কেমন আছে সালাহউদ্দিন আইয়ুবির বংশধররা?

আবির রায়হান | Dec 17, 2020 05:17 pm
সালাহউদ্দিন আইয়ুবি

সালাহউদ্দিন আইয়ুবি - ছবি সংগৃহীত

 

১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ইউরোপের মানচিত্র সম্পূর্ণ নতুন রূপ লাভ করে। কিন্তু মানচিত্রের এই পরিবর্তন শুধু ইউরোপেই সীমাবদ্ধ ছিল না। মধ্যপ্রাচ্যে উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর সাইকস-পিকো চুক্তির ফলে জন্ম নেয় একাধিক নতুন রাষ্ট্র, যদিও তারা জাতিপুঞ্জের অনুমতিসাপেক্ষে ব্রিটিশ-ফরাসি তত্ত্বাবধানে থাকে আরো কয়েক দশক। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের শুধু একটি জাতি পশ্চিমাদের অনুগ্রহ বঞ্চিত হয়ে নিজেদের স্বাধীন ভূখণ্ড লাভ করা থেকে বঞ্চিত হয়। আর তাদের সেই স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে আজও। সেই জাতির নাম কুর্দি জাতি।

তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও সিরিয়া- এই চার দেশের মধ্যবর্তী এক বিশাল পর্বতসঙ্কুল এলাকা জুড়ে বসবাস কুর্দি জাতিগোষ্ঠীর। তাদের মাতৃভূমির নাম তাদের নামে রাখা হয়েছে কুর্দিস্তান। এই অঞ্চলে বসবাসকৃত কুর্দিদের সংখ্যা চার কোটিরও বেশি এবং তারাই এ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্ত বিগত একশ বছর যাবত তারা নিজ ভূমে ভীষণ অত্যাচারের শিকার হয়ে আসছে। আর এর প্রতিক্রিয়ায় কুর্দিদের মধ্যে বারবার জেগে উঠেছে রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর প্রাচীন জাতি মিডীয়দের বংশধর হচ্ছে বর্তমান কুর্দিরা। মধ্যযুগে কুর্দিদের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবান্বিত সময় আসে ১১৮৭ সালে, যখন কুর্দি বীর সালাহউদ্দিন আল-আইয়ুবি হাত্তিনের যুদ্ধে ক্রুসেডারদের সম্পূর্ণভাবে পরাজিত করেন, ফলে জেরুসালেমসহ ফিলিস্তিন পুনরায়
মুসলিমদের অধীনে ফিরে আসে। সালাহউদ্দিনি আইয়ুবিকে তাই মধ্যপ্রাচ্যসহ সমগ্র মুসলিম বিশ্ব শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে থাকে। অথচ সালাহউদ্দিনের বংশধররা আজ তাদের মুসলিম ভাইদের হাতেই নির্মম নির্যাতনে নির্যাতিত।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সদ্য প্রজাতান্ত্রিক তরুণ তুর্কিদের নিয়ন্ত্রণাধীন উসমানীয় তুরস্ক কেন্দ্রীয় শক্তির সাথে যোগ দেয়। ফলে মিত্রশক্তির প্রধান পরাশক্তি ব্রিটেন উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনস্ত আরব অঞ্চলগুলোর নেতাদের সাথে এক সমঝোতায় আসে। এই অনানুষ্ঠানিক সমঝোতা অনুসারে তুর্কিদের আধিপত্যের হাত থেকে আরবদের স্বাধীনতায় সহযোগিতার বিনিময়ে আরবরা মিত্রশক্তির হয়ে উসমানীয় সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রবল বিদ্রোহ করে। কিন্তু অন্য দিকে যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মিত্রপক্ষের দুই পরাশক্তির দুই কূটনৈতিক ব্রিটিশ মার্ক সাইকস এবং ফরাসি ফ্রাঁসোয়া জর্জে-পিকো নিজ নিজ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে গোপনে এক চুক্তি করেন, যার পরিকল্পনা অনুসারে উসমানীয় সাম্রাজ্য থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া আরব অঞ্চল নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা করা অঙ্গীকার করে ব্রিটেন ও ফ্রান্স। যুদ্ধের পর রাষ্ট্রসংঘের আজ্ঞানুসারে তারা ইরাক, সিরিয়া, ট্রান্সজর্দান ও ফিলিস্তিনের সৃষ্টি করে। তবে সাইকস-পিকো চুক্তির মূল রূপ ছিল আরো অনেক ব্যাপক।

তুরস্ককে সম্পূর্ণভাবে খণ্ড-বিখণ্ড করার পরিকল্পনাও এর অংশ ছিল। মুস্তাফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কিরা স্বাধীনতা যুদ্ধ ব্রিটিশ-ফরাসি চক্রান্তকে নসাৎ করে দেয়। কিন্তু তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল কুর্দি জাতি। বিশেষত তুর্কি ও আরবদের আরো বেশি ক্ষুব্ধ হওয়ার আশঙ্কা থেকে ব্রিটিশ-ফরাসি সরকার বলকান অঞ্চলে তুর্কিদের প্রভাব খর্ব এবং লেভান্ত এলাকায় অমুসলিমদের জন্য নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা সত্ত্বেও কুর্দিদের বিষয়টি প্রায় সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে। অন্য দিকে তুরস্ক, ইরাক ও সিরিয়া নিজ নিজ দেশের কুর্দি সম্প্রদায়ের উপর খড়গহস্ত হয়ে ওঠে এই ভয়ে যে, কুর্দিদের মধ্যে স্বাধীনতার যে স্পৃহা গড়ে উঠেছে তা বিচ্ছিন্নতাবাদের দিকে অগ্রসর হবে।

তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তুরস্কের মধ্যে বসবাসকারী কুর্দিদের পশ্চিমারা ব্যবহার করতে পারে, এই ভয়ে তুরস্কে প্রায় ৭ লাখ কুর্দিকে মাতৃভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত করে অনত্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশেভাগ করে পুনর্বসত করানো হয়। তাদের মাতৃভূমিতে অন্য জাতির লোকদের বসতি স্থাপন করানো হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে-পরে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আরব দেশগুলোকে স্বাধীনতা প্রদান করলেও দেশগুলোতে তাদের তাঁবেদারি শাসকগোষ্ঠী বহাল থাকে। কিন্তু এ সময় আরব জাতীয়তাবাদের ব্যপক প্রসার হওয়া দ্রুত ইরাক-সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে প্রধানত সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বামপন্থী সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নেতারা ক্ষমতায় আসে। কিন্তু তারা তাদের কট্টর জাতীয়তাবাদী মানসিকতা ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক আদর্শের কারণে জাতিগত সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি প্রচন্ড দমন-পীড়ন চালানো হয়। বিশেষত ইরাক-সিরিয়ার বা’আসবাদী রাষ্ট্রযন্ত্র দেশ দু’টির প্রধান জাতিগত সংখ্যালঘু কুর্দিদের দমনের সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালায়। অনারব হওয়ায় কুর্দিদের আরব জাতির ঐক্যের প্রধান অন্তরায় এবং আরব মাতৃভূমির অখন্ডতার প্রধান হুমকি বলে মনে করত সাদ্দাম হোসেন ও হাফেজ আল-আসাদরা। ফলে কুর্দিদের জাতিগত পরিচয় অস্বীকার করা হয়, তাদের জোর করে আরব সংস্কৃতিতে একীভূত করার সাংস্কৃতিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। কুর্দিরা বাধ্য হয় আরব নাম গ্রহণ করতে, এমনকি রাষ্ট্রীয় পরিচয়পত্রে নিজেদের আরব বলে পরিচয় দিতে। ইরাক ও সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে কুর্দিস্তানকে আরবিকরণের প্রকল্প হাতে নেয় বা’আসবাদী সরকার দুটি। লাখ লাখ আরবকে কুর্দিস্তানে প্রেরণ করা হয় বসতি স্থাপনের জন্য, অন্য দিকে লাখ লাখ কুর্দিকে জোর করে পাঠানো দেশের অন্য কোথাও। কুর্দিরা এই জাতিগত শুদ্ধিকরণ প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফলে অত্যাচার-নির্যারতন ভয়াবহ আকার ধারন করে।

ইরাকের উত্তর-পূর্ব এলাকায় অবস্থিত কুর্দিস্তান অঞ্চল আয়তন ও জনসংখ্যায় কুর্দিদের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। আশির দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় ইরাকের কুর্দিরা ইরানের সহায়তাপুষ্ট হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু করলে সাদ্দামের সরকার কুর্দিবিরোধী আল-আনফাল অভিযান শুরু করে। এতে প্রায় দুই লাখ কুর্দি নিহত হয়। অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়ে হালাবজা শহরে বিষাক্ত গ্যাস প্রয়োগে প্রায় পাঁচ হাজার কুর্দিকে হত্যা করা হয়।
ফলে ১৯৯১ সালে ইরাকজুড়ে সাদ্দাম ও বা’আসবিরোধী সশস্ত্র গণজাগরণের পুরোভাগে ছিল কুর্দিরা। এই বিদ্রোহ কঠোর হস্তে দমন করে সাদ্দামের বা’আস দলীয় সরকার।

এদিকে ইরাকের কুয়েত আক্রমণের পর মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট কুয়েত দখলমুক্ত করতে উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু করে। এ সময় ইরাকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হিসেবে পশ্চিমারা কুর্দিদের প্রকাশ্যে সাহায্য-সহযোগিতা শুরু করে। কুর্দিস্তানের উপর ‘‘উড্ডয়নহীন এলাকা’’ ঘোষণা করা হয়। ২০০৩ সালে ইঙ্গ-মার্কিন জোটের ইরাক আক্রমণের পর ইরাকে কুর্দি সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাকে কেন্দ্র করে ‘‘কুর্দিস্তান রিজিয়ন’’ নামে একটি স্বায়ত্ত্বশাসিত এলাকা সৃষ্টি করা হয়, যা বাস্তবে প্রায় সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। ২০১৪ সালে সুন্নি আরব নেতৃত্বাধীন সংগঠন আইসিস তার সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড শুরু করলে অন্যতম প্রধান শত্রু হিসেবে কুর্দিদের লক্ষ্যবস্তু হিসেবে গণ্য করে তারা। এরপর কুর্দিদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সন্ত্রাসী অভিযান শুরু করে আইসিস। এর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্যতম হলো জাতিগত কুর্দি ইয়াজিদি ধর্মীয় গোষ্ঠীর উপর সংঘটিত গণহত্যা, যার মধ্যে সিনজার হত্যাকাণ্ড অন্যতম। কুর্দিস্তানের স্থানীয় সেনাবাহিনী পেশমের্গার নেতৃত্বে কুর্দিরা বীরবিক্রমে আইসিসকে মোকাবিলা করে এবং নিজেদের ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের আক্রান্তদের রক্ষা করে। গৃহযুদ্ধের ডামাডোল কিছুটা ঠাণ্ডা হলে ২০১৭-তে কুর্দিস্তান স্বায়ত্ত্বশাসিত সরকার এক গণভোটের মাধ্যমে স্বায়ত্ত্বশাসনের আওতায় থাকা ও না থাকা কুর্দি অধ্যুষিত সব এলাকাকে নিয়ে স্বাধীনতার ডাক দিলে শিয়া আরব প্রধান ইরাকি সরকার সৈন্য পাঠিয়ে সেই চেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয়।

অন্যদিকে সিরিয়ায় দীর্ঘদিন ধরে কুর্দিসহ সংখ্যালঘুদের নির্যাকতনের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ গড়ে ওঠে ২০১১ সালের গণবিক্ষোভ ও পরবর্তী গৃহযুদ্ধের সময়। এ সময় প্রধানত কুর্দিদের নেতৃত্বে জাতিগত সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ আরবদের নেতৃত্বাধীন সরকার বা ইসলামবাদী বিদ্রোহীগোষ্ঠীগুলোর কারো পক্ষে না গিয়ে নিজেরাই আলাদা স্বায়ত্ত্বশাসিত অঞ্চল গঠন করে উত্তর সিরিয়ায়। ‘‘অটোনমাস অ্যাডমিনিস্ট্র্যাশন অব নর্থ অ্যান্ড ইস্ট সিরিয়া’’ নামের এই অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘‘সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস’’। দুই সংগঠনেই নেতৃত্বে রয়েছে প্রধানত সিরিয়ার কুর্দি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা, বিশেষত ‘‘ডেমোক্র্যাটিক ইউনিয়ন পার্টি’’ (ওয়াইপিডি)। বিশেষত কুর্দি অধ্যুষিত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়াকে নতুন নামকরণ করা হয় ‘রোজাভা’ বা পশ্চিম, অর্থাৎ পশ্চিম কুর্দিস্তান। এতে করে আলাউই আরব সিরীয় সরকার ও সুন্নি আরব বিদ্রোহী - দুই পক্ষই কুর্দি নেতৃত্বাধীন জোটকে নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে গণ্য করে। সরকারি ও বিদ্রোহী বাহিনী রোজাভাকে বারংবার আক্রমণ করে। বিশেষত আইসিস ইরাকের মতো সিরিয়ায়ও কুর্দিবিরোধী অভিযান পরিচালনা করে, যার মধ্যে তুরস্ক সীমান্তবর্তী কোবানি আক্রমণ উল্লেখযোগ্য।

অন্যদিকে ইসলামবাদী বর্তমান তুরস্ক সরকার ইসলামপন্থী সিরীয় বিদ্রোহীদের সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। আর এর জের ধরে তুরস্ক সীমান্ত বরাবর দেশটি সিরিয়ার কুর্দিদের উপর আক্রমণ করে। কুর্দিরাও পাল্টা হামলা করে, যা চলছিল বেশ কয়েক বছর। বিশেষত নিজ দেশে কুর্দি বিদ্রোহের ভয় থেকে আঙ্কারা কুর্দিদের বিরুদ্ধে আক্রমণে সিরীয় বিদ্রোহীদের উত্সাহ ও সহায়তা দেয়। এমনকি কুর্দিবিরোধী সন্ত্রাসে আইসিসকে সাহায্যের অভিযোগ আছেও তুরস্কের বিরুদ্ধে। তুরস্ক অবশ্য অভিযোগ করেছে, ওয়াইপিডি নিষিদ্ধ ‘‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’’ (পিকেকে)-র অঙ্গসংগঠন মাত্র। তাই আইসিসের পতনের পর আইসিসবিরোধী পশ্চিমা জোট সিরিয়া থেকে সেনা প্রত্যাহারের সাথে সাথে তুর্কি সেনাবাহিনী রোজাভাসহ উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় একাধিক সেনা অভিযান শুরু করেছে, যা এখনো অব্যহত আছে।

তুরস্কে দক্ষিণ-পূর্ব অংশে অবস্থিত উত্তর কুর্দিস্তান বা তুর্কি কুর্দিস্তান কুর্দিস্তানের সবচেয়ে বড় ও জনবহুল অংশ। কিন্ত আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র জন্মের পর থেকেই কুর্দিরা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। এর ফলে শুরু থেকে একের পর এক বিদ্রোহ করে চলেছে তুরস্কের কুর্দিরা। মুস্তাফা কামালের জাতীয়তাবাদী আদর্শে সৃষ্ট তুর্কি রাষ্ট্রে তুর্কিরা কুর্দিসহ অন্যান্য জাতিসত্ত্বাকে সাংবিধানিকভাবে তুর্কি হিসেবে ঘোষণা করে। কুর্দিদের নাম দেওয়া হয় ‘পার্বত্য তুর্কি’। তাদের ভাষার আনুষ্ঠানিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এসব বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে কুর্দিরা, যার মধ্যে কোছগিরি, শেখ সাইদ, বেতুসেবাব, আরারাত ও দেরসিম বিদ্রোহ উল্লেখযোগ্য। শুধু সরকার নয়, উগ্র জাতীয়তাবাদী তুর্কি সংগঠন ‘গ্রে উলভস’-সহ অন্যান্য তুর্কি জাতীয়তাবাদী ও বিভিন্ন ইসলামবাদী সংগঠনও কুর্দিদের বিষনজরে দেখতে শুরু করে এবং সন্ত্রাসী হামলা চালিয়ে থাকে। এর ফলে কুর্দিদের মধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সশস্ত্র সংগঠনের উত্পত্তি হয়। তুরস্কের কুর্দিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন পিকেকে। তুরস্ক পিকেকে-কে তাদের দেশে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করেছে। তুরস্কের দাবি, পিকেকে ও অন্যান্য কুর্দি সংগঠনগুলো সন্ত্রাসবাদকে পুঁজি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটছে। অন্য দিকে পিকেকেসহ কুর্দি সংগঠনগুলো বলছে, তুরস্কে তারা এখনো জাতিগত বৈষম্য ও নির্যাগতনের শিকার হচ্ছে। নব্বইয়ের দশক থেকে কুর্দিরা প্রায়ই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে রাস্তায় নেমে আসছে। অন্য দিকে ১৯৭৮ সাল থেকে পিকেকে তুরস্ক ও তুরস্কের বাইরের বিভিন্ন স্বাধীনতাকামী কুর্দি সংগঠনের সাথে সম্মিলিতভাবে সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত। দফা দফায় অস্ত্রবিরতির পর ২০১৫ সালে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয় তুরস্ক ও পিকেকের মধ্যে।

ইরানের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কুর্দি অধ্যুষিত এলাকার অনানুষ্ঠানিক নাম পশ্চিম কুর্দিস্তান। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অংশ না হওয়া সত্ত্বেও এ অঞ্চলের কুর্দিরাও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে জাতীয়তাবাদে দীক্ষিত হয়। তুরস্কের মতো এখানেও একাধিক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। কুর্দিরা অবশ্য স্বাধীনতার চেয়ে স্বাধিকারের ব্যাপারেই বেশি সোচ্চার ছিল। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কুর্দিরা পাহ্লাভি রাজতন্ত্রের পার্সীয়কেন্দ্রিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে স্বায়ত্ত্বশাসনের পক্ষে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। এর নেতৃত্ব দেয় প্রধানত ‘‘ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব ইরানিয়ান কুর্দিস্তান’’ (কেডিপিআই)। পরে ১৯৭৯ সালে শিয়া ধর্মগুরু রুহুল্লাহ খোমেনি রাজতন্ত্র উচ্ছেদের মাধ্যমে ইসলামী শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন করলে কুর্দিরা আরো বেশি বিপদগ্রস্ত হয়। ইরানের কুর্দিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি হলেও কারো কারো মতে তাদের মধ্যে শিয়াদেরই সংখ্যাধিক্য। কিন্তু শিয়াবাদী ইসলামী প্রজাতন্ত্র সুন্নি বিশ্বাসের কারণে কুর্দিদের উপর নতুন করে অত্যাচার করা শুরু করে। ফরে ইরানের কুর্দি জনসাধারণ শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার সংগ্রাম বেছে নিতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতা ও স্বায়ত্ত্বশাসনের গণদাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে ইরানে। ইরানের বর্তমান সরকার কুর্দি বিক্ষোভকারীদের ও রাজনৈতিক কর্মীদের নিয়মিত মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে আসছে।

কুর্দিরা অবশ্য দীর্ঘ দিন ধরে পশ্চিমাদের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়ে আসছে। তবে কুর্দি জনসাধারণের অনেকে মনে করে, পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো শুধু তাদের ব্যবহার করছে, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে পশ্চিমাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই আজও কুর্দিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে সেই আপ্তবাক্য- পর্বত ছাড়া কুর্দিদের কোনো বন্ধু নেই।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us