মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ : তিন নেতার ঠাণ্ডা লড়াই
১৯৭১ সালে রাশিয়ার নেতা ব্রেজনেভ, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন - ছবি সংগৃহীত
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর। নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে তখন এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক চলছিল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে। যুদ্ধ থামানোর জন্য তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনে পোল্যান্ডের এক প্রস্তাব নিয়ে তখন আলোচনা বেশ উত্তেজনাপূর্ণ।
নিরাপত্তা পরিষদে ওই আলোচনায় পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো। তিনি এর এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে দেশটির রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পান। বক্তব্যের একপর্যায়ে ভুট্টো পোল্যান্ডের প্রস্তাব সম্বলিত কাগজ ছিড়ে টুকরো-টুকরো করে নিরাপত্তা পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন।
কিন্তু ভুট্টো যখন নিরাপত্তা পরিষদে তার এই তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ততক্ষণে পূর্ব-পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে।
ঠাণ্ডা লড়াই
বাংলাদেশের মানুষ যখন পাকিস্তানের কাছ থেকে মুক্তির জন্য জীবনপণ লড়ছে, তখনকার পৃথিবী ছিল একেবারে ভিন্ন। দুটি ভিন্ন মেরুতে নিজেদেরকে আবদ্ধ রেখেছিল বেশিরভাগ দেশ।
আর বৃহৎ শক্তির দেশগুলো পরস্পরের সাথে ঠাণ্ডা লড়াইয়ে যুক্ত হয়েছিলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, অন্যদিকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (যার সবচেয়ে প্রভাবশালী অংশ ছিল আজকের রাশিয়া) এবং ভারত ছিল বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পক্ষে।
ডিসেম্বর মাসের তিন তারিখে ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার পর থেকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ এবং সাধারণ পরিষদে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘের বাইরে আমেরিকা, চীন, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ভারতের মধ্যে তীব্র কূটনৈতিক বাদানুবাদও শুরু হয়েছিল।
পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে গিয়েছিল যে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার সোভিয়েত ইউনিয়নের ওপর তীব্র চাপ তৈরি করেছিলেন।
আমেরিকার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে ভারতকে থামানো ও পাকিস্তানকে ভাঙ্গনের হাত থেকে রক্ষা করা।
ভারতের ওপর এক ধরণের সামরিক হুমকি তৈরি করতে বঙ্গোপসাগরে রণতরীও পাঠিয়েছিল আমেরিকা।
ভারতের উপর আমেরিকার চাপ
ছয়ই ডিসেম্বর বাংলাদেশকে একটি স্বাধীনত দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ভারত। হেনরি কিসিঞ্জার লিখেছেন, ইন্দিরা গান্ধীর দেয়া সেই স্বীকৃতির ফলে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার সব সম্ভাবনা কার্যত শেষ হয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভারতকে দেয়া সব ধরণের অর্থনৈতিক সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়। তবে ভারতের উপর এর প্রভাব পড়েনি বলেই চলে।
আমেরিকার এই সিদ্ধান্তে ওয়াশিংটনে কূটনীতিকরা কিছুটা বিস্মিত হন।
নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে তখন বলা হয়েছিল, অনেকে ভেবেছিলেন ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় আমেরিকা যে 'নিরপেক্ষ ভূমিকা' পালন করেছিল, এবারও হয়তো দেশটি তেমন ভূমিকাই নেবে।
এছাড়া, ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা তাদের সম্পাদকীয়তে ভারতের ব্যাপারে আমেরিকার সিদ্ধান্তকে 'হাস্যকর' হিসেব বর্ণনা করেছিল।
ভারত যাতে পূর্ব পাকিস্তানে হামলা বন্ধ করে সেই লক্ষে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন ৬ই ডিসেম্বর সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভকে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। কারণ, মস্কো চেয়েছিল ভারত যুদ্ধ যাক।
জাতিসঙ্ঘে আলোচনা
জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান ইস্যুটি নিয়ে আলোচনার জন্য জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে পাঠিয়ে দেয়।
এর আগে পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতি সংক্রান্ত প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে বারবার নাকচ করে দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন।
কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে সাধারণ পরিষদের কোনো ক্ষমতা নেই। কোন একটি প্রস্তাবের ওপর সাধারণ পরিষদ শুধুই বিতর্ক এবং ভোটাভুটি করতে পারে। কিন্তু সেটি মেনে চলার কোনো বাধ্যবাধকতা কারো নেই।
এমন অবস্থায় পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়তেই থাকে। ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমেরিকাকে জানিয়েছিলেন যে পূর্ব-পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
আটই ডিসেম্বর জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের উপর ভোটাভুটি হয়। কিন্তু ভারত এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে যুদ্ধ বিরতির কোন প্রস্তাব তারা মানবে না।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতি এবং ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছিল, তাতে সমর্থন দিয়েছিল আমেরিকা।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে, এই প্রস্তাবের পক্ষে ১০৪টি ভোট পড়েছিল এবং বিপক্ষে ছিল ১১টি ভোট।
এই ভোটাভুটির পরদিন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত ভারতীয় প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য নরেন্দ্র সিংকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছিল, "আমরা যুদ্ধবিরতি করবো না। অবশ্যই না। আমরা বোকা নই।"
পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে কিসিঞ্জারের উদ্বেগ
আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার 'হোয়াইট হাউস ইয়ারস' বইয়ে লিখেছেন, পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের আনা কোন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মানবেন না ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
নিক্সনের বর্ণনা অনুযায়ী, শুধু পূর্ব পাকিস্তান নয়, বরং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আজাদ কাশ্মিরকে পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনাও নিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
১৯৭১ সালে জাতিসঙ্ঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ, যিনি ১৯৮৯ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনের নির্দেশে বুশ জাতিসঙ্ঘে ভারতকে 'হামলাকারী' হিসেবে বর্ণনা করেন।
ভারতকে থামানোর জন্য আমেরিকার হাতে একমাত্র উপায় ছিল, সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর চাপ তৈরি করা।
সেজন্য ৮ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে বলেছিলেন, মস্কোতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে শীর্ষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে, সেটি বাতিল করা উচিত। তাহলে হয়তো রাশিয়া চাপে পড়বে।
তখন আমেরিকার মনে যে জোরালো উদ্বেগটি তৈরি হয়েছিল সেটি হচ্ছে, ভারত হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানও আক্রমণ করতে পারে।
এমন প্রেক্ষাপটে আমেরিকার জুনিয়র এক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বৈঠক করেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে। ওই বৈঠকে আমেরিকার তরফ থেকে ভারতের কাছে এই নিশ্চয়তা চাওয়া হয় যে ভারত আজাদ কাশ্মীর এবং পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে না।
বৈঠকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের তরফ থেকে আমেরিকাকে এই নিশ্চয়তা দেয়া হয় যে ভারতে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে না। কিন্তু আজাদ কাশ্মীর সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা দেয়া হয়নি। ভারতের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছিলেন, বিষয়টি নিয়ে দিল্লির সঙ্গে কথা বলতে হবে।
হেনরি কিসিঞ্জারের ভাষ্যমতে, একই সাথে পূর্ব পাকিস্তান এবং কাশ্মির হারালে পাকিস্তান রাষ্ট্র হিসেবে টিকবে না।
আজাদ কাশ্মীর সম্পর্কে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে কোন নিশ্চয়তা না পেয়ে বেশ বিচলিত হয়ে উঠেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার।
রাশিয়ার উপর আমেরিকার চাপ
নয়ই ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের কৃষিমন্ত্রী ভ্লাদিমির মাৎকেভিচ ওয়াশিংটন সফরে যান। ওভাল অফিসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে বৈঠক করেন তিনি।
ওই বৈঠকে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বেশ খোলামেলাভাবে বলেন যে উপমহাদেশে যুদ্ধের কারণে আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
"ভারত যদি পশ্চিম পাকিস্তানের দিকে অগ্রসর হয়, তাহলে আমেরিকা বসে থাকবে না। সেজন্য অতিদ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি এবং একই সাথে এর রাজনৈতিক সমাধান জরুরী," সোভিয়েত মন্ত্রীকে জানান প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন যেভাবে ভারত-বিরোধিতা করছিলেন, তা নিয়ে হোয়াইট হাউস এবং পররাষ্ট্র দপ্তর স্টেট ডিপার্টমেন্ট-এর মধ্যে টানাপোড়েনও শুরু হয়।
এদিকে, আমেরিকার ক্রমাগত চাপের কারণে এক পর্যায়ে সোভিয়েত নেতা লিওনিদ ব্রেজনেভ একটি প্রস্তাব দেন আমেরিকার কাছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের বর্ণনা মতে, ব্রেজনেভ যে পরামর্শ দিয়েছিলেন তার অন্যতম বিষয় ছিল, ২৫শে মার্চের আগে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে যে পর্যায় থেকে আলোচনা ভেঙ্গে দিয়েছিল, সেখান থেকেই পুনরায় আলোচনা শুরু করা।
ব্রেজনেভের পরামর্শের ভিত্তিতে ১০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা করে আমেরিকা। এর ভিত্তিতে নতুন একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়।
তবে এই প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি বাদ দেয়া হয়। পাকিস্তান এবং আমেরিকা চেয়েছিল আপাতত যুদ্ধ বন্ধ করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার ১০ ডিসেম্বর সকালে এই প্রস্তাব পাঠিয়ে দেন সোভিয়েত দূতের কাছে। কিন্তু এরপর ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
চীনের সাথে আমেরিকার গোপন আলাপ
এরই মধ্যে মার্কিন রণতরীর একটি বহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে রওনা হবার জন্য নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানে যাতে কোন আক্রমণ না হয়, সেজন্য সতর্কবার্তা হিসেবে এই রণতরী পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এই বহরটি তখন মালাক্কা প্রণালীর পূর্ব দিকে অবস্থান করছিল।
নিক্সন প্রশাসনের মধ্যে তখন এই ধারনা হয়েছিল যে পূর্ব পাকিস্তানে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানকে বাঁচাতে হবে।
এই অবস্থায় জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত চীনের দূতের সাথে আলাপ করার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার গোপন একটি বৈঠকের জন্য ওয়াশিংটন ছেড়ে নিউইয়র্কে যান।
কিন্তু এরই মধ্যে তিনি খবর পান যে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কমান্ডার জেনারেল এ কে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করতে চান। এই খবরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের মন খারাপ হলেও মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর ছিল বেশ খুশি।
হেনরি কিসিঞ্জারের নাখোশ হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম সীমান্তে একটি সামগ্রিক যুদ্ধবিরতির জন্য ইয়াহিয়া খানের সাথে আলাপ করে এরই মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
তাদের ধারণা ছিল, শুধু পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বিরতি হলে ভারতীয় সেনাবাহিনী হয়তো পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ করতে পারে।
১০ ডিসেম্বর সন্ধ্যে ছয়টা নাগাদ নিউইয়র্কে সিআইএ'র একটি অফিসে বৈঠক করেন হেনরি কিসিঞ্জার এবং জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত চীনের দূত হুয়াং হুয়া।
ওই বৈঠকে চীনের রাষ্ট্রদূত এবং আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত পোষণ করেন যে পশ্চিম পাকিস্তান যদি আক্রান্ত হয় এবং পাকিস্তান যদি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে যায়, তাহলে দুই দেশ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক শক্তি প্রয়োগ করবে।
পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম সীমান্তে একটি সমন্বিত যুদ্ধবিরতি কার্যকর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আবারও চাপ প্রয়োগ করে আমেরিকা।
সোভিয়েত দূতকে ফোন করে হেনরি কিসিঞ্জার এই বলে সতর্ক করে দেন যে তাদের প্রস্তাবের ব্যাপারে যদি দ্রুত কোনো জবাব না আসে, তাহলে আমেরিকা কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
বঙ্গোপসাগরে রণতরী পাঠানোর সিদ্ধান্ত ছিল সেটির মধ্যে অন্যতম।
নিক্সন ও কিসিঞ্জারের জোর চেষ্টা
ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে নিউইয়র্কে পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে এক বৈঠক করেন হেনরি কিসিঞ্জার। ওই বৈঠকে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে কিসিঞ্জার বলেন যে আমেরিকা পাকিস্তানকে রক্ষা করতে চায়।
এজন্য চীনের সাথে একত্রিত হয়ে একটি কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার জন্য ভুট্টোকে পরামর্শ দেন কিসিঞ্জার।
এরপর জাতিসঙ্ঘে প্রস্তাব পাশ করার ক্ষেত্রে সহায়তা করবে যুক্তরাষ্ট্র ও এজন্য আগামী ৪৮ ঘণ্টা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন কিসিঞ্জার।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারের চিন্তা চলছিল মূলত পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাকিস্তান-শাসিত কাশ্মীরকে নিয়ে।
এই অবস্থায় ১২ ডিসেম্বর সকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার এবং হোয়াইট হাউজ চিফ অব স্টাফ - এ তিনজন মিলে ওভাল অফিসে এক বৈঠকে বসেন।
তাদের বৈঠক চলার সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের দূত ফোন করে বলেন, যুদ্ধবিরতি সম্পর্কে এর আগে আমেরিকা যে প্রস্তাব দিয়েছিল, সে ব্যাপারে রাশিয়ার উত্তর আসছে।
আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করার পর প্রেসিডেন্ট নিক্সন হটলাইনে একটি বার্তা পাঠান সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে।
ওই বার্তায় বলা হয়, ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সোভিয়েতের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় ভারত-পাকিস্তান ইস্যুকে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে যাবে আমেরিকা। সেখানে একবার সিদ্ধান্ত হলে সেটি পরিবর্তন করা যাবে না।
এর মধ্যে রণতরীকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করার জন্য নির্দেশ দেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। হেনরি কিসিঞ্জার আবার সোভিয়েত দূতকে হটলাইন মেসেজ পাঠানোর বিষয়টি জানিয়ে বলেন, "সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে।"
১২ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটার দিকে হটলাইনে সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তর আসে আমেরিকার কাছে। ওই বার্তায় বলা হয়, ভারত পশ্চিম পাকিস্তান আক্রমণ করবে কিনা, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
এ বিষয়টি নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েকবার ভারতের কাছে জানতে চেয়েছিল, কিন্তু কোনো পরিষ্কার উত্তর পাওয়া যায়নি।
এরই মধ্যে মাল্লাক্কা প্রণালী পেরিয়ে মার্কিন রণতরী বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে।
'ফরেন রিলেশন্স অব দ্য ইউনাইটেড স্টেটস, সাউথ এশিয়া ক্রাইসিস' শিরোনামে যেসব দলিল অবমুক্ত করার হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ১৪ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের দূত একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি নিয়ে আসেন হোয়াইট হাউজের চীফ অব স্টাফের কাছে।
সেই চিঠিতে বলা হয়, ভারতের কাছ থেকে এই মর্মে নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে যে পশ্চিম পাকিস্তানে আক্রমণ করার কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই।
তবে পাকিস্তান-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত হামলা করবে কি না, সে বিষয়ে পরিষ্কার কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি।
জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে পুনরায় চেষ্টা
এদিকে, ১৪ ডিসেম্বর ফ্রান্স এবং ইতালি নিরাপত্তা পরিষদে একটি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব তোলে। কিন্তু ওই প্রস্তাবে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির কথা বলা হয়েছিল।
একই সাথে পোল্যান্ডের একটি খসড়া প্রস্তাবও আসে। ১৫ ডিসেম্বর পোল্যান্ডের এই খসড়া প্রস্তাবটি আলোচনায় আসে নিরাপত্তা পরিষদে।
এই প্রস্তাবের পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ছিল এবং ভারত 'অনিচ্ছাসত্ত্বেও' সেটি মেনে নিয়েছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস লিখেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, যদি পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার হয় এবং আলোচনায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাহলে আলোচনা হতে পারে।
এই প্রস্তাবের অন্যতম বিষয় ছিল - যুদ্ধবিরতি এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানী সেনা প্রত্যাহার করা।
নিরাপত্তা পরিষদে ভুট্টো বলেন, "আমরা যুদ্ধ করবো। আমার দেশ আমাকে ডাকছে। এখানে আর সময় নষ্ট করা যাবে না। আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ এখানে পড়ে থাক। আমি চললাম।"
পোল্যান্ডের এই প্রস্তাব মেনে নিলে হয়তো সেটা শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের পক্ষে যেত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন কর্নেল রিয়াজ জাফরী। ১৯৭১ সালের ঘটনাপ্রবাহ তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। ২০১৬ সালে এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, পোল্যান্ডের প্রস্তাব মেনে নেবার প্রকৃত অর্থ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের 'বিচ্ছিন্নতাকে' মেনে নেয়া।
কিন্তু ওই প্রস্তাব মেনে নিলে ভারতের হাতে আত্মসমর্পণ করতে হতো না বলে উল্লেখ করেন রিয়াজ জাফরী।
আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি
জাতিসঙ্ঘে আলোচনা চললেও ১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর জেনারেল এ কে নিয়াজী ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাকের বাসায় যান 'যুদ্ধবিরতির প্রক্রিয়া' নিয়ে আলোচনা করতে।
পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পাকিস্তানী বাহিনীর কমান্ডার একে নিয়াজী জানান যে তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য প্রস্তুত, যদি তার সৈন্যদের নিরাপত্তা দেয়া হয়।
'যুদ্ধবিরতি' শব্দটি ব্যবহার করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি ছিল পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ।
মার্কিন দূতের মাধ্যমে জেনারেল নিয়াজীর লেখা যুদ্ধবিরতির চিঠি ১৫ ডিসেম্বর পৌঁছে যায় ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ'র কাছে।
জেনারেল মানেকশ উত্তর দেন, "আমার অগ্রসরমান সৈন্যদের কাছে যদি পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে, তাহলে যুদ্ধবিরতি গ্রহণযোগ্য হবে এবং আত্মসমর্পণকারী সৈন্যদের নিরাপত্তা দেয়া হবে।"
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ৭১-এর স্বাধীনতার ঘোষণা
হেনরি কিসিঞ্জার বলেন, ১০ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব আসার পরে আরও পাঁচদিন পূর্ব পাকিস্তান ধরে রেখেছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা। এই সময়ের মধ্যে আমেরিকা ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়, যাতে পশ্চিম পাকিস্তান আক্রান্ত না হয়।
পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ১৬ ডিসেম্বর পশ্চিম সীমান্তে শর্তহীন যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
রিচার্ড নিক্সন দাবি করেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের মাধ্যমে চাপ তৈরির ফলে পশ্চিম সীমান্তে ভারত যুদ্ধবিরতি করতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া বঙ্গোপসাগরে রণতরী পাঠানোর ফলে সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর চাপ তৈরি হয়েছিল বলে দাবি করেন নিক্সন।
আর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বলেছিলেন, আমরা পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করেছি।
সূত্র : বিবিসি