মমতাই কি রুখে দিতে পারেন বিজেপিকে?
মমতা ও মোদি - ছবি সংগৃহীত
ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি বিহার জয়ের পর আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে পশ্চিম বাংলা দখলে বেপরোয়া প্রচারাভিযান শুরু করেছে। এটি নিয়ন্ত্রণে নেয়া শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাই নয় একই সাথে আঞ্চলিক সমীকরণেও বিশেষভাবে প্রয়োজন বলে মনে করছে বিজেপি-সংঘ পরিবার। এ লক্ষ্যে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয় ভার্জিয়াকে পশ্চিমবঙ্গ ইনচার্জ হিসেবে পুনরায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে, আরএসএসের প্রাক্তন প্রচারক অরবিন্দ মেনন এবং বিজেপির আইটি সেল প্রধান অমিত মালভিয়াকে সহ-দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়েছে। বিজেপি সভাপতি জে পি নদ্দা এবং দলের সিনিয়র কর্মকর্তারা গত সপ্তাহে রাজ্য সফর করেছেন। এখন থেকে শাহ এবং নদ্দা ঘন ঘন এই রাজ্যে আসবেন। জরিপ কৌশল অবলম্বন, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার চালানো, প্রার্থী চূড়ান্তকরণ এবং বুথ পরিচালনার কৌশল সমন্বয়ের জন্য একটি ‘নির্বাচনী যুদ্ধ কক্ষ’ স্থাপন করা হচ্ছে।
পূর্ব এবং উত্তর-পূর্বে এবং শেষ পর্যন্ত পুরো ভারতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিজেপির পরিকল্পনার জন্য বাংলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর সেই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক মমতা বন্দোপাধ্যায়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টর সমালোচক এই নেত্রী কেন্দ্রীয় সরকারের নীতিবিরোধী ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তিনি জিএসটি, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ) অথবা জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) এর তীব্র বিরোধিতা করেছেন। ফেডারেল ফ্রন্টের ভিত্তি স্থাপনের পরে ১৯৯৭ সালে তার দ্বিতীয়বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হয়ে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন পাঁচ জাতীয় নেতা ফারুক আবদুল্লাহ, অখিলেশ যাদব, নিতীশ কুমার, লালু প্রসাদ যাদব এবং অরবিন্দ কেজরিওয়াল। কিন্তু পরে উত্তরপ্রদেশে বিরোধী দলগুলো তাদের অবস্থান হারিয়ে ফেলে। নিতীশ এনডিএতে ফিরে যান এবং লালুকে কারাগারে পাঠানো হয়। কিন্তু মমতা আঘাত হানতে তার দ্বারপ্রান্তে আসা জাফরান মার্চ থামাতে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন। তিনি বাংলায় বিজেপিকে ‘বহিরাগত’ বলে আখ্যায়িত করতেও সফল হয়েছেন এবং মোদিকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘বাংলা কেবল শাসন করবে বাংলা, গুজরাট নয়’।
কেন প্রধান লক্ষ্য বাংলা?
দ্বিতীয়বার ফেডারেল সরকার গঠনের পর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সব রাজ্যে এককভাবে অথবা জোট গঠন করে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর মোদি-শাহ জুটির প্রধান লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে পশ্চিম বাংলা। বিশেষভাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, চীন, নেপালের সীমান্তবর্তী কোনো রাজ্য অবিজেপি শাসনে রাখতে চায় না সংঘ পরিবার। এই লক্ষ্য অর্জনে বিজেপি-আরএসএস নীতিপ্রণেতারা অনেক দূর এগিয়েছেন এর মধ্যে। ভারতের সবচেয়ে সংবেদনশীল রাজ্য কাশ্মিরে স্থানীয় দল মেহবুবা মুফতির পিডিএমর সাথে জোট সরকার গঠন রাজ্যটিকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে আনা ও স্বায়ত্তশাসন বাতিলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শুধু বৃহত্তম রাজ্য হিসেবেই নয় নেপালের সীমান্তবর্তী রাজ্য হিসেবেও উত্তর প্রদেশে ক্ষমতায় যাওয়াকে বিজেপি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছিল।
বাংলাদেশ-চীন সীমান্তবর্তী রাজ্য আসামে বিজেপির জন্য সরকার গঠন কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটি সংঘ পরিবারের প্রধান এজেন্ডা জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি গঠনে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অরুণাচলে বিজেপির শাসন চীনা প্রভাব ঠেকিয়ে রাখতে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে স্থানীয় দলগুলোর সহায়তায় সরকার গঠনও ছিল বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গুজরাট রাজস্থান পাঞ্জাব হারিয়ানার মতো রাজ্যগুলোও বিজেপির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে পাঞ্জাবে এক সময় জোট সরকার গঠন করে ক্ষমতায় গেলেও এখন বিজেপি ক্ষমতার বাইরে রয়েছে। একই অবস্থা মহারাষ্ট্র, রাজস্থানেও। তবে এসব রাজ্যকে বলা যায় বিজেপির হাতের মুঠোয়। এর বাইরে বিহার জয়ের জন্য নিতীশকে জোটে নিয়ে আসার পর বড় কোনো বাধা পেরোতে হয়নি। এবার পশ্চিম বাংলা নিয়ন্ত্রণে আনতে সেই একই সমীকরণ কাজে লাগাতে চাইছে বিজেপি।
২০১৬ সালের পূর্ববর্তী নির্বাচনে অল ইন্ডিয়া তৃণমূল কংগ্রেস (এআইটিসি) পশ্চিম বাংলার আইনসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রেখেছে। ২৯৪ নির্বাচিত আসনের মধ্যে দলটি ২২৪ আসন পায় তৃণমূল। ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) সে সময় ১৫টিতে জয়ী হয়। তবে ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয়লাভ করে। এ সময় তৃণমূল পায় ২২টি আসন।
পশ্চিম বাংলা জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজ্যই শুধু নয়, এটির অবস্থান ভারতের মূল ভূখ-ের সাথে উত্তর-পূর্ব ভারতের সংযোগ স্থানে। বাংলাদেশ ও ভুটানের সাথে রয়েছে এর সীমান্ত। অদূরেই অবস্থান চীন মিয়ানমার ও নেপালের। রাজ্য হিসেবে কাশ্মিরের পর জনসংখ্যা অনুপাতে আসাম ও পশ্চিমবাংলা হলো সর্বাধিক মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল।
প্রচারণার মূল ইস্যু এনআরসি
২০১৯ সালে বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশ থেকে হিন্দু অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এবং তাদের আবাসন সরবরাহের আশায় ভারতীয় সংসদে নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন, ২০১৯ (সিএএ) পাস করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত বিজেপির এক বাংলা পুস্তিকায় দাবি করা হয় যে, অনিবন্ধিত অভিবাসীদের শনাক্ত করার জন্য জাতীয় নাগরিক নিবন্ধনটি প্রয়োগ করা হবে, তবে কেবল হিন্দু, শিখ এবং অন্যান্য অমুসলিমরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের সুবিধা পাবে।
এনআরসির মাধ্যমে মুসলিম ভোটারদের নাগরিক তালিকা থেকে বের করে দেয়ার জন্য সংঘ পরিবারের যে মহাপরিকল্পনা রয়েছে তা বাস্তবায়নের জন্য এই রাজ্যটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিজেপির নীতি প্রণেতারা মনে করেন। পশ্চিমবঙ্গে ২৮ শতাংশের মতো মুসলিম ভোটার রয়েছে। বিজেপি চার স্তরে তাদের এনআরসি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চায়।
প্রথমত, বাঙালি মুসলিমদের প্রধানত সন্দেহভাজন বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করা। এর পরের স্তরে তাদের দেয়া আধার কার্ড ও অন্যান্য নাগরিক সুবিধাদি স্থগিত করা। তৃতীয় পর্যায়ে তাদের অনাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে স্থানান্তর ও তাদের স্থাবর ও আস্থাবর সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। চতুর্থ পর্যায়ে তাদের যে দেশের অধিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে সে দেশে ঠেলে দেয়া।
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ ২০১৬ সালের রাজ্য বিধান সভার নির্বাচনের পর থেকে এনআরসি নিয়ে প্রকাশ্য প্রচারণা চালিয়ে আসছেন। বিগত লোকসভা নির্বাচনেও বেশ জোরের সাথে মোদি-শাহ বলেছেন, বাংলায় নাগরিকত্ব আইন বাস্তবায়ন হবেই। এই আইনের মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত হওয়া অমুসলিমদের নাগরিকত্ব দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এর লক্ষ্য হলো মুসলিমদের ভোটারবিহীন করে ভারসাম্য নষ্ট করা। গত লোকসভা নির্বাচনের ভোট বিশ্লেষণে দেখা গেছে, হিন্দু ভোটারদের মধ্যে বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে বেশি সমর্থন পেয়েছে। আর মুসলিম ভোটগুলো অনেকটা একচেটিয়াভাবে তৃণমূলের ঘাষফুলের পক্ষে পড়েছে।
এনআরসি প্রক্রিয়ায় এক থেকে দেড় কোটি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করা হবে বলে বিজেপির ঘোষণায় বলা হয়েছে। এটি হলে স্বাভাবিকভাবে পশ্চিম বঙ্গের মুসলিম ভোটার ১৫ শতাংশের নীচে নেমে আসবে। আসামে অগপ ও ছাত্র পরিষদের আন্দোলনের কারণে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালিদের সন্দেহভাজন তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পরবর্তীতে হিন্দুদের নাগরিকত্ব আইনের আওতায় ভারতে আত্মীকরণ করার কথা বলা হচ্ছে। পশ্চিম বাংলায় টার্গেটই করা হবে মূলত মুসলিম বাসিন্দাদের। তৃণমূল সরকার এটি করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে যে কোনোভাবে বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠা মোদি সরকারের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছে।
রাজ্যটি দখলের জন্য তৃণমূলের জনপ্রিয় নেতাদের বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় জড়ানো, অর্থনৈতিক লাভ ও নতুন সরকারের পদ দেয়ার কথা বলে ভাগিয়ে নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি মুসলিম ভোটে বিভাজনের জন্য অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদ-উল-মুসালিমীনকে (এআইআইএমআইএম) পশ্চিম বাংলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ৮২ আসনে নির্বাচন করানোর জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। ভারতের তেলাঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদ কেন্দ্রিক এআইআইএমআইএম প্রধান আসাদুদ্দিন ওবাইস পশ্চিম বাংলায় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এটিও তৃণমূলের জন্য মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। বিহারে এ দলের প্রার্থীদের মধ্যে পাঁচজন এমপি হয়েছেন কিন্তু বিরোধী জোটের আসন কমিয়েছেন কমপক্ষে ২০টি। এর ফলে বিজেপি জোট আবার ক্ষমতায় যেতে সক্ষম হয়েছে। একই ফর্মুলা পশ্চিম বাংলায় প্রয়োগের চিন্তা হচ্ছে।
বিজেপি তার কৌশলের অংশ হিসেবে হিন্দু ধর্মীয় উৎসবগুলো বেশ জৌলুসের সাথে পালন করে হিন্দু স্বার্থ রক্ষাকারী একক দল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চাইছে। একই সাথে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়াতে চাইছে। তৃণমূলের সরকারকে সংখ্যালঘু তোষণের সরকার হিসেবেও প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এই প্রচারণা কৌশল কাজে লাগিয়ে আশা করছে ২০২১ সালে হিন্দুত্ববাদী দলটি পশ্চিম বাংলায় সরকার গঠনে সক্ষম হবে।
এর বিপরীতে তৃণমূলের আবার ক্ষমতায় আসার পথে কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, বাম ফ্রন্টের ভোট বলয় যাতে কোনোভাবেই বিজেপি জোটের দিকে না যায় তার জন্য প্রয়োজনবোধে কংগ্রেস ও বামফ্রন্ট মিলে যে মহাজোট রয়েছে সেটির সাথে আসন সমঝোতার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে। একই ধরনের সমঝোতা এআইআইএমআইএমের সাথে করার প্রয়োজন রয়েছে। এই পথে মমতা কতটা এগোতে পারেন সেটিই দেখার বিষয়।
রোড টু বেঙ্গল
২০১৯ সালে বিজেপি প্রথমবারের মতো বড় সাফল্য পায়। তারা বাংলার ৪২টি লোকসভা আসনের মধ্যে ১৮টিতে জয় এবং ৪১ শতাংশ ভোট পায়। তারা এখন স্লোগান বানিয়েছে ‘ঊনিশেই অর্ধেক, একুশে সাফ’। এর আগে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির ভোট ২০১১ সালের ৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১৬ সালে ১০.২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। কমপক্ষে ৫০টি আসনে বিজেপি ২০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে হারে। গত বছর ডিসেম্বরে এবং ২০২০ সালের আগস্টে অনুষ্ঠিত দু’টি স্বতন্ত্র জরিপের ভিত্তিতে আমিত শাহ বিজেপির জন্য এবার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২০০টি আসন জেতার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।
বিজেপিও আশা করছে যে, এআইআইএমআইএমের পশ্চিম বাংলার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সিদ্ধান্ত এক শ’র কাছাকাছি আসনে মুসলিম ভোটকে প্রভাবিত করতে পারে। বিহারের এআইআইএমআইএম পাঁচটি আসন জিতলেও, তারা বিহারে বিরোধীদের জন্য যে বিপদ তৈরি করেছে তা বাংলায়ও ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আর মুসলিম ভোটে যেকোনো বিভাজন কেবল বিজেপির পক্ষে কাজ করতে পারে।
বিজেপির ভারত ডকট্রিন
বিজেপির ভারত মতবাদের মূল কথাটি হলো ভারত হবে হিন্দুদের জন্য, হিন্দু নিয়ন্ত্রিত ভূখ-। আর হিন্দুত্ব মানে হলো একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় ও বন্ধন যার প্রকাশ রামরাজ্য স্থাপন প্রচেষ্টা, গোরক্ষা আন্দোলন ও বিভিন্ন পূজা পার্বনের মাধ্যমে হয়। এখানে অহিন্দুরা থাকবে হিন্দু আধিপত্য ও পরিচয় গ্রহণ করে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৎ এটি তার একাধিক বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন।
হিন্দু পুনর্জাগরণের এই মতবাদের সূতিকাগার ছিল মহারাষ্ট্র ও এর আশপাশের মারাঠা অঞ্চল। এই মারাঠারা একসময় বাংলায় বর্গী হিসেবে পরিচিত ছিল। মারাঠা দস্যুরা এই অঞ্চলে এসে লুটপাট করে সব কিছু নিয়ে যেত। এ জন্য এখানকার শিশুদের ঘুম পাড়ানোর এক জনপ্রিয় লোকছড়া ছিল- ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?/ ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি।’
এটা শুধু একটা ছড়া নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম বর্গীদের হাতে লুট হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আর এই বর্গীরা ছিল মারাঠি। মারাঠা হিন্দু পুনর্জাগরণের প্রাণপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শিবাজিকে। তার ধ্যান-ধারণা অবলম্বন করে এক সময় শিবসেনা ও আরএসএস গঠন ও বিস্তৃত হয়। ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন এই আন্দোলনেরই গোপন সদস্য আর বিজেপির প্রধান পূজনীয় রাজনীতিবিদ।
এখন বিজেপি ও সংঘ পরিবার পুরো ভারত প্রশাসনে এই হিন্দুত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টসমূহ, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখাকে লক্ষ্যস্থল করা হয়েছে।
বাবরী মসজিদকে ঘিরে যে রায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে এসেছে সেটিকে এই লক্ষ্য অর্জনে বড় বিজয় হিসেবে দেখা হয়। এই রায় প্রদানকারী বিচারপতি গগৈকে বিজেপি রাজ্যসভার সদস্য করে পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে দিল্লি হাইকোর্টে যে বিচারপতি দিল্লি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ জারি করেছিলেন তার ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে বিচারকদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে নিয়োগ পদোন্নতির ব্যাপারে সংঘ পরিবার একটি বড় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিজেপির গত দশকে যেসব নিয়োগ এসব প্রতিষ্ঠানে হয়েছে তাদের পটভূমি বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করে নেয়া হয়েছে। দেশে বিদেশে কার্যরত গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসীদের বাছাই করা হচ্ছে। হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগেও একই নীতি অনুসৃত হচ্ছে।
বিজেপির এই মেয়াদে এসে ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ পেশাগত বিষয়ের বাইরে এসে যেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন তেমন দৃষ্টান্ত আগে কখনো ছিল না। ভারত নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা বলয় ও রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বিজেপি লম্বা সময়ের জন্য ভারতের নিয়ন্ত্রণকারী একক রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
বিজেপির এই দর্শন দেশটির বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও কর্পোরেট হাউজগুলো গ্রহণ করে দলটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতিপক্ষ দলগুলো কোনোভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। এর সাথে আন্তর্জাতিক কিছু পুঁজিগোষ্ঠীর যোগসূত্র তৈরি হয়েছে কর্পোরেট স্বার্থকে কেন্দ্র করে। পশ্চিম বাংলায় যদি বিজেপি সরকার গঠনে সক্ষম হয় তবে পরবর্তী লোকসভা নিয়ন্ত্রণে বিরোধী পক্ষকে সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেয়ার মতো গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। মমতা ব্যানার্জি নিজেকে বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলায় বিজেপির আগ্রাসি প্রচারাভিযানের এটিও একটি মূল কারণ।
আর পশ্চিম বাংলায় বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠা হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও কম বেশি পড়বে। বিশেষত এনআরসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে ঢাকার জন্য। আর বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠা ধরনের কোনো এজেন্ডা সামনে চলে এলে বিপদ আরো ভয়াবহ হতে পারে।
mrkmmb@gmail.com