ইরানে মোশাদের পরিকল্পনা

ইউসি মেলম্যান | Dec 20, 2020 08:34 pm
ইরানে মোশাদের পরিকল্পনা

ইরানে মোশাদের পরিকল্পনা - ছবি : সংগৃহীত

 

মোসাদের ১৩তম পরিচালক হিসেবে বেনজামিন নেতানিয়াহু যাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বর্তমানে তিনি শুধু ‘ডি’ আদ্যক্ষরে পরিচিত। এই সিদ্ধান্ত এমন এক গুরুত্বপূর্ণ ও নাটকীয় মুহূর্তে তিনি নিয়েছেন, যখন হোয়াইট হাউসের প্রধানতম ব্যক্তির পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এলিজার গোল্ডবার্গ এবং মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে পরিচালিত রিভিউ বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত করার পরই তার পূর্ণনাম প্রকাশ করা হবে।

বর্তমানে সংস্থাটির সহকারী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তা মোসাদের বর্তমান প্রধান ইউসি কোহেনের পরবর্তী দায়িত্বশীল হিসেবে নিযুক্ত হতে যাচ্ছেন। সাড়ে পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের পর কোহেন ২০২১ সালের জুনে অবসর নিতে যাচ্ছেন।

প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট জো বাইডেন এবং তার সহযোগীরা আশা করছেন, দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা ইরানের সাথে বোঝাপড়া করতে পারবেন, যার প্রেক্ষিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে এবং ২০১৫ সালের জুলাইয়ে ছয় বৃহৎ শক্তি এবং তেহরানের মধ্যে স্বাক্ষরিত পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে সক্ষম হবেন।

২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে এই চুক্তি থেকে সরিয়ে নেন এবং ইরানের ওপর কঠিনতর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন।

নেতানিয়াহু ও কোহেনের উৎসাহে এবং জোর তদবিরে ট্রাম্প এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পূ্র্ববর্তী বারাক ওবামা প্রশাসনের, ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনরও যাতে অংশ ছিলো, উদ্যোগে নেয়া এই পরমাণু চুক্তির শুরু থেকেই নেতানিয়াহু ও কোহেন বিরোধিতা করেছিলেন। তারা এই চুক্তির বিরুদ্ধে লবি করেছেন এবং ওবামার বিরুদ্ধে রিপাবলিকান কংগ্রেসে ষড়যন্ত্র করেছেন।

বর্তমানে ডি এক কঠিন মিশনে আছেন। প্রধানমন্ত্রীকে যথাযথ গোয়েন্দা তথ্য যাওয়া এবং তাকে অসন্তুষ্ট করলেও বাস্তবতার সঠিক চিত্র দেয়া তার দায়িত্ব। এখন ডি’র পরীক্ষার বিষয়, তিনি এমন সবল কর্মকর্তা কিনা যিনি নেতানিয়াহুর সামনে দাঁড়িয়ে তার প্রতিজ্ঞাবদ্ধতা ও পেশাদারিত্ব প্রমাণ করে প্রয়োজনে তাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন।

সংস্কারবাদী
মোসাদের সহকারী প্রধানকে সংস্থাটির নতুন প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত ছিলো প্রত্যাশিত এবং এটি যথার্থ বাছাই।

কোহেনের পরবর্তী দায়িত্বশীল হিসেবে তিনজন শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। ডি’র সাথে সাথে ডি আদ্যোক্ষরের অপর একজন এবং এ আদ্যোক্ষরের আরেকজন কর্মকর্তা, যারা একই অবস্থান থেকে উঠে এসেছেন।
তারা সবাই ইসরাইলী সামরিক বাহিনীর জুনিয়র অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং পরবর্তীতে দায়িত্বচ্যুত হয়েছেন। কয়েক বছরের পর তারা মোসাদে যোগ দেন কিন্তু তাদের ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৫৬ বছর বয়স্ক ডি বিশেষ সামরিক ইউনিট সায়েরেত মাতকালে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তার সামরিক জীবনের সূচনা করেন। মর্যাদাপূর্ণ এই সামরিক ইউনিট শত্রুবাহিনীর সম্মুখ সারিতে অবস্থান নিয়ে পর্যবেক্ষণ এবং গোয়েন্দা তৎপরতা চালানোর দায়িত্ব পালন করে।
ত্রিশ বছর আগে তিনি মোসাদে যোগ দেন এবং আঠারো মাসের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের পর তিনি এর জোমেট (হিব্রু শব্দটির অর্থ সন্ধি) ডিভিশনে যোগ দেন, যা সংস্থাটির কর্মীদের অবস্থান চিহ্ণিত করা, পরিচয় নেওয়া, নিয়োগ করা এবং দায়িত্ব বণ্টনের দায়িত্ব পালন করে।

তখন থেকেই তিনি এখানে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, মাঝে দু’বছরের জন্য কেশেত (সম্মুখ) ডিভিশনে ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, যেটি নিবিড় নজরদারি ও শত্রু শিবিরে অনুপ্রবেশের বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত।

সিনিয়র মোসাদ কর্মকর্তাদের মতে, ডি এমন একজন সংস্কারবাদী যিনি কাঠামোগত, সংস্থাগত এবং পেশাগত পরিবর্তনের চিন্তা গ্রহণের ক্ষেত্রে উন্মুক্ত মনের অধিকারী। যিনি তার চিন্তাগত অবস্থান আঁকড়ে বসে থাকেন না এবং রক্ষণশীল নন।

জোমেটের দায়িত্বশীল হিসেবে, ডি সংস্থাটির কর্মীদের ইরান ও হিযবুল্লাহর মতো বিভিন্ন স্থান ও গোষ্ঠীর মধ্যে অনুসরণ এবং নিয়োগের সাধারণ প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ছিলেন যা মোসাদের জন্য শীর্ষ অগ্রাধিকারযোগ্য বিষয়। ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে কোহেনের সহকারী হিসেবে তিনি পদোন্নতি পান, যার মাধ্যমে সংস্থাটির পরবর্তী প্রধান হিসেবে তার দায়িত্ব পালনের বিষয়টি ইঙ্গিত করে।
মোসাদের মধ্যে ডি’র প্রধান হিসেবে নিয়োগ বিপুলভাবে সমর্থন পেয়েছে। সাবেক সিনিয়র মোসাদ কর্মকর্তারা জানান, তিনি সৎ এবং নিরপেক্ষ। ডি’র সাথে আগে কাজ করা সংস্থাটির সাবেক প্রধান তামির পারদো এই নিয়োগকে উত্তম হিসেবে মন্তব্য করেছেন।

ব্যতিক্রমী বিষয়টি হলো, ইসরাইলের শীর্ষ সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের কলহপ্রিয় প্রকৃতির বিপরীতে এমন একজন এলেন যিনি কোনো বিরুদ্ধতা ছাড়া সকলের সমর্থন পেয়েছেন।

কোহেনের অনুসরণ
ডি’র ক্যারিয়ার অনেকক্ষেত্রেই কোহেনের সাথে মিলে যায়,যিনিও জোমেটে নিয়োগ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন এবং পরবর্তীতে এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৫৯ বছর বয়স্ক কোহেনের ২০২০ সালের শেষে তার পাঁচ বছরের দায়িত্ব পালনের মেয়াদ সমাপ্তির কথা থাকলেও, বিস্ময়করভাবে আরো ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব পালনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে তিনি সম্মতি জানিয়েছেন।

এর একটি কারণ হতে পারে দুই বছর আগে শুরু হওয়া পরিকল্পিত এক অভিযান সমাপ্ত করা। এই অভিযানের অংশ হিসেবে ড. মহসিন ফখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়, যিনি ইরানের সামরিক পরমাণু প্রকল্পের প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন।

আড়াই সপ্তাহ আগে তেহরানের উপকণ্ঠে ফখরিজাদেহের ওপর এই হামলা মোসাদ পরিচালনা করে।
কোহেনকে বিবেচনা করা হয় সফলতম গোয়েন্দা ও গুপ্ত অভিযান কর্মকর্তা। কিন্তু নেতানিয়াহুর সাথে তার ঘনিষ্ট সম্পর্ক এবং প্রকাশ্যে এসে কথা বলার বেপরোয়া মনোভাবের কারণে, যা সাবেক মোসাদ প্রধানদের সাথে সম্পূর্ণ বিপরীত,তাকে বিতর্কিত ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

কোহেনের অর্জনের মধ্যে ২০১৮ সালে তেহরানে অবস্থিত ইরানের প্রধান পরমাণু আর্কাইভ চুরি করা, উন্নত সেন্টারফিউজ তৈরি বিঘ্নিত করা এবং সাইবার হামলা। এরমধ্যে কয়েক মাস আগে ইরানের বন্দর বন্দর আব্বাসে এমনই এক সাইবার হামলা চালানো হয়, যাতে বন্দরের কার্যক্রম বিকল হয়ে পড়ে।
কোহেনের নেতৃত্বে মোসাদের অন্যান্য হামলার মধ্যে তিউনিসিয়া ও মালয়েশিয়ায় অবস্থানকারী দুই ফিলিস্তিনি প্রকৌশলীকে হত্যা অন্তর্ভুক্ত, যারা ড্রোন ও মিনি সাবমেরিনের বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে হামাসের সক্ষমতা বাড়াতে কাজ করছিলেন।

এটি ধারণা করা যুক্তিযুক্ত যে, কোহেনের সহকারী হিসেবে দুই বছরের দায়িত্ব পালনকালে ডি মোসাদের এসকল অভিযান এবং অন্য বিভিন্ন গোপন বিষয় সম্পর্কে অবগত ছিলেন।
নতুন কৌশল

ডি’র অধীনে মোসাদ পরবর্তী পাঁচ বছর ইসরাইলের বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা হিসেবে ঐতিহ্যগত দায়িত্ব পালন করবে।

ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আরব ও মুসলিম দেশের সংখ্যা বাড়ানোর বিষয়ে তিনি আকাঙ্ক্ষা করতে পারেন। আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান এবং মরক্কোর অনুসরণে ওমান, সউদি আরব এবং ইন্দোনেশিয়া সম্পর্ক স্বাভাবিকের এই বিষয়ে এগিয়ে আছে।
ডি ইরান ও হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযানের বিষয়ে সমর্থন দিয়ে যাবেন এবং বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন ও যৌথ অভিযান বাড়ানোর চেষ্টা করবেন। ইতোমধ্যে মোসাদের সাথে এমন ১৫০টি সংযুক্তি রয়েছে।

যদিও ডিকে কোহেনের অনুসারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যিনি সম্ভবত দায়িত্ব পালন শেষে রাজনীতিতে যোগ দেনে এবং গুঞ্জন করা হয়, ওয়াশিংটনে তিনি ইসরাইরের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পেতে যাচ্ছেন, ডি সম্ভবত তাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করবেন না।
প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ডি তার পূর্বসূরীর তুলনায় আরও সতর্ক হবেন এবং তার মতো ক্ষমতা অনুশীলণ ও ঝুঁকি গ্রহণ থেকে দূরে থাকবেন।

কিন্তু সর্বোপরি, ডি চেষ্টা করবেন সিআইএ’র সাথে বিশেষ সম্পর্ক নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে বের করার যখন বাইডেন ইরানের সাথে নমনীয় সম্পর্ক স্থাপন করতে যাবেন।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us