টিকা নিয়ে কী হচ্ছে ভারতে?
টিকা নিয়ে কী হচ্ছে ভারতে? - ছবি : সংগৃহীত
ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুরু হয়েছে করোনাভাইরাসের টিকা বা ভ্যাকসিন দেয়ার কাজ৷ ভারতেও অদূর ভবিষ্যতে তা শুরু হয়ে যাবে৷ তিনটি কোম্পানি জরুরি ভিত্তিতে ভ্যাকসিন চালুর অনুমতি চেয়েছে৷ নীতি আয়োগের সদস্য বিনোদ পল জানিয়েছেন, খুব তাড়াতাড়ি ভারতেও ভ্যাকসিন দেয়া শুরু হয়ে যাবে৷ নিঃসন্দেহে সুখবর৷ কিন্তু এই সুখবরের সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্ত জরুরি ও প্রাসঙ্গিক কয়েকটি প্রশ্ন উঠছে৷ কীভাবে দেয়া হবে এই ভ্যাকসিন? কারা প্রথমে পাবেন? বাকিরা কখন পাবেন? কীসের ভিত্তিতে রাজ্যগুলিকে ভ্যাকসিন দেয়া হবে? কারা দেবেন? এ তো এক আধ লক্ষ টিকা দেয়া নয়, ১৩০ কোটি মানুষকে দুই বার করে ভ্যাকসিন দেয়া মানে ২৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে৷ কবে পাওয়া যাবে অত ভ্যাকসিন? এই ভ্যাকসিন কি বাধ্যতামূলক হবে?
এই প্রশ্নগুলো দেখেই বোঝা যাচ্ছে, বিষয়টা বেশ জটিল৷ একটু অসাবধান হলেই পুরো প্রক্রিয়া বেহাল হয়ে যেতে পারে৷ উপমহাদেশে সরকারি বহু কর্মসূচির মতোই ঘেঁটে যেতে পারে পুরোটা৷ আর যেহেতু ভারতে সবকিছুর মধ্যেই রাজনীতি ঢুকে পড়ে, তাই করোনা-ভ্যাকসিন দেয়ার মধ্যেও যে তার প্রবেশ ঘটবে না, এই গ্যারান্টি কে দেবে? বিশেষ করে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ সহ পাঁচটি রাজ্যে বিধানসভা ভোট, তখন ভ্যাকসিন-রাজনীতির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ ফলে পরিস্থিতি বেশ জটিল৷
করোনা ভ্যাকসিন দেয়া নিয়ে নীতি নির্ধারণ করার জন্য ন্যাশনাল এক্সপার্ট গ্রুপ অন ভ্যাকসিন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অন কোভিড তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ তারা অন্তত বার দশেক বৈঠকে বসেছেন৷ প্রধানমন্ত্রী আলোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে৷ রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে সরকার আলোচনা করেছে৷ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিশেষজ্ঞদের কথা হয়েছে৷ তারপর ঠিক হয়েছে, প্রথমে ভ্যাকসিন দেয়া হবে চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মীদের৷ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত এক কোটি মানুষ প্রথমে এই প্রতিষেধক নিতে পারবেন৷ তারপর পাবেন পুলিশ, পুরসভার কর্মীদের মতো ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কাররা, যাঁরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একেবারে সামনে আছেন৷ তাদের সংখ্যা দুই কোটির মতো৷ এঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য পুলিশ, সেনা, হোমগার্ড, সিভিল ডিফেন্সের সঙ্গে জড়িত কর্মী, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও পুরসভার কর্মীরা আছেন৷ তারপর প্রতিষেধক নিতে পারবেন পঞ্চাশ বছর বা তার বেশি বয়সীরা৷ তাদের সংখ্যা প্রায় ২৭ কোটি৷ ভোটার তালিকা থেকে তাদের চিহ্নিত করা হবে৷ তার সঙ্গে কম বয়সী অথচ যারা ডায়াবেটিস, হাইপারটেনশন সহ বিভিন্ন গুরুতর অসুখে ভুগছেন, তারা প্রতিষেধক নেয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবেন৷
এখনো পর্যন্ত অগ্রাধিকারের এই তালিকা তৈরি করতে পেরেছে কমিটি৷ শিক্ষকেরা কবে প্রতিষেধক নিতে পারবেন তা নিয়ে কমিটিতে আলোচনা হয়েছে৷ কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি৷ গত নয় মাস ধরে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শুধু অনলাইন ক্লাস হচ্ছে৷ ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিষেধক দেয়া জরুরি৷
প্রাথমিক যে তালিকা তৈরি করেছে কমিটি, সেখানে ৩০ কোটি মানুষকে রাখা হয়েছে৷ তার মানে মোট ৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন লাগবে তাঁদের জন্য৷ কিন্তু এখন কত ভ্যাকসিন হাতে পাবে ভারত? সেরাম ইনস্টিটিউট, যারা অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন কোভিশিল্ড তৈরি করছে, তারা প্রথমেই চার কোটি ডোজ দিতে পারবে৷ কিন্তু ফাইজার বা ভারতীয় কোম্পানি ভারত বয়োটেক ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ মেডিকেল রিসার্চের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিন প্রথমে কতটা হাতে পাওয়া যাবে তা তারা জানায়নি৷ ফাইজারের ভ্যাকসিনের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ ভারতে হয়নি৷ তর্কের খাতিয়ে যদি ধরে নেয়া যায়, তিনটি ভ্যাকসিনই অনুমোদন পেল এবং প্রথমেই তারা চার কোটি ডোজ করে দিতে পারবে, তা হলে মোট ১২ কোটি ভ্যাকসিন নিয়ে কাজ শুরু করা যাবে৷ তার মানে তালিকায় উল্লিখিত তিনটি গোষ্ঠীর মানুষই ভ্যাকসিন পাবেন৷ তবে সেখানেও সকলে পাবেন না৷ ৩০ কোটির মধ্যে মাত্র ছয় কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন দেয়া যাবে৷ সেরাম ইনস্টিটিউট হলো বিশ্বের সব চেয়ে বেশি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক, ফলে তাদের কাছে বেশি পরিমাণে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা আছে৷ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ-কে দেয়ার পর ফাইজার কি প্রথমেই চার কোটি ভ্যাকসিন ভারতকে দিতে পারবে? সম্ভবত না৷ ভারত বায়োটেকের পক্ষেও অত ভ্যাকসিন প্রথমেই তৈরি করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না৷
এই ভ্যাকসিনগুলো খুবই কম তাপমাত্রায় রাখতে হয়৷ ভারতে এখন যা ব্যবস্থা আছে, তাতে ছয় কোটি ডোজ ভ্যাকসিন একবারে দেয়া যাবে৷ সে ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী ও ফ্রন্টলাইন কর্মীদের দুইটি ডোজ দেয়া যাবে৷ ইতিমধ্যে একটা অ্যাপ তৈরি হয়েছে, যেখানে কাকে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে, তাপমাত্রা ঠিক আছে কি না, কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না, সেই সব তথ্য জানা যাবে৷ ঠিক হয়েছে, প্রথমে এক শ' জন করে গ্রুপ তৈরি করে ভ্যাকসিন দেয়া হবে৷ আধঘণ্টা অপেক্ষা করে দেখা হবে, তাঁদের কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে কি না৷ তারপর তাদের ছেড়ে দেয়া হবে৷ প্রতি বছর ভারতে দুই কোটি ৬০ লাখ নবজাতককে বিভিন্ন টিকা ও ইঞ্জেকশন দেয়া হয়৷ ফলে ভারতে প্রশিক্ষিত টিকা কর্মীর কোনো অভাব নেই৷ সব রাজ্যে তারা আছেন৷ এরকম বড় ইভেন্ট পরিচালনা করার দক্ষতাও তাঁদের আছে৷
কিন্তু গোলমাল এখানেই শেষ হচ্ছে না৷ ভারতে একাধিক ভ্যাকসিন ব্যবহার করা হবে৷ ধরা যাক, কোনো রাজ্যে পাঁচ লাখ লোককে ফাইজারের ভ্যাকসিন দেয়া হলো৷ তাকে দ্বিতীয় ডোজ তো ফাইজারেরই দিতে হবে৷ কিন্তু পরে দেখা গেল, ফাইজারের ভ্যাকসিন আসতে দেরি হচ্ছে৷ তখন? এ বিষয়ে একটি নির্দিষ্ট নীতি নেয়ার প্রয়োজন৷ সে বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে৷ প্রস্তাব এসেছে, একটি রাজ্যে একটি কোম্পানির ভ্যাকসিনই দেয়া হবে৷ কিন্তু তা নিয়ে সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি৷
দ্বিতীয় সমস্যা হলো, ভ্যাকসিনের খরচ কি শুধু কেন্দ্রীয় সরকার বহন করবে? বিহার নির্বাচনের আগে বিজেপি নেতাদের প্রতিশ্রুতি ছিল, সকলকে ভ্যাকসিন বিনামূল্যে দেয়া হবে৷ ধারণা হয়েছিল, কেন্দ্রীয় সরকারই পুরো খরচ দেবে৷ এখন কেন্দ্র পুরো দেবে, না কি, রাজ্য সরকারগুলিকে ৪০ শতাংশ খরচ দিতে বলবে তা পরিষ্কার নয়৷ ইউনিভার্সাল ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ৪০ শতাংশ খরচ দেয়৷
কিন্তু করোনাকালে রাজ্য সরকারের কোষাগার খালি৷ কেন্দ্রের হালও যে খুব ভালো, তা নয়৷ কেন্দ্র তো রাজ্যগুলিকে জিএসটির ক্ষতিপূরণ পর্যন্ত দিতে পারছিল না৷ ভ্যাকসিনের দাম যদি পাঁচশ টাকাও হয়, তা হলে ২৬০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন কিনতে খরচের ধাক্কা প্রবল৷ তা হলে? এত টাকা সরকার পাবে কোথায়? গরিবদের অবশ্যই বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দেয়া উচিত৷ কিন্তু যাঁরা দুই ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য হাজার টাকা খরচ করতে পারবেন, তাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া উচিত৷ আম্বানি, আদানিদের কথা ছেড়ে দিন, ভারতে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্য মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের সংখ্যা তো কম নয়৷ তারা এই ভ্যাকসিন নিজের খরচেই নিতে পারবেন৷ এখন রাজ্য সরকার যদি টাকা দেয়, তা হলে কি তারা ঠিক করতে পারবে, কোন ভ্যাকসিন নেবে, কোনটা নয়? এর উত্তরও অজানা৷
বেশ কিছু রাজ্য সরকার ভ্যাকসিন নিয়ে ঘোষণা শুরু করে দিয়েছে৷ তেলেঙ্গানা জানিয়েছে, জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে তারা প্রায় ৮০ লাখ মানুষকে ভ্যাকসিন দেবে৷ কী করে? জানা নেই৷ তেলেঙ্গানা যদি জানুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে ৮০ লাখ ভ্যাকসিন পায়, তা হলে বাকি রাজ্যের কী হবে? কমিটির নীতি হলো, রাজ্যে ৫০ বছরের উপরে ও কো-মর্বিডিটি সহ যত মানুষ আছেন, তার অনুপাতে ভ্যাকসিন দেয়া হবে৷ নজরদরির জন্য কুড়িজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী থাকবেন৷ এখন রাজ্যে কারা প্রথমে ভ্যাকসিন পাবেন, সেটা কে ঠিক করবে? কোনো রাজ্য যদি বলে বিদ্যুৎ কর্মীরাও ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, তাঁদের প্রথমে ভ্যাকসিন দিতে হবে, তখন কী হবে? ফলে ছিদ্র অনেক৷ এই সব ছিদ্র দিয়ে পিঁপড়ে তো দূরস্থান, বড় বড় হাতিও গলে যাবে৷ ফলে অব্যবস্থার ভরপুর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷ সব চেয়ে বড় কথা, খাতায় কলমে পরিকল্পনা করা এক, দিনের পর দিন তা ১৩০ কোটি মানুষের কাছে মসৃণভাবে পৌঁছে দেয়া আরেক কথা৷ তবে যে হারে ভ্যাকসিন আসবে, তাতে দেশের সকলের ভ্যাকসিন পেতে কয়েক বছর লেগে যাবে৷
এখানেই শেষ নয়৷ ভ্যাকসিন নেয়ার পর তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে৷ খুবই তড়িঘড়ি করে ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে৷ একমাত্র অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের রিপোর্ট হলো, তা বয়স্কদের উপর ভালো কাজ করছে৷ বাকিদের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো রিপোর্ট নেই৷ এরপর প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে পরে তা সারাবার জন্য যে খরচ করতে হবে, সেটা কে দেবে? ক্যানাডা সরকার ঘোষণা করেছে, এই খরচ বিমা কোম্পানি দেবে৷ কিন্তু ভারতে তো তেমন কোনো ঘোষণা হয়নি৷ তাই প্রতিক্রিয়া হলে, তা সারাবার জন্য হাসপাতালের খরচ গুণতে তো আম জনতাকে পাগল হয়ে যেতে হবে!
ফলে সাধু সাবধান৷ ভ্যাকসিন এসে গেলেই সব সমস্যার সমাধান হবে, করোনা পালাবে বলে যাঁরা ভাবছেন, তাদের অতটা উল্লসিত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ অন্তত ভারতে৷ সমস্যা অনেক৷ পদে পদে পুরো প্রক্রিয়া ঘেঁটে যেতে পারে, ঢুকে যেতে পারে রাজনীতি৷ আর প্রাথমিকভাবে ৩০ কোটি মানুষের জন্য ৬০ কোটি ভ্যাকসিন জোগাড় করে তাদের দিতেই কালঘাম ছুটে যাবে৷ তখনো বাকি থাকবে একশ কোটি লোকের ভ্যাকসিন নেয়া৷
সূত্র : ডয়চে ভেলে