নেপালে দিল্লির অক্টোপাস কৌশল!
মোদি ও ওলি - ছবি সংগৃহীত
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের প্রভাব বিস্তারের কৌশলগত ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রভাব সৃষ্টির প্রচেষ্টাকে বিশ্লেষকরা ‘অক্টোপাস কৌশল’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। ভারত একই সাথে রাজনীতি, অর্থনীতি সমাজ-সংস্কৃতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করে। এতে সর্বব্যাপী প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি বাইরে থেকে অনেকখানি বোঝা যায়। অন্য দিকে চীনের প্রভাব বিস্তারের মুখ্য কৌশল হলো সরকার বা রাষ্ট্র্রের সাথে সম্পর্ক তৈরি এবং আর্থিক বা বিনিয়োগসহায়তা দেয়া। এক সময় দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক মিত্র তৈরির যে কৌশল চীনের ছিল তা দেং শিয়াও পিংয়ের সময় এসে বেশ খানিকটা গৌণ হয়ে যায় আর শি জিনপিংয়ের সময় তা এক রকম হারিয়ে যায়।
চীনের এই নীতিটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিশেষভাবে দেখা যায়। মালদ্বীপে ইয়ামিন আবদুল গাইয়ুমের সরকারকে চীন সর্বাত্মক সমর্থন দেয়। ইয়ামিনের সরকারের পতনের পর বেইজিং নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চালায়। সেই প্রচেষ্টায় কোনো ফল হয়নি। মালদ্বীপের প্রায় সব বিনিয়োগ প্রস্তাব এখন স্থগিত অবস্থায় রয়েছে। কৌশলগত যেসব সুবিধা আগের সরকারের সময় চীনের ছিল সেসব বাতিল হয়ে গেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেক দেশ শ্রীলঙ্কা মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট থাকাকালে চীন থেকে ব্যাপক বিনিয়োগসুবিধা গ্রহণ করে। এর বিপরীতে বেইজিংয়ের জন্য কৌশলগত সুযোগ-সুবিধার দ্বারও খুলে দেয়া হয়। কিন্তু রাজাপাকসে নির্বাচনে হেরে গেলে সিরিসেনা- বিক্রমাসিংহের সরকারের সাথে নতুন সম্পর্ক তৈরি করে বেইজিং। নতুন সরকারের অসন্তুষ্টির কারণ ঘটতে পারে আশঙ্কায় রাজপাকসেকে বিরোধী পক্ষে থাকা অবস্থায় সে রকম কোনো যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। ফলে বিরোধী দলে থাকাকালে রাজাপাকসে চীন-ভারতের সাথে এক ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেন। পরের নির্বাচনে রাজাপাকসে ভ্রাতৃদ্বয়ের দল নিরঙ্কুশভাবে জয়ী হওয়ার পর আর চীনকে একতরফা সুবিধা দেয়ার নীতি অনুসরণ করছে না।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দেশ বাংলাদেশে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে পরপর ক্ষমতায় থাকা সরকার চীনকে কৌশলগত মিত্র ধরে প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিন্যাস করে। জিয়া সরকারের সময় সূচিত এই নীতি তাকে হত্যার অন্যতম কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এই চীনপন্থী পরিচয়ের কারণে বিএনপি বারবার ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েছে। কিন্তু গত ১২ বছর দলটিকে ক্ষমতার বাইরে রাখার ব্যাপারে প্রতিপক্ষ দলের উদ্যোগে চীনের সমর্থনের বিষয়টি অজানা নয়। বলা হচ্ছে, বেইজিং বড় বড় প্রকল্প ও বাণিজ্যসুবিধা পাওয়ার জন্য সরকারের ইচ্ছা পূরণ করছে। ফলে একসময় চীনমুখী কৌশলগত নীতি গ্রহণ করে যে রাজনৈতিক দল নানামুখী চাপের মুখে পড়েছে তারা এখন আর চীনের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। তারা দেখছে, বাংলাদেশের দ্বিতীয় কোনো কূটনৈতিক অংশীদার দেশ যেখানে দূতাবাসের কোনো অনুষ্ঠানে দলবিশেষের স্লোগান ব্যবহার করে না সেখানে চীন একমাত্র ব্যতিক্রম।
নেপালে রাজনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন ও ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে চীন একই ধরনের ভুল করেছে বলে বেইজিংয়ের নীতিপর্যবেক্ষকদের ধারণা। নেপালের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে এবং দু’দেশের আন্তঃনির্ভরতার বাস্তবতাকে এড়িয়ে এমন নীতি গ্রহণে কাঠমান্ডুর ওলি সরকারকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে যাতে মাওবাদীরাই আজ দিল্লির পক্ষে রাজনৈতিক মেরুকরণে প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। শাসক দলের মধ্যে রাজনৈতিক সমন্বয়ে সহযোগিতার পরিবর্তে নতুন নতুন প্রকল্প পেতে বেশি তৎপর ছিল বেইজিং। ফলে একসময় চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত কমিউনিস্ট পার্টির একটি পক্ষ দিল্লির রাজনৈতিক খেলার টুলসে পরিণত হয়েছে। এরপর এমনো দেখা যেতে পারে, চীনের সাথে বহুমুখী সড়ক ও টানেল যোগাযোগের মতো বিরাট প্রকল্প এগিয়ে নেয়ার পরও ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ার পর বেইজিং ওলির সাথে খুব একটা যোগাযোগ রাখবে না। নতুন সরকারের সাথে সম্পর্ক তৈরি করে পুরনো প্রকল্প এগিয়ে নেয়া আর নতুন প্রকল্প পাওয়ার চেষ্টা করবে। কিন্তু এতে মালদ্বীপের মতোই সব কিছু থেকে ছিটকে পড়ার আশঙ্কাই থাকবে বেইজিংয়ের। বিশেষত চীনের প্রভাব প্রতিপত্তিকে তার আঙ্গিনাতেই চেপে ধরার যে কৌশল যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা নিয়েছে তাতে চীনপন্থীরা কাঠমান্ডুর ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়লে সেখানে বেইজিংয়ের জন্য আর কোনো স্পেস থাকবে না।
তবে এটি ঠিক যে, চীনের নেটওয়ার্ক ও কৌশলগত নীতির সবটা সব সময় প্রকাশ্যে হয় না। আর শি জিনপিংয়ের সময় আগের ধারাবাহিকতাও এখন দেখা যায় না। কৌশলগত মিত্রের চেয়েও অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থ বড় হয়ে দেখা যায়। তৃতীয় বিশ্বের নেতাদের অর্থলোভের বিষয়টিকে কাজে লাগিয়ে প্রকল্পের কমিশন দিয়ে অযৌক্তিক শর্তে কাজ বাগানোর চেষ্টা হয়। রাষ্ট্রের ওপর চেপে বসে ঋণের বোঝা। এভাবে শাসক দলের নেতা বা প্রভাবশালী নীতি-প্রণেতাদের আনুগত্য কেনার চেষ্টা করা হয়। এই নীতির কারণে অনেক দেশে তাৎক্ষণিকভাবে চীনা প্রভাব বেড়ে যেতে দেখা যায় কিন্তু শেকড়ের অভাবে তা স্থায়ী হয় না। আর ক্ষুদ্র স্বার্থে মানবাধিকার জলাঞ্জলি দেয়ার কারণে এমন অনেক ইস্যু স্থানীয়ভাবে সৃষ্টি হয় যা চীনের গ্রহণযোগ্যতা কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু সঙ্কট এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ার জন্য অনেকে চীনা নীতিকে দায়ী করেন।