ইরানে আজারি : তুরস্কের চাল!

আবির রায়হান | Dec 15, 2020 03:33 pm
রজব তাইয়িপ এরদোগান

রজব তাইয়িপ এরদোগান - ছবি সংগৃহীত

 

মাসখানেক আগে গত ১০ নভেম্বর আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে যুদ্ধবিরোধী চুক্তি সম্পাদিত হয় রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে। চুক্তির ফলে আর্মেনিয়া শুধু বিবাদমান নাগোর্নো-কারাবাখ অর্থাৎ আজারবাইজান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া আর্তসাখ প্রজাতন্ত্রের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারল।

কিন্তু ২০২০ সালের যুদ্ধে যেসব এলাকা আজারবাইজানি সৈন্যরা দখল করেছে সেগুলোসহ ১৯৯৪ সালের যুদ্ধের সময় নাগোর্নো-কারাবাখের চারপাশের যে সব এলাকা আর্তসাখের আর্মেনীয়রা দখল করেছিল, ওই সব এলাকার পুরোটাই ফেরত পাবে আজারবাইজান। পাশাপাশি আজারবাইজানকে ইরানের সাথে সম্পূর্ণ সীমান্তের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ এবং আর্মেনিয়া-ইরান-তুরস্কের মাঝখানে থাকা নাকশিভান ছিটমহলে প্রবেশের জন্য আর্মেনিয়ার মধ্য দিয়ে একটি করিডোর দেয়া হয়েছে। নাকশিভান আজারবাইজানি অধ্যুষিত অঞ্চল এবং ১৯২৪ সালে থেকে স্বায়ত্ত্বশাসিত থাকার পর ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয় এবং ১৯৯১ সালে আজারবাইজানের একটি প্রদেশ হিসেবে যোগ দেয়।

আজারবাইজানের সাথে করা এই চুক্তির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে আর্মেনিয়ার বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। আর্মেনিয়ানরা একে অপমানজনক চুক্তি মনে করছে। অন্যদিকে চুক্তি হওয়ার ঠিক এক মাস পর আরমেনিয়া-আজারবাইজান সীমান্তে নতুন করে মৃদু সংঘাত শুরু হয়েছে।

আপাত দৃষ্টিতে এই যুদ্ধ ও সংঘাত সম্পূর্ণ দ্বিপক্ষীয় বা বড়জোর আঞ্চলিক। কিন্তু একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায় এর ঐতিহাসিক ও বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। আর এর প্রভাব শুধু এই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং আশপাশের দেশগুলোতেও তা ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এই যুদ্ধের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পড়েছে প্রতিবেশী দেশ ইরানে। আর তার পিছনে রয়েছে শতবর্ষ পুরনো রাজনৈতিক মতবাদ- বৈশ্বিক তুর্কীয়বাদ।

আজারবাইজানের প্রধান জাতিগোষ্ঠী আজারবাইজানি বা আজারিরা দক্ষিণের দেশ ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি। ইরানের সবচেয়ে উত্তরের চারটি প্রদেশ- পশ্চিম আজারবাইজান, পূর্ব আজারবাইজান, আর্দাবিল ও জানজান জাতিগতভাবে আজারবাইজানি সংখ্যাগরিষ্ঠ। শুধু তাই নয়, ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চল আসলে আজারিদের মাতৃভূমির অংশবিশেষ। ঐতিহাসিকভাবে আজারবাইজান অঞ্চলটি ইরানীয় সাংস্কৃতিক বলয়ের মধ্যে ছিল হাজার বছর ধরে। এমনকি বিশেষজ্ঞরা বলেন যে আজারি জাতি মূলত ককেশাসীয় কিছু গোত্র ও ইরানীয় কিছু গোত্রের সংমিশ্রণে তৈরী। তা পরে তুর্কীয় কিছু গোত্রের সাথে মিশ্রিত হয়ে বর্তমান আজারবাইজানি জাতিতে পরিণত হয়। অবশ্য এই তুর্কীয়করণ প্রক্রিয়ার পরও আজারবাইজান প্রধানত পারস্য বা ইরান শাসিত বিভিন্ন সম্রাজ্যের অন্তর্গত রয়ে যায়। অবশ্য এসব সম্রাজ্যের অনেকগুলোরই শাসনকর্তা ছিল বিভিন্ন তুর্কীয় রাজবংশ।

১৫ শতকে কুর্দি বংশোদ্ভূত সাফাভী রাজবংশের ক্ষমতা দখলের পর ইরান ও আজারবাইজানসহ সাফাভী সম্রাজ্যের অধীনে থাকা বেশির ভাগ এলাকা ও বাসিন্দারা প্রধানত শিয়া ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়। এ সময় শিয়া সাফাভীদের সাথে তুরস্কের সুন্নি ওসমানীয় রাজবংশের প্রচুর যুদ্ধবিগ্রহ হয়। আঠারো শতকের শুরুতে দক্ষিণ ককেশাস অঞ্চলে রুশ সম্রাজ্য আধিপত্য বিস্তারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে তুরস্ক ও ইরান দুই দেশের সাথেই তাদের ভীষণ যুদ্ধ শুরু হয়, যা দশকের পর দশক ধরে চলেছিল। ১৮২৮ সালে রুশ-পারস্য যুদ্ধের পর তুর্কমেনচায়ের সন্ধির মধ্য দিয়ে আজারবাইজানিদের মাতৃভূমি আজারবাইজান অঞ্চলটি উত্তর আজারবাইজান বা বর্তমান আজারবাইজান রাষ্ট্র ও দক্ষিণ আজারবাইজান বা ইরানীয় আজারবাইজান- এই দুই অংশে বিভক্ত হয়। অন্য দিকে তুর্কীয়করণের পর থেকে আজারিরা বৃহত্তর তুর্কীয় জাতিগোষ্ঠীর একটি অংশে পরিণত হয়, যার মধ্যে রয়েছে কিরঘিজ, তুর্কমেন, কাজাখ, উজবেকসহ আরো অনেক জাতি, সর্বোপরি তুরস্কের তুর্কি জাতিও।

ঊনিশ শতকের শেষের দিকে ইউরোপে জাতীয়বাদের প্রবল ঢেউ উঠলে মধ্যপ্রাচ্যের জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও তার ব্যপক প্রভাব পড়ে। উসমানীয় সাম্রাজ্যের ক্ষয়িষ্ণুতার মুখে তুরস্কের বুদ্ধিজীবি ও সামরিক সমাজে তীব্র জাতীয় চেতনার অভ্যুদয় ঘটে, যার ফলাফল হয় তরুণ তুর্কি সংগঠনের জন্ম ও তাদের বিপ্লবের মুখে রাজতন্ত্রের পতন। এ সময় তরুণ তুর্কি নেতারা ও অন্য অনেক তুর্কি জাতীয়তাবাদী শুধু তুর্কি জাতির ঐক্যের কথাই বলেননি, তারা সমগ্র তুর্কীয় ভাষাভাষীদের একত্রিত করার কথা ভাবেন। নিকটতম তুর্কীয় জাতি আজারিদের মধ্যেও এই মতবাদের তীব্র আবেগ অনুরণিত হয়। বিশেষত তারা ছিল রুশ ও পারস্য সাম্রাজ্যের হাতে পরাধীন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তুর্কি বাহিনী উত্তর আজারবাইজানিদের রাজধানী বাকুতে উপস্থিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বলশেভিকরা রুশ সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠা করলে আজারিদের স্বাধীনতা ও অন্য তুর্কীয় ভাইদের সাথে ঐক্যের বন্ধন গড়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থাকে ।

অন্য দিকে রুশ সাম্রাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও যুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে একাধিকবার ইরানীয় আজারবাইজানসহ ইরানের উত্তরভাগ দখল করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সোভিয়েতরা স্বল্প সময়ের জন্য ‘‘আজারবাইজান পিপল্স গভার্নমেন্ট’’ নামের একটি সমাজতন্ত্রী পুতুল সরকারেরও প্রবর্তন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কও দু'বার দক্ষিণ আজারবাইজান দখল করে। তবে আজারীদের দেশ এক করার এই সব প্রচেষ্টার কোনটিই ফলপ্রসু হয়নি।

একই সময়ে ইরানেও বুদ্ধিজীবি মহলে জাতীয়তাবাদের প্রসার ঘটে। কিন্তু ইরানি আজারবাইজান ও ইরানের অন্যান্য অঞ্চলে অভিবাসী আজারী বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে ইরানীয় জাতীয়তাবাদের প্রতি বেশি অনুরাগ দেখা যায়। তাদের এই জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা আধুনিক ইরান রাষ্ট্রগঠনে ব্যপক ভূমিকা রাখে। কিন্তু পাহলভি রাজবংশ ক্ষমতায় বসলে ইরানজুড়ে আধুনিকীকরণের পাশাপাশি ইরানীয় জাতীয়তাবাদকে পার্সীয় জাতীয়তাবাদে পরিণত করা হয়। ফলে আজারিসহ অন্যান্য অপার্সীয় জাতিগোষ্ঠীর ভাষাসহ অন্যান্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পাহলভি রাজবংশ কঠোর হাতে দমন করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ইরান রাষ্ট্রের এই জাতিবিদ্বেষী দমননীতির জনক ও সমর্থকদের তালিকায় বেশ কিছু আজারি বুদ্ধিজীবির নাম রয়েছে সবার আগে।

তবে আজারিবিরোধিতা মারাত্মক পৌঁছায় ১৯৭৯ ইরানীয় বিপ্লবের পর। শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত ও পার্সীয় বংশোদ্ভূত খোমেনি ক্ষমতায় আসার পর শিয়াপন্থী ইসলামী রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়, যা পরিচালিত হয় মূলত শিয়া ধর্মগুরুদের দ্বারা। সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্সীয় সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত শিয়া ধর্মাবলম্বী হওয়া ইসলামি প্রজাতন্ত্রের আমলে ইরানজুড়ে শিয়া সম্প্রদায় ও পার্সীয় জাতির আধিপত্য পুনর্প্রতিষ্ঠিত হয়। আজারিরাও প্রধানত শিয়া ইসলামে বিশ্বাসী, কিন্তু জাতিগত কারণে তারা আবারো বৈষম্যের শিকার হতে থাকে।

ইরানের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতির লোক আজারিরা অনেক হিসেবে জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ। একই সাথে দক্ষিণ আজারবাইজানের জনসংখ্যা আজারবাইজান রাষ্ট্রের প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু পার্সীয় সংস্কৃতিতে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার ফলে অপার্সীয় জাতিগোষ্ঠীর আত্মপরিচয় রাষ্ট্রীয় পর্যারয়ে প্রায় সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। সুন্নিসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের জন্য রাষ্ট্রীয় দমন-নিপীড়ন সম্পূর্ন ভিন্ন মাত্রার। আজারিরা এই ধর্মীয় বৈষম্য থেকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরিত্রাণ পেলেও জাতিগত নির্যাতন থেকে তাদের মুক্তি মেলেনি।

ইরানজুড়ে পার্সীয় ভাষা বাধ্যতামূলক করায় আজারী শিশুদের অন্য সংখ্যালঘু শিশুদের মতোই নিজ ভাষায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। আজারিদের অভিযোগ, দেশটির প্রচার মাধ্যমে আজারি জাতির বিরুদ্ধে বর্ণবাদী জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য, রসিকতা, কটূক্তি, ব্যঙ্গবিদ্রুপ করা এক নিয়মিত ঘটনা। ২০০৬ সালে একটি কার্টুনে আজারিদের ‘তেলাপোকা’-র সাথে তুলনা করা হয়, এমন অভিযোগে জন্য ইরানীয় আজারবাইজানে তীব্র বিক্ষোভ হয়েছিল। এতে আনুষ্ঠানিক হিসাব অনুযায়ী চারজন নিহত ও ৩৩০ জন গ্রেফকার হলেও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলে এর কয়েক গুণ বেশি লোক নিহত এবং হাজার না হলেও অন্তত কয়েক শ গ্রেফতার হয়েছিল। ২০১৫ সালে এক শিশুতোষ টিভি অনুষ্ঠানে আজারীদের ‘নোংরা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয় বলে অভিযোগ তোলা হয়। এ সময় তুরস্কে ইরান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে আজেরিরা।

পাশাপাশি আজেরিরা সরকারি পর্যায়ে বৈষম্য ও অবহেলার শিকার হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে। ২০১১ সালে পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের উরমিয়া হ্রদ শুকিয়ে নিঃশেষ হওয়ার পর্যাায়ে পৌঁছলে আজারি কৃষকরা তীব্র সঙ্কটে পড়ে। কিন্তু ইরান সরকার তাদের কোনো সাহায্য করেনি বলে জানা গেছে। ফলে আজারিরা রাষ্ট্রবিরোধী প্রতিবাদ সমাবেশ করেছিল। ২০১২ সালে পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে ভয়াবহ ভূমিকম্পে ৩০৬ জন নিহত হয় এবং ৩০৩৭ জন আহত হয়। কিন্তু অভিযোগ ওঠে, তেহরান উদ্ধারকাজ দ্রুত বন্ধ করে দেয়, ত্রাণের ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত থাকে, প্রচার মাধ্যমে এই বিপর্যয়কে অগ্রাহ্য করা হয়, এমনকি প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করা থেকেও বিরত থাকা হয়। ফলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ধারাবাহিকতায় স্থানীয় এক ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের ইরানবিরোধী স্লোগান দিতেও দেখা যায়।

ইরানের এইসব ঘরোয়া সমস্যার সাথে আন্তর্জাতিক সম্পৃক্ততা দেশটির জন্য নতুন মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। ইরান বহু দিন যাবতই অভিযোগ করছে, মানবাধিকার রক্ষার নামে তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে পশ্চিমা বিশ্ব। ইসলামী রাষ্ট্রটির অভিযোগ, দেশটির অভ্যন্তরে নানা জাতিগত, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে রাষ্ট্রবিরোধী সন্ত্রাসবাদী পশ্চিমা সন্ত্রাসবাদীরা গোপনে মদদ দিচ্ছে, ইন্ধন জোগাচ্ছে। আজারি জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকেও এ সমস্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কাতারে ফেলেছে তেহরান।

তবে শুধু পশ্চিমারা নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য শক্তির প্রতিও অভিযোগের আঙুল তুলেছে ইসলামি সরকার। আশির দশকে ইরানের সাথে যুদ্ধের সময় সাদ্দামের ইরাক পশ্চিম ইরানের খুজেস্তান প্রদেশের আহওয়াজি আরবদের অত্যাচারের হাত থেকে রক্ষা পেতে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রকাশ্যে সহায়তা করেছিল। বর্তমানে সৌদি আরবের প্রতি ইরানের অভিযোগ, ইরানের সংখ্যালঘু সুন্নি সম্প্রদায়কে আইসিস-আল-কায়েদার নেতৃত্বে শিয়াবিরোধী জিহাদে অনুপ্রাণিত করায় হাত আছে দেশটির।

তবে ইরানের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে আজারি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি তুরস্কের প্রকাশ্যে সমর্থন। ২০১০ সালের আরব বসন্তের পর থেকেই ইরান শুধু সৌদি আরব নয়, তুরস্কের সাথেও ছায়াযুদ্ধে লিপ্ত। ১৯৭৯ সালের পর থেকে ইরান ও তুরস্ক নিজেদের মধ্যে প্রকাশ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখলেও মার্কিনপন্থী তুরস্ক মার্কিনবিরোধী ইরানকে ভালো চোখে দেখছিল না বলেই প্রতীয়মান হয়। আঞ্চলিকভাবে ক্ষমতাশালী হওয়ার পথে ইরান সৌদিদের মতো না হলেও তুর্কিদের প্রভাব-প্রতিপত্তিকেও অগ্রাহ্য ও খর্ব করেছে নানাভাবে। ২০০২ সালে ইসলামপন্থী একেপি ও এরদোগান ক্ষমতায় আসার পর তুরস্কে মার্কিন প্রভাব ক্ষুণ্ন হলেও ইরানের সাথে দেশটির সম্পর্ক নতুন জটিলতায় মোড় নেয়। মিসরে জন্ম নেয়া আন্তর্জাতিক ইসলামবাদী সংগঠন মুসলিম ব্রাদারহুডের অংশ হলো তুরস্কের ক্ষমতাসীন ‘‘জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’’। একসময় সৌদি সাহায্যপুষ্ট এই রাজনৈতিক সংগঠনটি এখন সৌদি আরবের প্রধান শত্রু। মিসরে তাদের নির্বাচিত নেতা মোহাম্মদ মুরসির পতনে সহায়তা করে সৌদিরা জানান দিয়েছে যে, তাদের বাদ দিয়ে মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে যাওয়ার অবাস্তব কল্পনা যেন কেউ না দেখে। কিন্তু তুরস্কের রজব তাইয়িপ এরদোগানও ঠিক ওই কাজটিই করতে চান। অর্থাৎ তুরস্ক এখন আর সৌদিদের মিত্র নেই, পরিণত হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বীতে। তুরস্ক এর ফলে ইরানের দিকে কিছুটা সরে এলেও তা শুধু সৌদিবিরোধী কৌশলগত মিত্রতা মাত্র।

সিরীয় গৃহযুদ্ধ শুরুর তার চূড়ান্ত প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইরান যেমন আল-আসাদকে সমর্থনের মধ্য দিয়ে মূলত শিয়া বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে পুনর্প্রমাণ করেছে, তুরস্কও তেমনি আসাদ-বিরোধী ইসলামী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে সুন্নি তথা মুসলিম বিশ্বকে নিজের পিছনে দাঁড় করাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ফলে ইরান-তুরস্ক সংঘাত অনিবার্যপই ছিল।

আর এখানেই দক্ষিণ আজারবাইজানের আজারবাইজানিদের ক্ষমতার ঘুঁটিতে পরিণত করার বিষয়টি চলে আসে। শুধু বৈশ্বিক ইসলামবাদ নয়, বৈশ্বিক তুর্কীয়বাদের দিক থেকেও এরদোগান যথেষ্ট সক্রিয়। তিনি যা করছেন তাকে বলা হচ্ছে নব্য উসমানীয়বাদ, অর্থাৎ বিলুপ্ত উসমানীয় সম্রাজ্যের পুনরুজ্জীবন। এর অর্থ শুধু তুর্কীয় বিশ্বই নয়, সাবেক উসমানীয় সম্রাজ্যের অন্তর্গত অন্যান্য অঞ্চলেও প্রভাব বিস্তারে সক্রিয় থাকবে তুরস্ক। অন্যদিকে ইরান নিজেও চায় তার অতীত গৌরব ফিরে পেতে। সাফাভিসহ অন্যান্য ইরানভিত্তিক সম্রাজ্যের উদাহরণ আছে তাদের সামনে। ফলে শিয়া সাফাভি ও সুন্নি উসমানীয়দের শত শত বছরব্যাপী সংঘর্ষের পুনর্বৃত্তি হওয়ার পথে এই দুই দেশ। আর সংখ্যালঘু আজারিরা হতে চলেছে দাবার ঘুঁটি।

মজার ব্যপার হলো, তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতি কুর্দিরাও জাতিসূত্রে ইরানীয় এবং দশকের পর দশকজুড়ে আজারীদের চেয়েও অনেক বেশি নির্যাতিত, নিপীড়িত, নিগৃহীত, নিষ্পেষিত। কিন্তু প্রধানত সুন্নি হওয়ায় ইরানের বর্তমান সরকার তাদের প্রতি মোটেও সদয় নয়। পাশাপাশি ইরানেও অনেক কুর্দির বসবাস এবং সে দেশেও তারা আজারিদের মতোই অত্যাচারিত। তুরস্কের মতো ইরানেও তাই কুর্দিরা সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত। এসব কারণেই তুরস্কের কুর্দিরা স্বজাতিভুক্ত ইরানের পার্সীয় শাসকদের কাছ থেকে কোনো সহায়তা প্রত্যাশা করে না। তবু সম্প্রতি তুরস্ককে প্রতিহত করতে ইরান তুরস্কে কুর্দিদের সর্ববৃহৎ সংগঠন ‘‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’’(পিকেকে)-র সাথে উষ্ণ সম্পর্ক স্থাপনের কিছুটা হলেও চেষ্টা করছে। অন্য দিকে পিকেকে-কে নিজ রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি বলে মনে করে তুরস্ক।

অন্যদিকে তুরস্কও বসে নেই। ‘‘সাউথ আজারবাইজান ন্যাশনাল অ্যাওয়েকেনিং মুভমেন্ট’’ (সানাম)-সহ ইরানীয় আজারবাইজানের একাধিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনতাকামী বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে এই মুহূর্তে সমর্থন দিয়ে চলেছে তারা। এর পাল্টা জবাব হিসেবে ইরান সমর্থণ দিচ্ছে আরমেনিয়াকে, যার শুরু নব্বই দশকের শুরুতে নাগোর্নো-কারাবাখ সঙ্কটের শুরু থেকেই। এতে দক্ষিণ আজারিদের মধ্যে আজারবাইজানি জাতীয়তাবাদ ও তুর্কীয় জাতীয়তাবাদের প্রচার ও প্রসার ঘটছে এবং তারা আজারবাইজান ও তুরস্কের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে আরো বেশি। সাম্প্রতিক নাগোর্নো-কারাবাখ যুদ্ধের সময় আজারবাইজানের পক্ষে ও আরমেনিয়ার বিপক্ষে ইরানীয় আজারবাইজানিদের ব্যাপক বিক্ষোভ-প্রতিবাদ এবং তুরস্কপন্থী ও ইরানবিরোধী স্লোগান থেকে এমনটাই প্রমাণ পাওয়া যায়। ইরান বেশ সফলভাবেই সবধরনের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমন করেছিল। কিন্তু তুরস্কের সমর্থনে আজারি বিচ্ছিন্নতাবাদের পুনর্জন্ম হলে তা ইরানের অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতার প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা ইসলামি প্রজাতন্ত্রের হর্তাকর্তাদের।

তুরস্ক-ইরানের এই শীতল যুদ্ধের মধ্যে বৈশ্বিক তুর্কীয়বাদ কতখানি সফল হয় এবং ইরানের আজারবাইজানিদের ভাগ্যের কতখানি উন্নতি হয় এখন তাই দেখার বিষয়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us