করোনাভাইরাস : কিছু জানা কথা, কিছু অজানা তথ্য

কৌশিক সাহা | Dec 22, 2020 09:23 am
করোনাভাইরাস

করোনাভাইরাস - ছবি : সংগৃহীত

 

অতিমারি-আবহে কোন কোন বিষয়ে আরো সতর্ক হওয়া দরকার?

এই ভাইরাসের গায় কাঁটার মতো লেগে থাকা স্পাইক প্রোটিন যা অতি সহজেই শ্বাসনালী ও ফুসফুসের কোষের (type II alveolar cells) গায়ে সহজেই নিজেকে যুক্ত করতে পারে এক বিশেষ ধরনের প্রোটিন [ACE2] এর মাধ্যমে এবং সেখান থেকেই শুরু হয় এদের মানবদেহে সংক্রমণ এবং তাদের বংশবিস্তার। এই কোষগুলোকে আক্রান্ত করার পরই এরা এদের নিজস্ব আরএনএ (RNA) কে কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দেয় । বলাবাহুল্য এই আরএনএ গুলিকেই আমরা আরটিপিসিআর (RT-PCR) পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে মানুষের সংক্রমণ হয়েছে কিনা তা নির্ধারণ করে থাকি। এই ভাইরাসগুলো একদিকে যেমন মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমায় আবার অন্য দিকে এরা যে মানব শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি করে সেগুলো কিন্তু সরাসরি এদের সংক্রমণের দ্বারা নয় বরঞ্চ এক ধরনের অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক ইমিউন রেসপন্স ( Hyperimmune response) অর্থাৎ আমাদের শরীর এই ভাইরাসের প্রভাব থেকে বাঁচতে গিয়ে যে অস্বাভাবিক বা অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে তার প্রভাবেও শরীরের ক্ষতি হয়। দুর্বার গতিতে এই ভাইরাসগুলোর নিরন্তর বংশবিস্তার যেমন ফুসফুসের কোষগুলিকে ক্রমাগত ধ্বংস করে চলে অন্যদিকে এরা অতিরিক্ত অস্বাভাবিক ইমিউন রেসপন্স তৈরি করে তার প্রভাবে ফুসফুসের মারাত্মক ক্ষতি হয় যাকে ইদানিং বলা হয় সাইটোকাইন স্টর্ম (Cytokine storm)।

প্রশ্ন : এই রোগে শরীরের বিভিন্ন অংশে ঠিক কী ধরনের ক্ষতি হয়?

করোনাভাইরাসের প্রভাবে ফুসফুসে যে পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় তাকে প্যাথলজির পরিভাষায় বলা হয় ডিফিউজ অ্যালভিওলার ড্যামেজ (DAD)।এতে ফুসফুসের গায়ের যে কোষগুলো (pneumocytes) থাকে সেগুলি যেমন ঝরে যায় তেমনই প্রোটিনযুক্ত এক প্রকার রস নিঃসৃত হয় এবং এক ধরনের পর্দার মতো আবরণ (hyaline membrane) অ্যালভিওলাই এর ভিতর তৈরি হয়, ছোট ছোট রক্তবাহগুলির পচন (necrosis) শুরু হয়, ধীরে ধীরে আরো নানা রকম কোষীয় উপাদান জমা হয়ে গোটা ফুসফুসটাই অকার্যকার হয়ে যায়, অনেক সময় ছোট ছোট জমাট বাঁধা রক্ত (microthrombi) ফুসফুসে পাওয়া যায় এবং পরিশেষে পুরো ফুসফুসটির ফাইব্রোসিস (fibrosis) হয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত এই রোগীরা খুবই গুরুতর শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হন। এই ধরনের উপসর্গগুলিকে ডাক্তারি পরিভাষায় ARDS বা একিউট রেস্পিরাটরি ডিস্ট্রেস সিনড্রোম বলে। অনেক সময় রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ খুব কমে গেলেও অনেকেই কোনরকম শ্বাসের সমস্যা উপলব্ধি করতে পারেন না এবং এই ধরনের রোগীরা অনেক সময়ই স্বাস্থ্য পরিষেবা যথাযথ পাওয়ার আগেই মারা যান।এই ধরনের সমস্যাকে প্রচলিত ভাবে বলা হয় হ্যাপি হাইপোক্সিয়া (Happy hypoxia) বা সাইলেন্ট হাইপোক্সিয়া। অনেক শিক্ষিত সতর্ক এবং নিজের প্রতি যত্নশীল মানুষ এই ধরনের হ্যাপি হাইপোক্সিয়া বুঝতে না পেরে প্রাণ দিয়েছে দিয়েছেন। করোনার ভয় এখানেই শেষ নয় অনেক সময় মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে হসপিটালে ভর্তি হয়েছেন পরবর্তী কালে হয়তো করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি পেয়েছেন ঠিকই। তারা কিন্তু আক্রান্ত হন দ্বিতীয় কোনো জীবাণু (Secondary Infection) দ্বারা এবং সেই রোগের বশবর্তী হয়েই অবশেষে তাদের মৃত্যু হয়েছে। একই রকম ভাবে শরীরের অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন হৃদপিণ্ড, রক্তবাহ, লিভার, কিডনি, অন্ত্র, প্লীহাতেও এমন নানা রকমের পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যার শেষ হয় অঙ্গটিকে বিকল করে।

প্রশ্ন : এই রোগে কি রক্ত জমাট বাঁধার কোনো সমস্যা দেখা দেয়?

মেডিকেল পোস্টমর্টেম-সহ বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা জানা গেছে যে অনেক ক্ষেত্রেই করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের রক্ত জমাট বাঁধার প্রবণতা অনেকটাই বেশি থাকে [Hypercoagulability]। বিভিন্ন রক্তবাহর (blood vessels) ভিতরে কোষের যে আবরণ থাকে [endothelium] এই রোগে কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় [endothelial injury, endotheliitis] এবং সেই কারণে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ছোট ছোট রক্তবাহর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে যায় [Microthrombi] এবং সেখান থেকে শরীরের সেই অংশ তথা দূরবর্তী অন্য অঙ্গের ক্ষতি হতে পারে [Thromboembolism]। রক্ত জমাট বাঁধা সম্বন্ধীয় এ জাতীয় সমস্যা নির্ধারণের জন্য রক্তে ফিব্রিনোজেন (Fibrinogen), ডি – ডাইমার (D-dimer) ইত্যাদির মাত্রা দেখা হয়। সেই কারণেই নির্দিষ্ট কিছু রোগীকে দরকার মতো হেপারিন জাতীয় [LMWH] ওষুধ প্রয়োগ করা হয় ।

প্রশ্ন : সাইটোকাইন স্টর্ম ব্যাপারটি কী? কী ভাবে রক্ষা পাওয়া যাবে?

এটা অনেকটা অকারণ বা সামান্য কারণে রাস্তাঘাটে ঘটে যাওয়া হাতাহাতি-মারামারি মতো ঘটনা। যেখানে করোনাভাইরাসের আক্রমণে আমাদের শরীরের ইমিউন সিস্টেম বা রোগ প্রতিরোধকারী ব্যবস্থা অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে যার ফলে শরীরের বিভিন্ন কোষ যারা রোগ প্রতিরোধে সাহায্য করে তারা খুব দ্রুত সক্রিয় ও দলবদ্ধ হয়ে অল্প সময়ে অনেক পরিমাণে বিভিন্ন রাসায়নিক [cytokines] নিঃসৃত করে ও তা শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলে, যাতে মৃত্যুও হতে পারে। এ প্রবণতা নির্ধারণে কিছু পরীক্ষা হয় যেমন রক্তের প্রোক্যালসিটোনিন (Procalcitonin), ইন্টারলুকিন - ৬ (IL-6)। এই জাতীয় রোগের আশঙ্কা দেখা গেলে আগে থেকেই স্টেরয়েড দেয়া হয় যারা ইমিউন সিস্টেম বা তার সক্রিয়তাকে পরিবর্তন করতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এর প্রভাবে শরীরে লিম্ফোসাইট নামক রক্ত কোষ কমে [T-cell exhaustion] যায় সংখ্যা ও কার্যকারিতায় ।

প্রশ্ন : তা হলে এখন কী করা উচিত? আশা১-আশঙ্কার জায়গা কোনগুলি?

এত কিছু আলোচনার পরে সাধারণ বিষয় বা সচেতনতার বিষয়ে বলা দরকার যেহেতু বেশির ভাগ মানুষই এটা বুঝে গেছেন যে করোনাভাইরাস থেকে তাদের ক্ষতির আশঙ্কা খুবই কম বা বেশির ভাগ মানুষই করোনা থেকে সে অর্থে বিরাট কোনও চিকিৎসা ছাড়া সুস্থ হয়ে উঠবেন তাই অনেকের মধ্যেই ঢিলেঢালা মনোভাব দেখা যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে করোনা থেকে হয়তো আপনি সুস্থ হয়ে উঠলেন কিন্তু আপনার অসাবধানতার জন্য আপনার বাড়ির লোক, আপনার পড়শি বা আপনার নিকটাত্মীয় যাদের অন্য অসুখ (comorbidity) আছে তাদেরকে কঠিন মূল্য দিতে হতে পারে। এমনকি আপনিও আর পাঁচজনের থেকে বাহ্যিক ভাবে সুস্থ হলেও আপনার শরীরে করোনাভাইরাস কতটা ক্ষতি করতে পারবে বা করবে সেটা কিন্তু নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। আর কোনও ভাবে যদি মনে হয় শরীরে করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ রয়েছে বা আপনি কোনও করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে অজান্তেই অনেকটা সময় সুরক্ষা ছাড়াই কাটিয়ে ফেলেছেন সঙ্গে সঙ্গে আপনি নিজেকে পরিবারের বাকিদের থেকে আলাদা করে রাখুন, যতই দরকার হোক বাড়ি থেকে বেরোবেন না [home isolation] এবং যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্রে আপনার কোভিডের পরীক্ষা করান। এই অতি সক্রিয়তা শুধুমাত্র বাড়ির লোক বা প্রতিবেশীদের জন্য তা কিন্তু নয়। কারণ আপনার শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি যত তাড়াতাড়ি পরীক্ষা দ্বারা নির্ধারিত হবে দরকার হলে আপনি তত তাড়াতাড়ি এই ভাইরাসের জন্য চিকিৎসা সম্বন্ধীয় নির্দিষ্ট যা যা পরিষেবা দরকার সেগুলো তত আগে পাবেন। একটা কথা মনে রাখা দরকার এই ভাইরাস শরীর থেকে চলে যাওয়ার পরও নানা রকম শারীরিক জটিলতা [Post Covid complications] দেখা যেতে পারে। আর এটাও মনে রাখতে হবে এক বার করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়া মানেই আপনি সারা জীবনের জন্য সুরক্ষিত নন, দ্বিতীয় বারও এই সংক্রমণ হতেই পারে। আসুন কার্যকর ও সুরক্ষিত ভ্যাকসিন আসা পর্যন্ত সুরক্ষা বিধিগুলো সঠিক ভাবে মেনে চলি।

সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us