আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সঙ্ঘাত : কার লাভ কত
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সঙ্ঘাত : কার লাভ কত - ছবি সংগৃহীত
করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেই আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধে হেরে শান্তিচুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে আর্মেনিয়া। আর আজারবাইজান যুদ্ধের মাধ্যমেই তাদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এলাকার নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়েছে। তবে যুদ্ধে এই দেশ দুটি ছাড়াও এতে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল তুরস্ক, পাকিস্তান, রাশিয়া, ইসরাইল, ইরান, ফ্রান্স, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব।
আর্মেনিয়া-আজারবাইজান সঙ্কট অনেক দিনের। দীর্ঘ ৩০ বছর ধরে নাগার্নো-কারাবাখ নামে পরিচিত আজারবাইজানের ভূমি দখল করে রেখেছিল আর্মেনিয়া।কিন্তু জাতিসঙ্ঘ বা মুসলিম দেশগুলো নীরবতা অবলম্বন ছাড়া আর কিছুই করেনি। অবশ্য এমনটি নতুন কিছু নয়। তাদের নীরবতার কারণেই ফিলিস্তিনিরা নিজ দেশে পরবাসী হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছে, কাশ্মিরিরা ভারতের অত্যাচার, নিপীড়নের শিকার হচ্ছে।
কেবল ভূখ-গত কারণেই নয়, প্রাকৃতিক সম্পদের জন্যও নাগার্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ পাওয়া খুবই দরকারি ছিল আজারবাইজানের। স্বর্ণ, রুপাসহ নানা প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি। আর্মেনিয়া এই এলাকাটির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে এসব সম্পত্তি ব্যবহার করছিল আজারবাইজানের বিরুদ্ধেই।
আর্মেনিয়া জনবল ও ভূমির আয়তনে আজারবাইজানের এক তৃতীয়াংশের চেয়েও কম। অর্থনৈতিক দিক থেকেও আজারবাইজানের ধারে কাছেও নেই তারা। তারপর শুধু রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সমর্থনে ও ফ্রান্সের মতো মুসলিমবিদ্বেষী পাশ্চাত্য দেশগুলোর সাহায্য ও প্ররোচনায় প্রায় ৩০ বছর আগে আজারবাইজানের সামরিক দুর্বলতার সুযোগে ২০ ভাগ ভূমি দখল করেছিল। আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আজারবাইজানের থাকলেও এলাকাটি তারা যুদ্ধ ছাড়া ছাড়তে রাজি ছিল না। তাই যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয় আজারবাইজান।
আর্মেনিয়া এই অঞ্চলটি দখল করার পর সেখানে শত শত বছর ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাস করা আজারিদের বিতাড়িত করে। তাদের ভূসম্পত্তির পাশাপাশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও চলে যায় আর্মেনিয়ানদের হাতে। আজারিরা শূন্য হাতে আজারবাইজান ও তুরস্কের বিভিন্ন এলাকায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। আজারবাইজানের এবারের জয়ের পর তারা আবার তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে ফিরে যেতে শুরু করেছে।
আজারবাইজান : বিপুল অর্জন
এই যুদ্ধ আজারবাইজানের জন্য ছিল বড় একটি পরীক্ষা। তবে তারা তাতে পুরোপুরি সফল হয়েছে। অনেক আত্মত্যাগের পর সাফল্য পাওয়ায় তারা এখন এই জয়কে উদযাপন করছে। আবার আনন্দমিছিলে আজারবাইজানের পতাকার পাশাপাশি তুরস্কের পতাকাও দেখা গেছে। এই জয়ের মাধ্যমে আজারবাইজান ৩০ বছর আগের পরাজয়ের প্রতিশোধ গ্রহণ করতেও সক্ষম হয়। ৩০ হাজার শহিদের রক্তে অর্জিত এই জয় উদযাপনে তাই উদ্দীপনার কমতি ছিল না।
নাগার্নো-কারাবাখ জয়ের জন্য এবার আজারবাইজান বেশ আটঘাঁট বেঁধে নেমেছিল। তাদের যুদ্ধ প্রস্তুতিতে সহায়তায় এগিয়ে আসে তুরস্ক। ২৭ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার দিনই তুরস্ক সরকার জানিয়ে দেয় যে তারা সর্বশক্তি দিয়ে আজারি ভাইদের সহায়তা করবে। অবশ্য কেবল তুরস্ক নয়, ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক ভালো রেখে সেখান থেকেও কিছু ড্রোন ও সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছিল আজারবাইজান। তেলের কারণে আজারবাইজানের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলতেই হয় ইসরাইলকে। আজারবাইজানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার পেছনে ইসরাইলের আরেকটি কারণ রয়েছে। আর তা হলো আজারবাইজানের প্রতিবেশি ইরানের বিরুদ্ধে নিজস্ব কর্মসূচি বাস্তবায়নের সুযোগ কাজে লাগানো।
আজারবাইজান এই জয়ের মাধ্যমে বিশ্বকে জানিয়ে দিলো যে তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে একটি শক্তিশালী জাতি ও দেশ। কেউ তাদেরকে দুর্বল ভাবলে ভুল করবে। তারা আরো প্রমাণ করেছে যে সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী না হলে বিশ্ব মোড়লেরা তাদের নিয়ে খেলতেই থাকবে, কোনো সমস্যার সমাধান করবে না। নিজেদের সমস্যার সমাধান নিজেদেরই করতে হবে।
নাগার্নো-কারাবাখ যুদ্ধে জয়ের মাধ্যমে ওই স্বীকৃতিই অর্জন করেছে আজারবাইজান। যুদ্ধে আর্মেনিয়া পরাজয় মেনে নিয়েছে। তারা নাকচিবান ও দুই অঞ্চলের মধ্যে সংযোগকারী একটি রাস্তাও ছেড়ে দিতে রাজি হয়। এই সুবিধা তুরস্কও পাবে। কারণ এলাকাটি তুরস্কের সাথেও সংযুক্ত।
আর্মেনিয়া: পুরোটাই ক্ষতি
আজারবাইজানে যখন আনন্দমিছিল চলছে, তখন আর্মেনিয়ায় শোকের মাতম দেখা যাচ্ছে। পরাজয়ের গ্লানিতে দায়ী ব্যক্তিদের ওপর চড়াও হয়েছে আর্মেনিয়ানরা। ক্ষুব্ধ জনতা পার্লামেন্টে প্রবেশ করে স্পিকারকে জখম করেছে, প্রধানমন্ত্রীর অফিসে প্রবেশের চেষ্টা করেছে। জনসাধারণের ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইতোমধ্যেই পদত্যাগ করেছেন। সরকারের পতন হয়ে যেতে পারে যেকোনো সময়। যতই দিন যাবে, তারা আরো বেশি কঠিন অবস্থায় পড়বে। এই যুদ্ধের ফলে দীর্ঘ দিন ধরে দখল করে রাখা এলাকাই কেবল তাদের হাতছাড়া হয়নি, তারা যে শক্তিতেও অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাও বিশ্বের কাছে প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া তারা যে প্রতিহিংসাপরায়ণ জাতি, তাও প্রমাণিত হয়েছে। শান্তিচুক্তি সই করার পর ওই এলাকা থেকে সরে যাওয়ার সময় আর্মেনিয়ানরা তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। আজারবাইজানিরা যাতে এসব বাড়িঘর ব্যবহার করতে না পারে, সেজন্যই তারা এই ব্যবস্থা নেয়। মনে রাখতে হবে, এসব বাড়িঘরের মালিক কিন্তু তারা নয়। ত্রিশ বছর আগে আজারিদের তাড়িয়ে দিয়ে এসব বাড়িঘর দখল করেছিল আর্মেনিয়ানরা।
তুরস্ক: দুর্দান্ত সাফল্য
আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে আজারবাইজানের এই বিপুল সাফল্যের পেছনে ছিল তুরস্কের সর্বাত্মক সহযোগিতা। কয়েক বছর ধরেই আজারবাইজানি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে গড়ে তুলছিল তুরস্ক। তাছাড়া অস্ত্র পাওয়ার জন্য ইসরাইল ও রাশিয়ার সাথেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এই সুসম্পর্কের কারণেই যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের বিরোধিতা করেনি দেশ দুটি। আর্মেনিয়ার সাথে রাশিয়ার সামরিক চুক্তি ছিল। কিন্তু তবুও রাশিয়া বলে দিয়েছে, আর্মেনিয়ার মূল ভূখ- আক্রান্ত হলেই কেবল তারা ওই চুক্তি অনুযায়ী সহায়তা করতে পারে। রাশিয়া প্রকাশ্যে স্বীকার করে যে নাগার্নো-কারাবাগ হলো আজারবাইজানের ভূমি। ফলে সেখানে যুদ্ধ হলে রাশিয়া কোনো ভূমিকা পালন করবে না। অবশ্য শেষ মুহূর্তে রাশিয়া সামনে এসে আর্মেনিয়াকে আরো বড় ধরনের অপমানজনক অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে।
তবে এসবের পেছনে প্রধান খেলোয়াড় ছিল তুরস্ক। তুরস্কের কারণেই রাশিয়া যুদ্ধে আর্মেনিয়ার পক্ষে যোগ দেয়নি, তা বলাই বাহুল্য। আর তাতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়িপ এরদোগানের কূটনৈতিক সাফল্যও স্বীকৃতি লাভ করেছে। তিনি একাই ফ্রান্স, রাশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আমিরাত, মিসরকে রুখে দিয়েছেন।
যুদ্ধের আগেই সামরিক ড্রোন ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জাম পর্যাপ্ত পরিমাণে সরবরাহ করে রেখেছিল তুরস্ক। এমনকি যুদ্ধ শুরুর কয়েক দিন আগে যৌথ সামরিক মহড়ার নামে আজারবাইজানে এফ-১৬ জঙ্গি বিমান, ড্রোনও নিয়ে আসা হয়। পরিকল্পনা ছিল যে অন্য কোনো দেশ আর্মেনিয়ার সমর্থনে এগিয়ে এলে তুরস্ক সরাসরি যুদ্ধে নামবে। কোন কোন দেশ আর্মেনিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারে, সে সম্পর্কে তুরস্কের পরিষ্কার ধারণা ছিল। বিশেষ করে ম্যাক্রোঁর ফ্রান্স ও রাশিয়ার এগিয়ে আসার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তুর্কি কূটনীতির কারণে তারা আর্মেনিয়ার সমর্থনে এগিয়ে আসতে পারেনি।
এই যুদ্ধে তুরস্ক বেশ কয়েকটি দিক থেকে লাভবান হয়েছে। প্রথমত, এর মাধ্যমে তুরস্কের নতুন উত্থানের স্বীকৃতি পাওয়া গেছে। তুর্কি অস্ত্র ও সামরিক কৌশল সারা দুনিয়ায় প্রশংসিত হচ্ছে। সারা দুনিয়াই তুর্কি সক্ষমতা বুঝতে পেরেছে। তুর্কি অস্ত্র সম্ভার, বিশেষ করে ড্রোনের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। আর এর বিক্রি বাড়া মানে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া।
শান্তিচুক্তির আওতায় নাকচিবানের সাথে আজারবাইজানের মূল ভূখ-ের সংযোগ স্থাপন করতে দিতে রাজি হয়েছে আর্মেনিয়া। এই সংযোগ সড়ক তুরস্কও ব্যবহার করতে পারবে। এর মাধ্যমে তুর্কীয় ভাষাভাষী অন্যান্য অঞ্চল- বিশেষ করে উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তানসহ মধ্য এশিয়ার অন্যান্য অঞ্চলের সাথে তুরস্ক সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবে। এসব দেশের সাথে তুরস্কের বাণিজ্য ব্যাপকভাবে বেড়ে যেতে পারে। উসমানিয়া খিলাফতের আমলে এসব দেশ ছিল তুরস্কের অংশবিশেষ। এত দিন কয়েক হাজার মাইল ঘুরে জর্জিয়ার মাধ্যমে এসব দেশের সাথে বাণিজ্য করত তুরস্ক। ফলে তা ছিল ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ।
আজারবাইজান থেকে জ্বালানি আমদানি বাড়িয়ে রাশিয়ার ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে পারবে তুরস্ক। আবার তুরস্কের সাথে মিলে অভিন্ন এজেন্ডা বাস্তবায়নে কাজ করতে পারবে আজারবাইজান। তুরস্কের সাথে থেকে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আজারবাইজানের উত্থান হবে।
পাকিস্তান: সম্ভাবনার সূচনা
বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ৩০ বছরের আগেও যুদ্ধে আজারবাইজানকে যথাসাধ্য সাহায্য করেছে পাকিস্তান। ওই সময় পাকিস্তান নিজেও বর্তমানের মতো শক্তিশালী ছিল না। পাকিস্তান বর্তমানে একমাত্র মুসলিম দেশ পরমাণু বোমার অধিকারী। তবে তারা চীনের সহায়তায় আরো অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্রের অধিকারী। জেএফ-১৭ জঙ্গিবিমান, ট্যাঙ্ক, মিসাইলসহ অন্যান্য অস্ত্র তৈরীতে বানাতে সক্ষম হয়েছে।
এবার যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে তুরস্কের পরেই পাকিস্তান আজারবাইজানকে পূর্বের মতই মুসলিম ভ্রাতৃম দেশ হিসাবে পূর্ণ সমর্থন জানায়। বিভিন্ন পত্রিকায় খবর এসেছে পাকিস্তানী সৈন্যরা আযেরী সৈন্যদের সাথে আর্মেনিয়ার সাথে যুদ্ধ করছে। এমনকি আরর্মেনিয়াও অভিযোগ করেছে। যে কারনে আজারবাইজানীরা যুদ্ধ চলা অবস্থায় অনেক বাসাবাড়ীতে তুরস্কের পতাকার সাথে পাকিস্তানী পতাকাও উড়িয়েছে।
দুর্নীতি, রাজনৈতিক গোলযোগের কারণে পাকিস্তান তার কাক্সিক্ষত সাফল্য পেতে পারছে না। এর সাথে যোগ হয়েছে সৌদি আরবের সাথে তাদের সম্পর্কের অবনতি হওয়া। আগে সৌদি আরব নানাভাবে পাকিস্তানকে সহায়তা করেছিল। কিন্তু তারা আগের ঋণ পরিশোধেই চাপ দিয়ে আসছে। তবে আজারবাইজান হতে পারে পাকিস্তানের নতুন ভরসার স্থল। সৌদি আরবের বদলে এই দেশ থেকেই পাকিস্তান জ্বালানি আমদানি করতে পারে। আজারবাইজানি তেল ও গ্যাস হতে পারে পাকিস্তানের অন্যতম ভরসা।
রাশিয়া: ক্ষয়িঞ্চু শক্তি রক্ষার চেষ্টা
পরাশক্তি রাশিয়া ১৯২০ সালের দিকে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের সময় মধ্য এশিয়ার সব দেশ সামরিক ও জনশক্তির জোরে দখল করে নেয়। ওই সময়ই ককেসাসের আজারবাইজান, আর্মেনিয়া ও জর্জিয়াও দখল করে নিজ সাম্রাজ্য ভুক্ত করে নিয়েছিল। তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর আজারবাইজান ও আর্মেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। সোভিয়েতের পতনের পরও এই অঞ্চলে রাশিয়ার প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। এই অঞ্চল বলতে গেলে এখন তাদের একচ্ছত্র অস্ত্রের বাজার। অন্যান্য সুযোগ সুবিধাও পাচ্ছে রাশিয়া। এই অঞ্চলে কিছু হলে তারাই নিজের প্রভাব খাটিয়ে মীমাংসা করে। তবে এই প্রভাব এখন ধীরে ধীরে কমে আসছে। আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধেও তা দেখা গেছে। এবারই প্রথম তুরস্ককে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাগার্নো-কারাবাখে তুরস্ককে যৌথ শান্তি বাহিনীতে নিয়েছে। উভয় শক্তি এক সাথে যুদ্ধ বিরতি তদারকি করছে।
ইরান : দ্বিধার অবসান হবে কী?
ইরানের সাথে আজারবাইজানের সাথে সম্পর্ক ধর্মীয়। কারণ জাতিগত দিক থেকে আজারবাইজানিরা তুর্কি হলেও ধর্মীয়ভাবে তারা শিয়া। আবার উসামনিয়া খেলাফাতের আগে এই এলাকা ইরানের অধীনে ছিল। এবং প্রায় দুই কোটির মতো আজারি অধিবাসী এখনো ইরানের অন্তর্ভুক্ত। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর অতি উৎসাহী ইরানি নেতারা আজারবাইজানেও ইসলামী বিপ্লব রফতানি করতে চেয়েছিল। এ কারণে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া ইরানের আরেকটি ভয়ের কারণ হলো, ইরানি আজারিদের আজারবাইজানের সাথে যোগ দেয়ার আন্দোলন।
আবার আজারবাইজানে ইসরাইলের উপস্থিতিও ইরানের জন্য শঙ্কার কারণ। ১৯৯০-এর দিকে আজারবাইজান ছোট প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার কাছে রাশিয়ার কারণে অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়েছিল। তখনি ইসরাইল সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আজারবাইজানে ঢুকে পড়ে। আজারবাইজান থেকে ইসরাইল তার জ্বালানির প্রায় ৮০ ভাগ আমদানি করে থাকে। এর বিনিময়ে তারা অস্ত্র রফতানি করে আজারবাইজানে।
অন্যদিকে ইরানের শ্লোগানের ভয়ে আজারিদেরকে ব্যবহার করে ইরানে বিভিন্ন রকমের অন্তর্ঘাত অভিযান পরিচালনা করত। এ কারণে ইরানের সাথে সম্পর্ক খুবই খারাপ অর্থাৎ তলানিতে পৌঁছেছিল। এ কারণে আর্মেনিয়ার সাথে সম্পর্ক স্থাপনকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল ইরান। অবশ্য পরে আজারবাইজানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে ইরান। ইরান সরকার ও দেশটির সর্বোচ্চ নেতা ইমাম খামেনিও সমর্থন জানান আজারবাইজানের। তাতে আজারবাইজান ও ইরানের মধ্যে আবার ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ইসরাইল : তবুও লাভবান
নানা কারণে আজারবাইজানের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল ইসরাইল। আজারবাইজানে ইসরাইল তাদের আধুনিক হেরন ড্রোনসহ বিভিন্ন আধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এমনকি এই যুদ্ধেও আর্মেনিয়াকে সমর্থন করেনি ইসরাইল। এর ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ফ্রান্স : সমুচিত শিক্ষা
বর্তমানে তুরস্কের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার ফ্রান্স। মনে রাখতে হবে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত উসমানিয়া খেলাফত ছিল দুনিয়ার একক পরাশক্তি। এই ফ্রান্সই রাশিয়া ও ব্রিটেনকে সাথে নিয়ে উসমানিয়া খেলাফতের পতনের জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিশাল উসামনিয়া খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে সা¤্রাজ্যটি ভেঙে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করার ফন্দি করে। তারা এতে অনেকাংশেই সফল হয়। তবে মুসলিমবিশ্বকে এ জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে।
তবে এখন ফ্রান্সকে কঠোরভাবে প্রতিরোধ করেছে তুরস্ক। এই যুদ্ধের মাধ্যমে তুরস্ক প্রমাণ করেছে যে তাদেরকে আর দমিয়ে রাখা যাবে না, তারা শিগগিরই বিশ্বশক্তিতে পরিণত হতে যাচ্ছে। আর্মেনিয়ার এই পরাজয় থেকে ফ্রান্সসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলো শিক্ষা গ্রহণ করবে বলে আশা করা যায়। এই যুদ্ধটি এমন এক সময় শুরু হয় যখন আমেরিকা তার জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিল যে কারনে আজারবান আর্মেনিয়ার যুদ্ধে নজর দেয়ার মত অবস্থানে ছিলনা।
লেখক পরিচিতি : যুক্তরাজ্যপ্রবাসী; লেখক : তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান : সফলতার রহস্য