নির্বাচনে পরাজয় : যেভাবে শত্রু বাড়িয়ে চলেছেন ট্রাম্প
ট্রাম্প - ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রয়েছে নিজের শত্রু বাড়ানোর দীর্ঘ ইতিহাস। বিশেষ করে তার বন্ধুদের মধ্য থেকে, যারা তাকে সর্বাত্মকভাবে সহায়তা দিয়েছেন। তার দীর্ঘ সময়ের আইনি সহায়ক এবং মধ্যস্থতাকারী মাইকেল কোহেন থেকে সাবেক ক্যাবিনেট কর্মকর্তা পর্যন্ত, নিয়মিতভাবেই, ট্রাম্প যার কাছেই তিনি অসম্মানিত হয়েছেন বলে মনে করেছেন, তাকেই তিনি বাদ দিয়েছেন।
বর্তমানে,প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের বিজয় অস্বীকার চেষ্টার ধারাবাহিকতায়, ট্রাম্পের বন্ধু থেকে শত্রুতে রূপান্তরিত হওয়ার নতুন তালিকা এসেছে। সর্বাত্মকভাবে অনুগত একদল সহায়কতাকারী বর্তমানে বাদের তালিকায় কেননা ট্রাম্প মনে করছেন, তারা তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন।
অ্যাটর্নি জেনারেল বিল বার
বাইডেনের ইলেকট্ররাল কলেজের বিজয় নিশ্চিতের মিনিটখানিক পরেই, ট্রাম্প ঘোষণা করেন বার তার পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।যা তার মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস আগেই কার্যকর হয়েছে। যদিও ট্রাম্প জোর দিয়ে বলছেন, বন্ধুত্বপূর্ণ অবস্থাতেই বার বিদায় নিচ্ছেন, তথাপি ডিসেম্বরের শুরুতে এসোসিয়েটেড প্রেসের কাছে বারের প্রসঙ্গে ট্রাম্প তার তিক্ততা প্রকাশ করে বলেন,“তিনি এমন একটি মাত্রাকে জোচ্চুরি হিসেবে বিবেচনা করেননি যা ভিন্নভাবে নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করতে পারতো। ”
একইসাথে বার নির্বাচনের ফলাফল প্রসঙ্গে বিচার বিভাগীয় তদন্তের পর এফবিআইয়ের তদন্ত চালানোর বিষয়ে বার তাৎক্ষণিকভাবে পদক্ষেপ না নেওয়ায় ট্রাম্প বারের ওপর ক্ষুব্ধ।
এপিতে বারের মন্তব্যের পরে ট্রাম্পকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, বারের ওপর তার আস্থা আছে কিনা। ট্রাম্প এই প্রশ্নের উত্তর দিতে অস্বীকার করেন।
বারের পদত্যাগপত্র জমা দেওয়ার আগমুহূর্তে,টুইটারে ট্রাম্প বারের প্রসঙ্গে মন্তব্য করেন, বাইডেনের ছেলে হান্টারের বৈদেশিক বাণিজ্যের বিষয়ে তিনি যথাযথ তদন্ত করেননি।
ফক্স নিউজ
বলা হয়,ট্রাম্পের সাথে ডানে ঝোঁকা ফক্স নিউজের সম্পর্ক ও বোঝাপড়া উষ্ণ। বছরের পর বছর এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেওয়া এবং প্রতিষ্ঠানটির উপস্থাপকদের প্রায় অখণ্ড সমর্থন পাওয়ার পরও, ট্রাম্প বর্তমানে ফক্স নিউজের সমালোচনা করছেন। যদিও প্রতিষ্ঠানটি আগের মতোই বেশি রক্ষণশীল সংবাদের ধারাই অব্যাহত রেখেছে।
কোন বিষয় ট্রাম্পকে উত্তেজিত করলো? প্রথমত, আরিজোনায় নির্বাচনের রাতে প্রথম সংবাদ সংস্থা হিসেবে ফক্স নিউজ জো বাইডেনের বিজয়ের পূর্বাভাস প্রচার করেছিলো। যা বাইডেনের কাছে ট্রাম্পের সম্পূর্ণ পরাজয়ের প্রাথমিক ঘটনাপ্রবাহের সূচনা করে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তার ক্ষোভ আরো বাড়ে যখন ফক্স নিউজ সানডের উপস্থাপক ক্রিস ওয়ালেস এক সংবাদাতাকে সংশোধন করে দেন জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট হিসেবে উল্লেখ করে। ফক্স নিউজের নিয়মিত অতিথি, গ্যারাল্ডো রিভেরার কাছে এসময় তিনি স্বীকার করেন,“ট্রাম্প আমার সাথে এখন যোগাযোগ করছেন না কেননা এই নির্বাচনে আমার ভূমিকা শেষ হয়েছ। ”
ট্রাম্প বিশেষ করে ফক্স নিউজের ‘ডে টাইম’ প্রোগ্রামকে আক্রমণ করছেন যেখানে হ্যানেনটাই ও কার্লসনের মতামতভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘লেট নাইটে’র তুলনায় সংবাদ বেশি গুরুত্ব পায়। ট্রাম্প বর্তমানে তার সমর্থকদের সংবাদের জন্য নিউজম্যাক্স ও ওএএনএন অনুসরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন, যেখানে ট্রাম্পের কাছ থেকে ডেমোক্রেটদের নির্বাচনের ফলাফল ছিনতাই করার অসমর্থিত অভিযোগ প্রচারে ট্রাম্প ও তার সমর্থকদের সহায়তা করা হচ্ছে।
জর্জিয়ার রিপাবলিক কর্মকর্তারা
জর্জিয়ার গভর্নর ব্রায়ান ক্যাম্প ২০১৮ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পক্ষ থেকে সমর্থন পান। ২০২০ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন এবং ট্রাম্পের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা করেন| কিন্তু এখন ওই ট্রাম্পই আসন্ন গভর্নর নির্বাচনে তার বদলে অন্যকে সমর্থন করার কথা বলছেন। গভর্নর হিসেবে ক্যাম্প জর্জিয়ায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলকে সমর্থন করে স্বাক্ষর করেছেন যেখানে ১৯৯২ সালের পর প্রথমবারের মতো রাজ্যটি একজন ডেমোক্রেট প্রার্থীকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত করেছে।
এর আগে, ট্রাম্প ক্যাম্পের নির্বাচনের বিজয়ে নিজেকে প্রধানতম শক্তি হিসেবে বিবেচনা করতেন। গত এপ্রিলে এক সম্মেলনে এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,“ তার নির্বাচনে বিজয়ের জন্য আমি প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছি.... আমার এগিয়ে এসে সমর্থনের পর তিনি প্রাইমারি নির্বাচনে জয়ী হন। সুতরাং আমার ও ব্রায়ান ক্যাম্পের মধ্যে অনেক ভালো বিষয় ও অনুভূতি রয়েছে। আমি তাকে অনেক পছন্দ করি।”
বর্তমানে, ট্রাম্প প্রশাসন রাজ্যের সর্বোচ্চ রিপাবলিকান কর্মকর্তাকে ট্রাম্পের সুবিধায় ভোট গণনায় হস্তক্ষেপ না করার জন্য দোষারোপ করছে।
এর পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমানে ট্রাম্প তার এক অটুট সহায়ক, রিপ্রেজেন্টিটিভ ডগ কলিন্সকে ২০২২ সালে ক্যাম্পের বিরুদ্ধে নির্বাচন করার আহ্বান জানাচ্ছেন। এ মাসের শুরুতে জর্জিয়ার ভালডোস্টায় এক র্যা লিতে ট্রাম্প বলেন,. “ডগ, আগামী দুই বছরের মধ্যে কি আপনি গভর্নর পদে নির্বাচনে দাঁড়াতে চান?” তিনি আরও বলেন,“ গভর্নর হিসেবে কলিন্স হতে পারেন উত্তম প্রার্থী।”
এছাড়া জর্জিয়ার লেফটেন্যান্ট গভর্নর জেফ ডানকান এবং স্টেট সেক্রেটারি ব্রাড র্যা ফেনস্প্রেগারসহ রাজ্যের অন্য রিপাবলিকান শীর্ষ কর্মকর্তারাও শিকার হয়েছেন ট্রাম্পের ক্ষোভের। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, এ দু’জন কর্মকর্তাই তার অখণ্ড অনুগত ছিলেন। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, তারা ক্যাম্পের সাথেই একত্রে রাজ্যের ভোট গণনা ও নিশ্চিতের সাধারণ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেন।র্যা ফেনস্প্রেগারের আজীবন রিপাবলিক সমর্থক হিসেবে থাকার দাবি এবং নির্বাচনে ট্রাম্পের বিজয়ের জন্য তার প্রত্যাশার কথা জানানোর পরেও প্রত্যুত্তরে ট্রাম্প তাকে পদত্যাগের আহ্বান জানিয়েছেন।
গর্ভনর ডগ ডুসি
ক্যাম্পের মতোই আরিজোনার গভর্নর ডগ ডুসি আরিজোনায় নির্বাচনের ফলাফলে স্বাক্ষরের পর তীব্র প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হয়েছেন। রিপাবলিকানদের ঘাঁটি এ রাজ্যটিও নির্বাচনের বাইডেনের পক্ষে রায় দেয়।
ডুসির প্রসঙ্গে ট্রাম্পের মন্তব্য এখন সম্পূর্ণ বিপরীত। অক্টোবরে নির্বাচনে প্রচারণার সময় ট্রাম্প ডুসিকে ‘দেশের অন্যতম উত্তম গভর্নর’ হিসেবে উল্লেখ করেন। পরবর্তীতে তিনি বলেন,“পৃথিবীতে আর কোনোও মানুষ নেই ডগ ডুসি ছাড়া, যিনি এমন অসদাচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন যা আমিও নিয়ন্ত্রণ করেছি।” সুতরাং ট্রাম্প কি করে “আপনি আমার কাছে যাই চাবেন, তা আমরা করবো”র প্রতিশ্রুতি থেকে ডুসিকে “আমেরিকার জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা” করার অভিযুক্ত করতে পারেন?
ডুসি তার আত্মপক্ষ সমর্থনে শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। তিনি বলেন,“যদি আপনি ফলাফলের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে চান, এখনোই সময়। আপনার অভিযোগ করুন, এটিই আইন। এটি রক্ষার জন্যই আমি শপথ নিয়েছি এবং আমি আমার দায়িত্ব গুরুত্বের সাথেই নিয়েছি।”
সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এ্যাসপার
২০১৯ এর জুনে যখন মার্ক এ্যাসপার ভারপ্রাপ্ত প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান, ট্রাম্প তখন তার প্রসঙ্গে বলেন,“নিঃসন্দেহে তিনি চমৎকার কাজ করছেন।”
এ্যাসপার গতমাসে দায়িত্বচ্যুত হন। বছরের মাঝে ট্রাম্পের সাথে তার মতভেদের পরিপ্রেক্ষিতে তার এই পদচ্যুতি ঘটে, যখন তিনি মত দেন, মার্কিন সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত সদস্যদেরই আমেরিকার রাস্তায় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যবহার করা উচিত।
মে মাসে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর ঘটনায় আমেরিকার বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ ও লুটপাট ছড়িয়ে পড়লে ট্রাম্প বিক্ষোভ থামাতে,“ফেডারেল সরকার এবং আমাদের সেনাবাহিনীর অপরিমেয় শক্তি ব্যবহার করা হবে” বলে হুমকি দেন।
এ্যাসপার রিপোর্টারদের কাছে সামরিক বাহিনীকে “সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে এবং শুধু গুরুতর জরুরি মুহূর্তেই ব্যবহার করা উচিত” বলে মত প্রকাশ করেন।
এ মন্তব্যের পরই এ্যাসপারের দায়িত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায় এবং ৯ নভেম্বর ট্রাম্প তাকে পদচ্যুত করেন।
সূত্র : আল জাজিরা