে। সে সিদ্ধান্তকে অবৈধ বলে নাকচ করে দিয়েছেন ওলি। আরেকটি বৈঠকের আয়োজন করেন নেপালি কংগ্রেসের নেতা দিউবা বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে। এই টানাপড়েনে সামনে দুটি গন্তব্য লক্ষ করা যায়। প্রথমত, প্রেসিডেন্টের সংসদ ভেঙে দেয়ার আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা। সংসদ ভাঙার পরদিনই সেটি করা হয়েছে নেপাল সুপ্রিম কোর্টে। বিরোধী পক্ষ বলছে, সংসদ ভাঙার এই আদেশে সংবিধান অনুসৃত হয়নি। সংসদ বহাল রেখে সরকার গঠনের অবকাশ নিঃশেষ হয়ে গেলে সংসদ বাতিল করা যেতে পারে বলে তারা মনে করেন। অন্য দিকে ওলির সমর্থকরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে সংসদ বাতিলের এখতিয়ার সংবিধানে প্রেসিডেন্টকে দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের ব্যাখ্যা দেয়ার চূড়ান্ত এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। কোর্ট নির্ধারণ করবে সংসদ বাতিলের আদেশ কার্যকর হয়ে নতুন নির্বাচন হবে নাকি সংসদ বহাল ঘোষণা করে নতুন সরকার গঠনের সুযোগ দেয়া হবে।
পৌনে তিন কোটি মানুষের অন্যতম দরিদ্র দেশ নেপাল এখনো মহামারী নিয়ে লড়াই করছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সারা বিশ্ব থেকে আসা পর্বতারোহীরা এখনো ঘরে বসে আছেন। নেপালের অভিবাসী কর্মীরা বিশ্বের অনেক জায়গায় বেকার হয়ে পড়েছেন। এই চাপ মোকাবেলায় চীন নেপালিদের ইউনানে কাজ করার বিশেষ অনুমতি দিয়েছে। ভারতের সাথে সম্পর্কের টানাপড়েনের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে বেইজিং। অবশ্য নেপালি নাগরিকদের অর্থনৈতিক দুরবস্থা যতটা, গণমাধ্যমগুলোতে ভারতপন্থীদের প্রভাব বেশি থাকায় প্রচারণা হয় তার চেয়ে বেশি।
রাখঢাক নেই চীনা সমর্থনে, ভারসাম্য দিল্লিমুখী
কে পি ওলির সরকারের প্রতি চীনের সমর্থনে কোনো রাখঢাক নেই। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং গত বছর নেপাল সফর করেন। ওলি তার দেশে শি জিনপিংয়ের চিন্তাধারার ওপর প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন এবং মাউন্ট এভারেস্টের জন্য যৌথভাবে একটি নতুন উচ্চতার ঘোষণা দিয়ে বেইজিংয়ের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করেন। চীনের সাথে মহাসড়ক যোগাযোগ প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ। এটি শেষ হলে বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য এককভাবে ভারতের ওপর নির্ভরতা নেপালের কমবে। এ ছাড়া এভারেস্টের নিচ দিয়ে একটি টানেল নির্মাণ করে চীন-নেপাল সংক্ষিপ্ত রুটে বহুপক্ষীয় যোগাযোগের একটি প্রকল্পের কাজও হচ্ছে।
চীনের-নেপাল সহযোগিতার সম্পর্ক সামনে কতটা অব্যাহত থাকবে এ নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে। কোর্টের আদেশে সংসদ বহাল থাকুক অথবা এপ্রিল-মে মাসে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক উভয় ক্ষেত্রে পরিস্থিতি চীনপন্থী প্রধানমন্ত্রী কে পি ওলির পক্ষে যাবে বলে মনে হয় না। ওলি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই জানতেন, তিনি নেপালের প্রধানমন্ত্রী থাকুন তা দিল্লি চায় না। এ কারণে তিনি ভারসাম্য বজায় রাখার পরিবর্তে চীনের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সম্ভব সব পদক্ষেপ নেন। এতে আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয় বড় প্রতিবেশী ভারত। লিপুলেখ কালাপানিকে নেপালের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশ এবং সর্বশেষ অযোধ্যায় যখন বিজেপি সরকার ঘটা করে রাম মন্দির স্থাপনের আয়োজন করছিল তখন রাম জন্মভূমি নেপালে বলে দাবি করে বিজেপি-আরএসএসের বিরক্তি ও ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছেন ওলি।
ফলে ভারত নেপালের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারের সব উপায় উপকরণ সক্রিয় করে তোলে। এই কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি ভারতের সেনাবাহিনীও যুক্ত হয়ে পড়ে দেশটির সেনাবাহিনীতে নেপালি গোর্খা রেজিমেন্ট নিয়ে বিতর্ক তোলার কারণে। নেপাল সরকার প্রকাশ্যে নেপালিদের অন্য দেশের পক্ষে যুদ্ধ করে জীবন দেয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করে। দিল্লিøøর কর্মকর্তারা মনে করছেন, চীনের ইন্ধনে এতদিন পরে নেপাল সরকার এ নিয়ে প্রশ্ন করার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। যদিও এর মাধ্যমে নেপালের প্রায় ৫০ লাখ মানুষের বাইরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতীয় সেনাপ্রধানের নেপাল সফরের সাথে এ ঘটনার যোগ রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এর পরপরই চীনের তিন নম্বর প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাঠমান্ডু সফর করেন। শোনা যায়, ভারতীয় গোর্খা রেজিমেন্টের পুরোটাকে নেপালি সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় পুরো তহবিল বেইজিং দিতে চেয়েছে। কিন্তু ভারতীয় পক্ষ এত দ্রুত রাজনৈতিক দাবার চাল খেলে যে এই বিষয়টি খুব দ্রুত এগোতে পারেনি। তার আগেই ক্ষমতার বিন্যাস এলোমেলো হয়ে যায়।
দিল্লির অক্টোপাস কৌশল!
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে বিশ্লেষকরা ‘অক্টোপাস কৌশল’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ভারত একই সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজ-সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এতে সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বাইরে থেকে অনেকখানি বোঝা যায়। অন্য দিকে চীনের প্রভাব বিস্তারের মুখ্য কৌশল হলো সরকার বা রাষ্ট্র্রের সাথে সম্পর্ক তৈরি এবং আর্থিক বা বিনিয়োগসহায়তা দেয়া। এক সময় দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক মিত্র তৈরির যে কৌশল চীনের ছিল তা দেং শিয়াও পিংয়ের সময় এসে বেশ খানিকটা গৌণ হয়ে যায় আর শি জিনপিংয়ের সময় তা এক রকম হারিয়ে যায়।
চীনের এই নীতিটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষভাবে দেখা যায়। মালদ্বীপে ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে চীন সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। ইয়ামিনের সরকারের পতনের পর বেইজিং নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। সেই প্রচেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। মালদ্বীপের প্রায় সব বিনিয়োগ প্রস্তাব এখন স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। কৌশলগত যেসব সুবিধা আগের সরকারের সময় চীনের ছিল সেসব বাতিল হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীন থেকে ব্যাপক বিনিয়োগসুবিধা গ্রহণ করে। এর বিপরীতে বেইজিংয়ের জন্য কৌশলগত সুযোগ-সুবিধার দ্বারও খুলে দেয়া হয়। কিন্তু রাজাপাকসে নির্বাচনে হেরে গেলে সিরিসেনা- বিক্রমাসিংহের সরকারের সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে বেইজিং। নতুন সরকারের অসন্তুষ্টির কারণ ঘটতে পারে আশঙ্কায় রাজপাকসেকে বিরোধী পক্ষে থাকা অবস্থায় সে রকম কোনো যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। ফলে বিরোধী দলে থাকাকালে রাজাপাকসে চীন-ভারতের সাথে এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। পরের নির্বাচনে রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের দল নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হওয়ার পর আর চীনকে একতরফা সুবিধা দেয়ার নীতি অনুসরণ করছে না।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ বাংলাদেশে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে পরপর ক্ষমতায় থাকা সরকার চীনকে কৌশলগত মিত্র ধরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিন্যাস করে। জিয়া সরকারের সময় সূচিত এই নীতি তাকে হত্যার অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এই চীনপন্থী পরিচয়ের কারণে বিএনপি বারবার ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে। কিন্তু গত ১২ বছর দলটিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে প্রতিপক্ষ দলের উদ্যোগে চীনের সমর্থনের বিষয়টি অজানা নয়। বলা হচ্ছে, বেইজিং বড় বড় প্রকল্প ও বাণিজ্যসুবিধা পাওয়ার জন্য সরকারের ইচ্ছা পূরণ করছে। ফলে একসময় চীনমুখী কৌশলগত নীতি গ্রহণ করে যে রাজনৈতিক দল নানামুখী চাপের মুখে পড়েছে তারা এখন আর চীনের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। তারা দেখছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় কোনো কূটনৈতিক অংশীদার দেশ যেখানে দূতাবাসের কোনো অনুষ্ঠানে দলবিশেষের স্লোগান ব্যবহার করে না সেখানে চীন একমাত্র ব্যতিক্রম।
নেপালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে চীন একই ধরনের ভুল করেছে বলে বেইজিংয়ের নীতিপর্যবেক্ষকদের ধারণা। নেপালের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে এবং দু’দেশের আন্তঃনির্ভরতার বাস্তবতাকে এড়িয়ে এমন নীতি গ্রহণে কাঠমান্ডুর ওলি সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে যাতে মাওবাদীরাই আজ দিল্লির পক্ষে রাজনৈতিক মেরুকরণে প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শাসক দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয়ে সহযোগিতার পরিবর্তে নতুন নতুন প্রকল্প পেতে বেশি তৎপর ছিল বেইজিং। ফলে একসময় চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টির একটি পক্ষ দিল্লির রাজনৈতিক খেলার টুলসে পরিণত হয়েছে। এরপর এমনো দেখা যেতে পারে, চীনের সাথে বহুমুখী সড়ক ও টানেল যোগাযোগের মতো বিরাট প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার পরও ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার পর বেইজিং ওলির সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখবে না। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে পুরনো প্রকল্প এগিয়ে নেয়া আর নতুন প্রকল্প পাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এতে মালদ্বীপের মতোই সব কিছু থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কাই থাকবে বেইজিংয়ের। বিশেষত চীনের প্রভাব প্রতিপত্তিকে তার আঙ্গিনাতেই চেপে ধরার যে কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিয়েছে তাতে চীনপন্থীরা কাঠমান্ডুর ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে সেখানে বেইজিংয়ের জন্য আর কোনো স্পেস থাকবে না।
তবে এটি ঠিক যে, চীনের নেটওয়ার্ক ও কৌশলগত নীতির সবটা সব সময় প্রকাশ্যে হয় না। আর শি জিনপিংয়ের সময় আগের ধারাবাহিকতাও এখন দেখা যায় না। কৌশলগত মিত্রের চেয়েও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বড় হয়ে দেখা যায়। তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের অর্থলোভের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের কমিশন দিয়ে অযৌক্তিক শর্তে কাজ বাগানোর চেষ্টা হয়। রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসে ঋণের বোঝা। এভাবে শাসক দলের নেতা বা প্রভাবশালী নীতি-প্রণেতাদের আনুগত্য কেনার চেষ্টা করা হয়। এই নীতির কারণে অনেক দেশে তাৎক্ষণিকভাবে চীনা প্রভাব বেড়ে যেতে দেখা যায় কিন্তু শেকড়ের অভাবে তা স্থায়ী হয় না। আর ক্ষুদ্র স্বার্থে মানবাধিকার জলাঞ্জলি দেয়ার কারণে এমন অনেক ইস্যু স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয় যা চীনের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সঙ্কট এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার জন্য অনেকে চীনা নীতিকে দায়ী করেন।
চীনা প্রভাবে ভাটির টান!
এসব কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আধিপত্যে আবার ভাটার টান পড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকেই। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর পশ্চিমা প্রভাবকে আবার সুপ্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা নেয়া হতে পারে। দক্ষিণ চীন সাগরে দুটি মার্কিন রণতরী মোতায়েন করে তাইওয়ানের নিরাপত্তা বিধান করা, এই অঞ্চলের সমুদ্রসীমায় আন্তর্জাতিক নৌচলাচল উন্মুক্ত রাখার জন্য সমন্বিত চাপ বজায় রাখা এবং কোয়াডের মতো নিরাপত্তা জোট গঠন করে চীনের প্রভাব সীমিত করার প্রচেষ্টা জোরদার হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ হতে পারে নেপাল ও মিয়ানমার। মিয়ানমারের সু চি দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের পর এমন কিছু সংস্কার পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানা যাচ্ছে যাতে চীনের একতরফা প্রভাব কমে আসতে পারে। ইতোমধ্যে ভারত মিয়ানমারের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করেছে। সামরিক বাহিনীর প্রভাব ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হচ্ছে। আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলোর তৎপরতা নতুনভাবে তৈরি হচ্ছে।
নেপালে সুপ্রিম কোর্টে সংসদ ভাঙার মামলায় রায় সরকারের বিপক্ষে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি বলে মনে হচ্ছে। আর সে ক্ষেত্রে ওলি ও তার অনুগতরা কোণঠাসা হয়ে পড়তে পারেন। প্রচন্ড বা দিউবা যিনিই কোয়ালিশন সরকারে নেতৃত্ব দিন না কেন, চীনা প্রকল্পগুলো অতি দ্রুত গতি হারাবে। আর এপ্রিল-মে মাসে নির্বাচন হলে তাতে কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজিত রূপ নিয়ে নির্বাচনে গেলে কংগ্রেস আবার বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। আর এতে প্রচন্ডের অনুসারী মাওবাদীরা মাওয়ের দেশের সাথে দূরত্ব বাড়িয়ে দিল্লির আনুগত্য কবুল করাকেই তাদের স্বার্থের অনুকূল মনে করবে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ২০২১ সাল হতে যাচ্ছে বিশ্ব পরিস্থিতির জন্য খুবই জটিল একটি সময়। নতুন বছর আসার আগেই সঙ্ঘাতের বাজনা বিভিন্ন অঞ্চলে যেভাবে বেজে উঠছে তাতে কিসিঞ্জারের মতো ব্যক্তিও চীন-মার্কিন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র্রের সেনাপ্রধানদের মুখ থেকেও মহাযুদ্ধের আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছে। আর বাস্তবে এটি ঘটলে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য বিপদ তৈরি হতে পারে।
বিশেষত বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের মতো যেসব দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বিদেশের কর্মসংস্থান বা বহুপক্ষীয় সহায়তার জন্য পাশ্চাত্যনির্ভরতা রয়েছে তাদের বিপদ আরো বেশি। নেপাল পরিস্থিতিতে দেশটির অভ্যন্তরীণ বাস্তবতার পাশাপাশি এ বৈশ্বিক প্রেক্ষিতও সামনে রাখতে হবে। দুই এশীয় জায়ান্টের আধিপত্য বিস্তারের এই খেলায় নেপালের পর দক্ষিণ এশিয়ার আরো দেশকে রাজনৈতিক অস্থিরতা গ্রাস করতে পারে।
mrkmmb@gmail.com