কোন পথে ইরান?
সুলাইমানি - ছবি সংগৃহীত
২০২০ সালের জানুয়ারির ৩ তারিখ, রাত ১টা। এসময়ই খবর ছড়িয়ে পড়ে, ইরাকের রাজধানী বাগদাদে আমেরিকান ড্রোন একটি গাড়িবহরকে লক্ষ্য করে হামলা করেছে। হামলায় এক শীর্ষ ইরানি জেনারেল নিহত হয়েছেন বলে তখন মনে করা হচ্ছিলো।
ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ইরাকি রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন নিশ্চিত করে, যা অনেকেই ধারণা করছিলেন;ড্রোন হামলায় ইরানি মেজর জেনারেল কাসেম সুলাইমানিসহ ১০ জন নিহত হয়েছেন। পরে যুক্তরাষ্ট্র জানায়, শত্রুকে প্রতিরোধের বৃহৎ কৌশলের অংশ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছিলো।
পরদিন সকালে যখন পুরো দেশ জেগে ওঠে, ততক্ষণে এ সংবাদে সারাবিশ্বে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিলো। সাদ্দাম হোসেনের পতনের মতোই ইরাকিরা এ ঘটনাকে অবিশ্বাস্য মনে করছিলো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাগদাদের এক বাসিন্দা জানান, এটি এমন একটি বিষয় যা বিশ্বাস করা যায় না। সুলাইমানিকে মনে করা হতো অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু তিনি মারা গেছেন।
নতুন বছরের তখন মাত্র তিন দিন পার হয়েছিলো। এরমধ্যে ইরানি শীর্ষ এক জেনারেলের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা পুরো ২০২০ সালে তেহরানের প্রভাবিত শক্তির ইরাককে কাঁপিয়ে দেয়ার জন্য নেয়া দীর্ঘ কর্মসূচির তালিকার জন্য দায়ী ছিলো। বিপর্যস্ত দেশটির ফাঁস হয়ে যাওয়া বহুল সমালোচিত ২০২১ সালের বাজেটের খসড়ার সর্বশেষ উদাহরণ।
বছর শেষ হওয়ার প্রান্তে, অস্থায়ী বাজেটের খসড়া থেকে যে তথ্য প্রকাশিত হয়,তাতে দেখা যায় সরকার দেশটির মূদ্রার মান হ্রাস এবং সরকারি কর্মচারীদের বেতন কমানের পরিকল্পনা করছে। যা সাধারণ ইরাকিদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করেছে।
অর্থনৈতিক দুর্দশা
ইরাকের মতো দেশ, যার সরকারি রাজস্বের নব্বই ভাগই আসে খনিজ তেল থেকে, তেলের দামের দ্রুত অবনতির ফলে দেশটি পড়েছে অর্থনৈতিক সংকটে।
জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী (ইউএনডিপি) এ বছরের অক্টোবরে সতর্কতা জানায়, কোভিড-১৯ ঝুঁকির সাথে তেলের সংকটের সংযোগ ইরাকে বৈষম্যের অবস্থা সৃষ্টি করবে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের নভেম্বরের প্রতিবেদনে বলা হয়, আনুমানিকভাবে ৫৫ লাখ ইরাকি দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন।
এ বছর, আনুমানিক ৪০ লাখের বেশি সরকারি চাকরিজীবী বেতন বিলম্ব ও বেতন আটকে যাওয়ার সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। বেসরকারি কর্মক্ষেত্রের স্বল্প সুবিধা থাকলেও, অনেক ইরাকি নাগরিকই তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল।
উত্তরের কুর্দিস্তান অঞ্চলে, বেতন নিয়ে হতাশা চরম উত্তেজনার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই মাসেই স্থানীয় সরকারি চাকরিজীবীরা তাদের বকেয়া বেতন নিয়ে রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করলে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়।
ইরাক ফান্ড ফর হাইয়ার এডুকেশনের প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান ভ্যান ডেন টওর্ন জানান, ইরাকের বর্তমান দুর্দশা পরিবর্তনের ঊর্ধ্বে।
সংগঠনটি একটি দাতব্য সংস্থা যা ইরাকি তরুণদের জন্য শিক্ষা ও জীবিকার সুযোগ তৈরির জন্য কাজ করছে।
আলজাজিরার কাছে ভ্যান ডেন টওর্ন জানান, ইরাকের জনসংখ্যার বিপুল অংশই তরুণ। বিপুলভাবে স্ফীত সরকারি কর্মক্ষেত্রে, যার রাজস্ব বর্তমান চাকরিজীবীদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম, তেলের দাম কমে যাওয়ায় নতুন করে কমই লোক নিয়োগ করছে। নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা প্রতিবছর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশযোগ্য লাখ লাখ ইরাকির খুবই স্বল্প অংশ।
তিনি বলেন, এ অবস্থার সমাধান শুধু একটাই, ইরাকি তরুণদের শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত ও যোগ্য করে গড়ে তুলে নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের উপযোগী করা।
ই-কমার্স ব্যবসা এবং বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হলেও, ইরাকের বেসরকারি খাত দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই করছে। যেখানে দেশটির দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও দুর্নীতি উদ্যোক্তাদের ধারাবাহিকভাবেই বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ করে আসছে।
বেসরকারি কর্মক্ষেত্র এভাবে যতদিন দুর্বল হয়ে থাকবে, লাখ লাখ ইরাকি ততদিন সেই সরকারের দয়ার মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে, যে সরকার দেশের অর্থনৈতিক ঘাটতি মোকাবেলার জন্য বেতন কাটার পরিকল্পনা করছে।
এরইমধ্যে, এক মার্কিন ডলারের বিপরীতে ১,১৮২ দিনার থেকে ১,৪৫০ দিনার অবমূল্যয়ন সাধারণ জনগণের ক্রয়ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে এবং অনেকের বেতনকেই জীবন ধারণের জন্য অর্থহীন করে তুলেছে।
সামগ্রিক এই অবস্থা ইরাকিদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। ইরাকিরা ধারণা করছে নতুন বছরে তাদের অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও গভীর হবে।
ইরাকি বিশ্লেষক মুস্তাফা হাবিব জানান, সাধারণ মানুষের এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে বাড়ছে যা একসময় পরিবর্তনের অযোগ্য হয়ে যেতে পারে।
২০১৯ সালের শেষে, ইরাকের পতনশীল অর্থনীতি রক্ষা ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাপনায় সরকারের ব্যর্থতার ফলে সারাদেশেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিলো।
বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে বেকার যুবকের হার ৩৬ শতাংশ অতিক্রম ও দারিদ্রতার হার দ্বিগুন হয়ে ৪০ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কার মধ্য দিয়ে ২০২১ সালে ইরাকে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করবে।
দেশব্যাপী বিক্ষোভ
২০১৯ সালের অক্টোবরে শান্তিপূর্ণ সাধারণ বিক্ষোভের মধ্য দিয়েই ক্ষুব্ধ ইরাকিরা তাদের প্রতিবাদ শুরু করেছিলেন। কিন্তু শীঘ্রই তা সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সহিংস সংঘর্ষে রূপ নেয়।
বিক্ষোভ দমাতে সরকারি অ্যান্টি-রায়ট ফোর্সেস এবং মিলিশিয়া তাজা গুলি, টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে এবং বিক্ষোভকারীদের নির্যাতন করে। জানুয়ারির মধ্যে, নিহতের সংখ্যা ছয়শ পেরিয়ে যায়।
ইরাকি হাইকমিশন ফর হিউম্যান রাইটসের আলী আল-বায়াতী আলজাজিরাকে বলেন,বিক্ষোভে সহিংসতার সাথে যুক্ত অপরাধীদের জবাবদিহিতা ও ক্ষতিগ্রস্তদের বা তাদের পরিবারের ক্ষতিপূরণ সরকারের অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়।
এখন পর্যন্ত, বেসামরিক বিক্ষোভকারীদের হত্যা, নির্যাতন বা গুম করার জন্য কাউকেই বিচারের অভিযুক্ত করা হয়নি।
বিক্ষোভ দমনের ভয়াবহ ব্যবস্থার পরেও, বিক্ষোভকারীরা কর্মসংস্থান, জীবনধারণের ব্যবস্থাপনা, ইরাকের মাটিতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের হস্তক্ষেপ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত ইরাকি রাজনৈতিক ব্যবস্থার অবসান চেয়ে তাদের প্রতিবাদ অব্যাহত রেখেছেন।
গতবছরের নভেম্বরে, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী আদেল আবদুল মাহদীর পদত্যাগের পর মে মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুস্তাফা আল-কাযেমী দায়িত্ব নেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত নতুন ইরাকি প্রধানমন্ত্রী ইরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের যথাযথ জবাব দেবেন।
কিন্তু আল-কাযেমীর শপথের সাত মাস পরও, ইরানের সাথে সম্পৃক্ত এবং ইরান সমর্থিত মিলিশিয়ারা স্বাধীনভাবে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
জুনে সরকারি নিরাপত্তাবাহিনীর অভিযানে বাগদাদ বিমানবন্দরে হামলার কথিত অভিযোগে ইরান সমর্থিত কাতিব হিযবুল্লাহ সংগঠনের ১৪ সদস্যকে গ্রেফতার করা হলে, তাদের ১৩ জনকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়।
নিউইয়র্কভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক দ্যা সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের ফেলো এবং ইরাকি বিশ্লেষক সাজাদ জিয়াদ বলেন, ইরাকি সরকার আইনের শাসন রক্ষায় লড়াই করছে এবং ২০২০ সালের ঘটনাগুলো এই চ্যালেঞ্জের মাত্রাকে প্রকাশ করেছে।
তিনি বলেন, মিলিশিয়ারা তাদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে। কূটনীতিক মিশন এবং সরকারি কার্যালয়ে হামলা অব্যাহত রেখেছে এবং সমালোচকদের নিরব করতে হত্যা, সহিংসতা ও গুমের আশ্রয় নিচ্ছে।
জুলাইয়ে, প্রসিদ্ধ বিশ্লেষক এবং সরকারি উপদেষ্টা হিশাম আল-হাশেমীকে বাগদাদে অজ্ঞাত বন্দুকধারীরা গুলি করে হত্যা করে। কিন্তু এ ঘটনার জন্য কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। যদিও ঘটনার জন্য কাতিব হিযবুল্লাহর দিকে অনেকেই আঙ্গুল তুলছেন।
জিয়াদ বলেন, ন্যায়বিচারের জন্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি স্বত্ত্বেও এটি ধারণা করা যাচ্ছে না, যে তার হত্যাকারীরা আসলেই গ্রেফতার হবে।
তিনি আরও বলেন, সরকার ইতোমধ্যেই জানিয়েছে দুষ্কৃতিকারীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। সুতরাং এ ঘটনার তদন্তের মাধ্যমে কোনো ফলাফলের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।
এক মাসের কম সময়ের মধ্যেও, আমেরিকার জো বাইডেনের নতুন প্রশাসন হয়তো ওয়াশিংটন ও তেহরানের মধ্যে সম্পর্কের বরফ গলানোর প্রচেষ্টা করবে।
এর মাধ্যমে ইরাকের অভ্যন্তরে যুক্তরাষ্ট্র-ইরানের উত্তেজনা আরো হ্রাস পাবে এবং বাগদাদকে সক্ষম করবে তাদের অন্যান্য নিরাপত্তা ও মানবেতর বিষয়াবলী সমাধান করার; বিশেষত আইএসআইএলের হামলা মোকাবেলা, জানুয়ারির মধ্যে প্রত্যাশিত ২,৫০০ মার্কিন সেনার প্রত্যাবর্তন এবং ইরাকের অভ্যন্তরে আবাসহীন হয়ে পড়া ৬০ হাজারের বেশি মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করা যারা বর্তমানে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ মাসেই সতর্কতা জানিয়েছে, ইরাকের অভ্যন্তরের শরণার্থী শিবির বন্ধের বিষয়ে বাগদাদের সিদ্ধান্ত আবাসহীন জনগণকে আশ্রয়হীনতা ও দারিদ্যের মুখে ঠেলে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী আল-কাযেমী সম্ভবত জুনের সাধারন নির্বাচনের আগে সব শরণার্থী শিবির বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে আবাসহীন মানুষেকে স্থানান্তরের জন্য বাধ্য করছেন ।
অগ্রীম নির্বাচনের দাবি সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইন্সটিটিউট নামের এক এনজিও পরিচালিত মতামত জরিপে দেখা যায়, ইরাকিদের মধ্যে তাদের দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা বাড়ছে এবং তারা তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার ওপর আস্থাহীন।
পুরো ইরাকে চালানো এই জরিপ অনুসারে, অংশগ্রহণকারীদের ৫২ শতাংশই মনে করছেন তাদের দেশের গণতন্ত্রের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এছাড়া ৮৬ শতাংশ জানায় তাদের দেশের শাসনব্যবস্থা কিছু দল ও গোষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণের জন্যই কাজ করছে। ৬২ শতাংশ ভোট দেওয়ার গুরুত্বের বিষয়ে একমত হয়।
২০২০ সালে ইরাকি সরকার যে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে, তা হয়তো আগামী বছরের নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধা তৈরি করবে।
বর্তমানে, কাসেম সুলাইমানির হত্যাকাণ্ডের এক বছর পূর্তির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ইরাকিদের কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন ইরাকে মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে ইরান সমর্থিত গোষ্ঠীগুলোর নতুন হামলার।
মাসের শুরুতে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সূত্রানুসারে, মার্কিন দূতাবাস ঘোষণা করেছে যে, তারা তাদের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরিয়ে নিচ্ছে। স্থানান্তরের এই কার্যক্রম সুলাইমানীর হত্যার বর্ষপূর্তির পরও অভ্যাহত থাকতে পারে।
১৬ ডিসেম্বর, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সুলাইমানীর পরিবারের সাথে এক সাক্ষাতের সময় তার হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার শপথ পুনরায় ব্যক্ত করেন। এ সময় তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানি সেনানায়ককে হত্যার দায় মেটাতে হবে।
ইরাকিরা দুশ্চিন্তা করছেন, এরফলে তাদের দেশই নতুন বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।
সূত্র : আল জাজিরা