আপনার মেজাজেই লুকিয়ে রয়েছে আসল রোগ?
আপনার মেজাজেই লুকিয়ে রয়েছে আসল রোগ? - ছবি সংগৃহীত
সকালে মনে অনাবিল আনন্দ, বিকেলে একরাশ বিষণ্ণতা। কখনো হঠাৎই মেজাজ তুঙ্গে। পরক্ষণেই গলে পানি। মনের এই দুই দিকের অস্বাভাবিক প্রকাশ আসলে একটি রোগের লক্ষণ। নিয়ন্ত্রণ না করলে যেকোনো সময় ঘটে যেতে পারে বিপদ। এই মেজাজি অসুখকে বশে আনার দাওয়াই কী? জানাচ্ছেন বিশিষ্ট মনরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. দেবাঞ্জন পান।
অন্তরা ইদানীং ভীষণ একগুঁয়ে। কেউ ওর কথার এদিক-ওদিক করলেই তিরিক্ষে মেজাজ। নিজের হুকুম-জুলুম সবার উপর চলতে থাকে। কেউ না শুনলে সে অন্তরার নজরে বাজে হয়ে যায়। হঠাৎ করে শান্ত-ভদ্র মেয়েটির আচরণে এমন পরিবর্তন। একদিন তো রেগে গিয়ে মাকে মোবাইল ছুড়ে মারল।
রাগেশ্রী আর স্মিতা ১০ বছর ধরে একটি কর্পোরেট অফিসে কাজ করছেন। শপিং, ঘুরতে যাওয়া, গসিপ, অফিশিয়াল থেকে পার্সোনাল প্রবলেম সব কিছুই দু’জনে শেয়ার করে। সম্প্রতি স্মিতার স্বভাবে কিছু পরিবর্তন রাগেশ্রীকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। স্মিতার খরচের হাত আচমকা খুব বেড়েছে। হঠাৎ করে নিজেকে বিশাল ভাবতে শুরু করেছে। রাগেশ্রীকে কোনো কথাই মন খুলে বলছে না। সব সময় উদাসীন! কিছুই যেন ভালো লাগছে না! কেন এমন পরিবর্তন?
সুখী দাম্পত্যে হঠাৎ করেই কলহের উৎপত্তি। স্ত্রীর কোনো কথা কিছুতেই মানতে পারে না অভ্র। স্ত্রীর কথায়, অভ্র আজকাল সব ব্যপারে নিজেকে জাহির করতে থাকে, ওর মতে চলতে হবে। তা না করলেই তুমুল অশান্তি করে। আবার কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই সব ঠিক। অন্তরা, স্মিতা কিংবা অভ্র। এদের মতো চরিত্র চারপাশে অনেকের মধ্যেই চোখে পড়ে। আরো বেশি নজর কাড়ে যখন চেনা, শান্ত স্বভাব হঠাৎ করেই অশান্ত, অবাধ্য হয়ে ওঠে। মুড বা মেজাজের এই ওঠা পড়া আসলে একটি অসুখ। যার নাম, বাইপোলার ডিসঅর্ডার। গোঁফ দিয়ে যায় চেনার মতো, শুধুমাত্র ‘মেজাজ’ দিয়ে অনেকটাই পরিচয় পাওয়া যায় বাইপোলারে।
এই অসুখে কী হয়?
বাইপোলারের অর্থ দুটি পোল বা দুটি মেরু। মন ও মেজাজের দুটি দিক হলো বাইপোলার। যার এক মেরুতে থাকে উচ্ছ্বাস, অনাবিল আনন্দ নিয়ে লাগামহীন বেপরোয়া মন। যাকে বলা হয় ম্যানিক ফেজ বা এই অবস্থার নাম ম্যানিয়া। অন্য মেরুতে থাকবে গভীর শূন্যতা, বিষণ্ণতা। অর্থাৎ ডিপ্রেশন ফেজ। মনের এই দুই মেরু নিয়ে যার দিন যাপন, সে-ই বাইপোলার। অর্থাৎ কখনো ডিপ্রেশন বা অবসাদগ্রস্ত, কখনো আবার চরম মেজাজি রণংদেহি মূর্তি।
মেরু এক :
ম্যানিক ফেজে যখন কেউ থাকবে তখন তাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন।
চোখে পড়ার মতো ব্যবহারের হঠাৎ পরিবর্তন।
হঠাৎ করেই সব কাজে এনার্জি খুব বেড়ে যাওয়া।
নিজেকে বিরাট কিছু মনে করা।
হঠাৎ প্রচুর খরচের ঝোঁক।
খুব বেশি কথা বলা।
কেনাকাটা, দান করার প্রবণতা বৃদ্ধি।
ঘুমের চাহিদা খুব কমে যায়।
খুব রেগে যাওয়া, রেগে গিয়ে জিনিস ভেঙে ফেলা, অন্যকে আঘাত করা।
রাগ বা জেদকে কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তা থেকে অন্যের উপর সে শারীরিকভাবে আঘাতও হানতে পারে।
কারো এমন লক্ষণ হঠাৎ করেই ১-২ বার দেখা গেলেই সতর্ক হতে হবে।
মেরু দুই:
কোনো কিছুই ভাল না লাগা, শূন্যতা।
ভালো ঘটনাতেও আনন্দ, ফুর্তি নেই।
খুব কান্না পাওয়া।
বেঁচে থাকার ইচ্ছা কমে যাওয়া, অপরাধবোধ কাজ করা, আত্মহত্যার প্রবণতা যাদের সঙ্গে মিশতে ভালো লাগত, তাদের সঙ্গে কথা বলতে ভালো না লাগা।
যেসব পছন্দের জিনিস আগে আনন্দ দিত, তা পেয়েও কোনো সুখ, শান্তি ও আনন্দ না পাওয়া।
নিজেকে সমাজ, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা।
খুব ঘুম পাবে অথবা ঘুম হয়তো আসতেই চাইবে না। ঘুম থেকে উঠলেও কোনও এনার্জি না পাওয়া, ক্লান্তি ভাব।
খিদে কম, যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়ার লক্ষণ থাকলে সতর্ক হতে হবে।
২ সপ্তাহ ধরে এই ধরনের সমস্যা থাকলে অবশ্যই তা বাইপোলার ডিপ্রেশন বা মেজর ডিপ্রেশনের লক্ষণ হবে।
অল্প বলে, অবহেলা নয় : এই ধরনের মেজাজ ও অবসাদের লক্ষণ সবসময় যে খুব প্রকটভাবে প্রকাশ পায় তা নয়। সব লক্ষণই থাকবে, কিন্তু মাত্রা কম। এমন হলে অনেক ক্ষেত্রেই তা অবহেলার বিষয় হয়। কেউ মনেই করে না এই ধরনের মেজাজ বা অবসাদের অল্প প্রকাশ কোনও রোগ। বিশেষজ্ঞের কথায়, এই অল্প মাত্রায় অবসাদ বা মেজাজ থেকে যেকোনো সময়ই জন্ম নিতে পারে বাইপোলার ম্যানিয়া অথবা ডিপ্রেশন। মাঝে মাঝেই কয়েক দিনের জন্য তার খুব ভালো লাগবে, সবেতেই আনন্দ পায়। কাজ করে, সকলের সঙ্গে গল্প করে খুব শান্তি। আবার হঠাৎ করেই কিছু দিনের জন্য কিছুই ভালো লাগছে না। কারো সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না, একা থাকতেই ভালো লাগছে। মনোবিদের কথায়, এই রোগের নাম সাইক্লোথাইমিয়া।
এই রোগ অনেকেরই থাকে, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নজরে পড়ে না। বয়ঃসন্ধির সময়েই এই ধরনের সমস্যা সবচেয়ে বেশি হয়। কারো সাইক্লোথাইমিয়া বেশি দিন থাকতে থাকতে যেকোনো সময়েই সে বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত হতে পারে। বিশেষ করে যদি এমন ঘটনা ঘটে, হঠাৎ করে চাকরি চলে যাওয়া, প্রিয়জনের সঙ্গে বিবাদ-বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু, মারাত্মক স্ট্রেস, হঠাৎ করে অর্থনৈতিক বিপর্যয়, তবে সে সাইক্লোথেমিয়া থেকে হঠাৎ ম্যানিক ফেজে চলে যেতে পারে। এমন ঘটনা ঘটলে তা থেকে একবারও বাইপোলারের লক্ষণ থাকলে সতর্ক হতে হবে, মনোবিদের পরামর্শ নিতে হবে।
বাইপোলার ডিসঅর্ডারের কারণ
এই মনোরোগে ব্রেনের ভূমিকা কতটা তা এখনো প্রমাণিত হয়নি। জিন গঠিত কারণ অনেকাংশে দায়ী। পরিবারে কারো অবসাদ, খুব রাগ এই ধরনের সমস্যা থাকলে সরাসরিভাবে যুক্ত পরিবারের অন্য সদস্যদেরও বাইপোলার ডিসঅর্ডার হওয়ার সম্ভাবনা ৪০-৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বাবা-মায়ের বাইপোলার ডিসঅর্ডার থাকলে বাইপোলার বা যেকোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে সন্তানেরও প্রায় ৪০ শতাংশ রিস্ক থাকে। ১৫-৫০ বছর বয়সের মধ্যে যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে এই রোগে।
ওষুধের পাশাপাশি জরুরি
হেলদি লাইফস্টাইল মেনে চলুন। পুষ্টিকর খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে হবে। ব্রেনের কাজ ঠিক রাখতে
বেশি মিষ্টি জাতীয় খাবার খাওয়া চলবে না। ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়াতে ভিটামিন, মিনারেলের উপযুক্ত জোগান জরুরি। প্রচুর শাক সবজি, ফল খেতে হবে। অ্যান্টি অক্সিডেন্ট জাতীয় খাবার খেতে হবে। স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। নিউরো কেমিক্যালের মাত্রা ঠিক রাখতে প্রোটিন জাতীয় খাবার খেতে হবে। অ্যালকোহল ব্রেনের ক্ষতি করে, তাই মদ বাদ। নিয়মিত শরীরচর্চা জরুরি। রোজ প্রাণায়ম বা মেডিটেশন করুন। অ্যারোবিক এক্সারসাইজ যেমন, সাঁতার, হাঁটা, দৌড়নো সপ্তাহে ৩-৪ দিন। তাহলে ব্রেনের নিউরোন ঠিকমতো উদ্দীপিত হয়। যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
কেমন চিকিৎসা
খুব বাড়াবাড়ি হলে ওষুধ দিয়ে রোগীকে শান্ত করার প্রয়োজন হয়। চিকিৎসকের পরামর্শমতো স্টেবিলাইজার জাতীয় ওষুধ খেতে হয়। রোগের লক্ষণ দেখে ঠিক মতো তা নির্ণয় করা জরুরি। খুব শান্ত পরিবেশে রোগীকে রাখতে হবে, উজ্জ্বল আলো এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজন রোগীর কাউন্সেলিং বা সাইকোথেরাপি। পরিবারে বাইপোলারিটি থাকলে আগে থেকে সতর্ক হোন।
সূত্র : সংবাদ প্রতিদিন