বিজেপির ভারত ডকট্রিন
বিজেপির ভারত ডকট্রিন - ছবি সংগৃহীত
বিজেপির ভারত মতবাদের মূল কথাটি হলো ভারত হবে হিন্দুদের জন্য, হিন্দু নিয়ন্ত্রিত ভূখ-। আর হিন্দুত্ব মানে হলো একটি সাংস্কৃতিক পরিচয় ও বন্ধন যার প্রকাশ রামরাজ্য স্থাপন প্রচেষ্টা, গোরক্ষা আন্দোলন ও বিভিন্ন পূজা পার্বনের মাধ্যমে হয়। এখানে অহিন্দুরা থাকবে হিন্দু আধিপত্য ও পরিচয় গ্রহণ করে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবৎ এটি তার একাধিক বক্তব্যে স্পষ্ট করেছেন।
হিন্দু পুনর্জাগরণের এই মতবাদের সূতিকাগার ছিল মহারাষ্ট্র ও এর আশপাশের মারাঠা অঞ্চল। এই মারাঠারা একসময় বাংলায় বর্গী হিসেবে পরিচিত ছিল। মারাঠা দস্যুরা এই অঞ্চলে এসে লুটপাট করে সব কিছু নিয়ে যেত। এ জন্য এখানকার শিশুদের ঘুম পাড়ানোর এক জনপ্রিয় লোকছড়া ছিল- ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে?/ ধান ফুরালো, পান ফুরালো, খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর করো, রসুন বুনেছি।’
এটা শুধু একটা ছড়া নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে বাংলার গ্রামের পর গ্রাম বর্গীদের হাতে লুট হয়ে যাওয়ার ইতিহাস। আর এই বর্গীরা ছিল মারাঠি। মারাঠা হিন্দু পুনর্জাগরণের প্রাণপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় শিবাজিকে। তার ধ্যান-ধারণা অবলম্বন করে এক সময় শিবসেনা ও আরএসএস গঠন ও বিস্তৃত হয়। ভারতের প্রথম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভ ভাই প্যাটেল ছিলেন এই আন্দোলনেরই গোপন সদস্য আর বিজেপির প্রধান পূজনীয় রাজনীতিবিদ।
এখন বিজেপি ও সংঘ পরিবার পুরো ভারত প্রশাসনে এই হিন্দুত্ববাদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে। এ ক্ষেত্রে প্রধানত ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টসমূহ, বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং সশস্ত্রবাহিনীর বিভিন্ন শাখাকে লক্ষ্যস্থল করা হয়েছে।
বাবরী মসজিদকে ঘিরে যে রায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে এসেছে সেটিকে এই লক্ষ্য অর্জনে বড় বিজয় হিসেবে দেখা হয়। এই রায় প্রদানকারী বিচারপতি গগৈকে বিজেপি রাজ্যসভার সদস্য করে পুরস্কৃত করেছে। অন্যদিকে দিল্লি হাইকোর্টে যে বিচারপতি দিল্লি দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ জারি করেছিলেন তার ব্যাপারে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণকে বিচারকদের প্রতি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।
সশস্ত্রবাহিনী, পুলিশ, বেসামরিক প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোতে নিয়োগ পদোন্নতির ব্যাপারে সংঘ পরিবার একটি বড় পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। বিজেপির গত দশকে যেসব নিয়োগ এসব প্রতিষ্ঠানে হয়েছে তাদের পটভূমি বিশেষভাবে যাচাই-বাছাই করে নেয়া হয়েছে। দেশে বিদেশে কার্যরত গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিনির্ধারণী গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসীদের বাছাই করা হচ্ছে। হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগেও একই নীতি অনুসৃত হচ্ছে।
বিজেপির এই মেয়াদে এসে ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ পেশাগত বিষয়ের বাইরে এসে যেভাবে রাজনৈতিক বক্তব্য দিচ্ছেন তেমন দৃষ্টান্ত আগে কখনো ছিল না। ভারত নিয়ন্ত্রণকারী ক্ষমতা বলয় ও রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজেপি ও সংঘ পরিবারের নীতি আদর্শ বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে বিজেপি লম্বা সময়ের জন্য ভারতের নিয়ন্ত্রণকারী একক রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে।
বিজেপির এই দর্শন দেশটির বড় বড় শিল্প গ্রুপ ও কর্পোরেট হাউজগুলো গ্রহণ করে দলটিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। ফলে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির প্রতিপক্ষ দলগুলো কোনোভাবে সংগঠিত হতে পারছে না। এর সাথে আন্তর্জাতিক কিছু পুঁজিগোষ্ঠীর যোগসূত্র তৈরি হয়েছে কর্পোরেট স্বার্থকে কেন্দ্র করে। পশ্চিম বাংলায় যদি বিজেপি সরকার গঠনে সক্ষম হয় তবে পরবর্তী লোকসভা নিয়ন্ত্রণে বিরোধী পক্ষকে সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেয়ার মতো গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। মমতা ব্যানার্জি নিজেকে বিজেপিবিরোধী রাজনৈতিক ঐক্যের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলায় বিজেপির আগ্রাসি প্রচারাভিযানের এটিও একটি মূল কারণ।
আর পশ্চিম বাংলায় বিজেপির শাসন প্রতিষ্ঠা হলে এর প্রভাব বাংলাদেশেও কম বেশি পড়বে। বিশেষত এনআরসি কার্যকর করার ক্ষেত্রে এটি বড় ধরনের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে ঢাকার জন্য। আর বঙ্গভূমি প্রতিষ্ঠা ধরনের কোনো এজেন্ডা সামনে চলে এলে বিপদ আরো ভয়াবহ হতে পারে।
mrkmmb@gmail.com