ব্ল্যাক প্রপাগান্ডা : গুপ্তচরবৃত্তির ব্রিটিশ স্টাইল
ব্ল্যাক প্রপাগান্ডা : গুপ্তচরবৃত্তির ব্রিটিশ স্টাইল - ছবি : সংগৃহীত
১৯৬০-এর দশকে লাতিন আমেরিকায় ব্রিটিশ গুপ্তচর সংস্থা আগে যা দাবি করা হতো তার চেয়ে অনেক বেশি সক্রিয়ভাবে গোপন তৎপরতা চালাতো বলে জানা যাচ্ছে।
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর সংস্থাগুলোর তৎপরতার কথা ব্যাপকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু সেখানে যে ব্রিটিশরাও বেশ তৎপর ছিল, সে সম্পর্কে কমই জানা যায়।
ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের প্রফেসর রোরি করম্যাক বলেন, সম্প্রতি যেসব গোপন সরকারি নথি উন্মুক্ত করা হয়েছে, তাতে দেখা যায় লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে ব্রিটিশরা নির্বাচনে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা করেছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করেছে।
১৯৬০-এর দশকের শুরু থেকে ব্রিটেন লাতিন আমেরিকায় নাটকীয়ভাবে তাদের গোপন তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। সেখানে তারা 'বিশেষ রাজনৈতিক কার্যক্রমের' আওতায় প্রপাগান্ডা চালাতে শুরু করে। নানা রকম জালিয়াতিরও আশ্রয় নেয়া হয়। এর লক্ষ্য ছিল জনমত প্রভাবিত করা, বিশেষ করে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে।
"এটি বেশ অবাক করা ব্যাপার। কারণ ইতিহাসবিদরা এতদিন মনে করতেন, ব্রিটিশরা কেবল মধ্যপ্রাচ্য আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতেই তাদের গোপন তৎপরতা চালাতো। তাদের ধারণা ছিল লাতিন আমেরিকার ব্যাপারটি ব্রিটিশরা সিআইএ'র হাতে ছেড়ে দিয়েছে", বলছেন প্রফেসর করম্যাক।
'ব্ল্যাক প্রপাগান্ডা'
১৯৬১ সালে রনি বারোজ বলে এক ব্রিটিশ কূটনীতিক ব্রিটেনের পররাষ্ট্র দফতর এবং এমআই-সিক্সের হয়ে লাতিন আমেরিকা সফর করেন। লন্ডন থেকে তখন সিদ্ধান্ত নেয়া হয় লাতিন আমেরিকায় গোপন তৎপরতা বাড়ানোর।
তখন সেখানে বিশেষ করে যে 'ব্ল্যাক প্রপাগান্ডা' চালানো হয়, তার পেছনে যে ব্রিটেন আছে, তা গোপন রাখা হয়েছিল।
এই ব্ল্যাক প্রপাগান্ডার মাধ্যমে সেখানে এমন সব ভুয়া জিনিসপত্র তৈরি করা হতো, যারা উদ্দেশ্যই ছিল জনগণকে বিভ্রান্ত করা। আর কারা এসব প্রচারের পেছনে আছে, সেটা নিয়েও মানুষকে বিভ্রান্ত করা হতো।
তখন বিশ্বে লাতিন আমেরিকার গুরুত্ব বাড়ছিল। কিন্তু সেখানে কমিউনিস্টদের প্রভাব যে বাড়ছে ,তারও অনেক লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল। বিশেষ করে কিউবার বিপ্লবের পর।
ব্রিটেন তখন সেভাবে লাতিন আমেরিকার দিকে মনোযোগ দিচ্ছিল না। সেখানে তাদের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রই সাধারণত সব কাজে নেতৃত্ব দিত। কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করতো, এই এলাকায় প্রভাব খাটানোর এখতিয়ার তাদের।
সেখানে যুক্তরাষ্ট্রই সবচেয়ে বেশি তৎপর ছিল। কিন্তু প্রফেসর করম্যাক বলেন, ব্রিটেন তারপরও এধরণের গোপন তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওপর প্রভাব বিস্তারের লক্ষ্যে। একই সঙ্গে লাতিন আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধিও তাদের লক্ষ্য ছিল।
"ব্রিটেন এসব গোপন তৎপরতা চালিয়েছে দুটি কারণে", বলছেন তিনি।
"প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে একটু সুবিধা পাওয়ার জন্য, কারণ এই সম্পর্ক ক্রমশ একতরফা হয়ে পড়ছিল। দ্বিতীয়ত, ঐ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কমে যাচ্ছে বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, সেটার সুযোগ নিয়ে সেখানকার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বাজার দখল করতে চাইছিল ব্রিটেন। ব্রিটেনের এই দুটি উদ্দেশ্যের মধ্যে আবার অনেক সময় দ্বন্দ্ব ছিল, তারা যেন একসঙ্গে যাচ্ছিল না।"
লাতিন আমেরিকায় যারা এরকম প্রপাগান্ডা চালাচ্ছিল, ব্রিটেন তাদের সংখ্যা বাড়ায়। সেখানে এমআই-সিক্সের নতুন স্টেশন খোলা হয়। এর মধ্যে চিলে এবং ভেনেজুয়েলাও ছিল। (এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা ভেনেজুয়েলাকে এক 'বিরাট পুরস্কার' বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন "এই দেশটি বেশ সমৃদ্ধশালী এবং দেশটির সরকার বড় ধরণের বিনিয়োগের উৎস হতে পারে।")
তবে ব্রিটেনের প্রধান লক্ষ্য ছিল প্রপাগান্ডা চালিয়ে কমিউনিজমকে ঠেকানো এবং সেখানে চার্চ, ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কাজ করা।
এই কার্যক্রমের অংশ হিসেবে কলম্বিয়ায় একটি ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়। চিলে এবং বলিভিয়ায় ইশতেহার বিলি করা হয়। স্থানীয় রেডিও স্টেশনগুলোর প্রযোজকদের ঘুষ দেয়া হয় যাতে সেখানে এয়ারটাইম পাওয়া যায় এবং এরকম প্রপাগান্ডার উদ্দেশ্যে তৈরি টেপ বাজানো হয়। এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা তখন গর্বভরে বলেছিলেন, "তাকে যদি এক লাখ পাউন্ড খরচ করতে দেয়া হয়, তাহলে তিনি আন্দিয়ান অঞ্চলের সব বেতার কথককে কিনে ফেলতে পারেন।"
ব্রিটেনের এই গুপ্তচররা বলিভিয়ার যাজকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সেখানে তারা সোভিয়েত এবং কিউবান প্রপাগান্ডার জবাবে নানা ধরণের প্রচারপত্র বিলি করে পাল্টা প্রপাগান্ডা চালান।
ইকুয়েডরেও তারা একই ধরণের তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন। সেখানে তারা যেসব যাজকদের সঙ্গে কাজ করেছেন, তারা প্রেসিডেন্ট কার্লোস জুলিও আরোসেমেনা মনরির বিরুদ্ধে লোক জড়ো করার ক্ষমতা রাখতো বলে মনে করা হয়। ব্রিটিশরা প্রেসিডেন্ট কার্লোস জুলিও আরোসেমেনা মনরিকে "খুবই নীতিহীন এবং অবাঞ্ছিত চরিত্র" বলে মনে করতো।
প্রফেসর করম্যাক এসব বিষয়ে যে প্রবন্ধটি লিখেছেন সেটির শিরোনাম, "দ্য কারেন্সি অব কভার্ট অ্যাকশন : ব্রিটিশ স্পেশাল পলিটিক্যাল একশন ইন ল্যাটিন আমেরিকা, ১৯৬১-৬৪।" এটি প্রকাশিত হয়েছে জার্নাল অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজে।
এতে তিনি লিখেছেন, এই ব্রিটিশ গুপ্তচরদের ধারণা ছিল, এই যাজকরা চাইলে যেকোনো সময় রাজধানী কিটোর রাস্তায় ৫ হাজার মানুষ জড়ো করার ক্ষমতা রাখে। বিশেষ করে ক্যাথলিক তরুণদের ওপর তাদের বেশ প্রভাব ছিল।
২০১৯ এবং ২০২০ সালে প্রকাশ করা গোপন নথিপত্রের ভিত্তিতে অধ্যাপক করম্যাক বলেন, ব্রিটিশ গুপ্তচররা তখন ট্রেড ইউনিয়নগুলোর মধ্যেও তাদের অনুচর ঢুকিয়ে দিয়েছিল। তারা অনেক ট্রেড ইউনিয়ন দখল করে নিয়েছিল অথবা এগুলোর সভায় বিঘ্ন ঘটাতে পেরেছিল।
ব্রাজিলের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জোয়াও গোলাকে ব্রিটিশরা টার্গেট করেছিল। ব্রিটিশরা এমন কিছু জাল কাগজ তৈরি করে যাতে দেখানো যায় কমিউনিস্টরা ট্রেড ইউনিয়নগুলো দখল করে নিয়েছে। যাতে করে প্রেসিডেন্টের মনে এমন ভয় ঢুকিয়ে দেয়া যায় যে সেখানে তার অবস্থানকে কট্টর বামপন্থীরা নাজুক করে তুলছে।
তবে এই কাজটি শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা আর করেনি। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট জোয়াও গোলাকে ১৯৬৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমেই ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
ব্রিটিশকরা কয়েকটি ঘটনায় নির্বাচনেও প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে। বিশেষ করে চিলেতে ১৯৬৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। ব্রিটিশদের আশঙ্কা ছিল সেখানে সমাজতন্ত্রী সালভাদর আলেন্দে জয়ী হতে পারেন।
একটি ব্রিটিশ গোপন নথিতে এ ব্যাপারে বলা হচ্ছে, "আলেন্দে একবার ক্ষমতায় এলে এমন সম্ভাবনা আছে যে তাকে কমিউনিস্টরা তাদের ইচ্ছেমত বা অন্য কোনোভাবে পরিচালনা করতে পারবে এবং শেষ পর্যন্ত চিলিতে হয়তো কিউবার মতো একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।"
তবে সেখানে ব্রিটিশদের তৎপরতাকে ছাড়িয়ে যায় মার্কিনিদের কর্মকাণ্ড। সেখানে দু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র খরচ করেছিল ৩০ লাখ ডলার, যাতে করে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা যায়।
প্রফেসর করম্যাকের বিশ্লেষণ হচ্ছে, ব্রিটেন আসলে "খুব সস্তায় বিশ্বে তাদের একটা ভূমিকা বজায় রাখার জন্য" এ ধরণের গোপন তৎপরতাকে ব্যবহার করছিল।
সূত্র : বিবিসি