আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য
আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী - ছবি : সংগৃহীত
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ইন্তেকাল করেছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। গতকাল রোববার বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে গেছেন। তার মৃত্যুতে ইসলামী দলগুলো ও কওমি অঙ্গনে শোকের ছায়া নেমে আসে।
গতকাল বেলা সাড়ে ৩টার দিকে তার লাশ বারিধারা জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসায় আনলে হেফাজতে ইসলাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মী, বিভিন্ন মাদরাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও ভক্তদের ভিড় জমে। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। রাতে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স মাদরাসা প্রাঙ্গণে রাখা হয়। আজ সোমবার সকাল ৯টায় বায়তুল মোকাররমে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর তার প্রতিষ্ঠিত তুরাগ জামিয়া সুবহানিয়া মাদরাসার কবর স্থানে লাশ দাফন করা হবে।
গত ১ ডিসেম্বর ঠাণ্ডাজনিত কারণে হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে নূর হোসাইন কাসেমীকে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতাল ভর্তি করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তার শ্বাসকষ্টজনিত রোগ টাইপ-২ রিসিপিরেটরি ফেইলিউর রোগ ধরে পড়ে। এজন্য হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রেখে চিকিৎসা চলছিল। হেফাজত মহাসচিবের প্রেসসচিব মুনির আহমদ নয়া দিগন্তকে জানান, হাসপাতালে নেয়ার পর তার দুই দফা করোনা পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু দুবারই ফলাফল নেগেটিভ আসে।
বারিধারা জামিয়া মাদানিয়া মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সিপাল নূূর হোসাইন কাসেমী জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব ছিলেন। এ ছাড়া কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সিনিয়র সহসভাপতি ও হাইয়্যাতুল উলইয়ার কো-চেয়ারম্যান ছিলেন।
সংক্ষিপ্ত জীবনী : নূর হোসাইন কাসেমী ১৯৪৫ সালের ১০ জানুয়ারি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ থানার চড্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মাওলানা আবদুল ওয়াদুদ। চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত তিনি নিজ গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেন। তারপর ভর্তি হন পাশের গ্রামের কাশিমপুর মাদরাসায়। এখানে পড়েন মুতাওয়াস-সিতাহ পর্যন্ত। তারপর বরুড়ার ঐতিহ্যবাহী জামিয়া দারুল উলুমে ভর্তি হন। সেখানে হেদায়া পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষার জন্য ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দে পাড়ি জমান। সেখানে প্রথমে সাহারানপুর জেলার বেরিতাজপুর মাদরাসায় ভর্তি হন। সেখানে জালালাইন জামাত পড়া শেষ করেন। তারপর ভর্তি হন দারুল উলুম দেওবন্দে। এখানে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ আলেম আল্লামা সায়্যেদ ফখরুদ্দীন আহমদ মুরাদাবাদীর কাছে বুখারি শরিফ পড়েন। মুরাদাবাদীর অত্যন্ত স্নেহভাজন হিসেবে তিনি অল্প সময়ে সবার কাছে পরিচিতি লাভ করেন।
তাকমিল জামাত পড়ার পর তাকমিলে আদব, তাকমিলে মাকুলাত, তাকমিলে উলুমুল আলিয়া শেষ করেন। আল্লামা কাসেম নানুতুবীর প্রতিষ্ঠিত ভারতের মুজাফফার নগরের মুরাদিয়া মাদরাসায় শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। সেখানে এক বছর শিক্ষকতা করেন। ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন নূর হোসাইন কাসেমী। শরীয়তপুর জেলার মুহিউস সুন্নাহ মাদরাসায় শাইখুল হাদিস ও মুহতামিম পদে যোগদান করেন। ১৯৭৮ সালে জামিয়া আরাবিয়া ইমদাদুল উলুম ফরিদাবাদ মাদরাসায় যোগদান করেন। ১৯৮২ সালে চলে আসেন জামিয়া শারইয়্যাহ মালিবাগে। এখানে তিরমিজি শরিফের দরস দেন। মালিবাগে ছয় বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর তিনি ১৯৮৮ সালে রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৮ সালে তুরাগ থানায় জামিয়া সুবহানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ইন্তেকালের আগ পর্যন্ত তিনি এই দুই প্রতিষ্ঠানে প্রিন্সিপাল ও শায়খুল হাদিসের দায়িত্ব পালন করে গেছেন। এ ছাড়াও তিনি চৌধুরীপাড়া মাদরাসা, শামসুল উলুম কাওলা মাদরাসা, টিকরপুর জামেয়া, জামেয়া ইসহাকিয়া মানিক নগরসহ দেশের কয়েকটি মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও মুরুব্বি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৩ সালে শাইখুল হাদিস যাকারিয়ার কাছে প্রথমে বায়াত নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করেন। তার ইন্তেকালের পর মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহীর কাছে বায়াত নেন। ১৯৯৫ সালে মুফতি মাহমুদ হাসান গাঙ্গুহী বাংলাদেশে এলে সে সময় তার কাছ থেকে খেলাফত লাভ করেন। সর্বশেষ তিনি খানকায়ে মাহমুদিয়ার আমির ছিলেন।
নূর হোসাইন কাসেমীর বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন ছিল। ১৯৭৫ সালে তিনি জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশে যোগ দেন। তারপর ১৯৯০ সালে জমিয়তের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসেন। ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বর জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মহাসচিবের দায়িত্ব পান। এর পর থেকে তিনি এ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক দলের নেতা হিসেবেও তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। এ ছাড়া হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতাকালীন সময় থেকেই কেন্দ্রীয় নায়েবে আমিরের দায়িত্বে ছিলেন। এরপর ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা আন্দোলনের সময় সংগঠনের কার্যক্রম বিস্তৃত হলে ঢাকা মহানগর কমিটির সভাপতির দায়িত্বে আসেন। হেফাজতের প্রতিটি আন্দোলনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে ভূমিকা পালন করেন তিনি। বিশেষ করে ২০১৩ সালের ২ এপ্রিল হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ এবং ৫ মে ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি বাস্তবায়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। এ ছাড়া খতমে নবুওয়াত আন্দোলন, তাসলিমা নাসরিনের নাস্তিক্য মতবাদবিরোধী আন্দোলন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার আন্দোলন, বাবরি মসজিদ রক্ষা আন্দোলন, জাতীয় শিক্ষানীতি থেকে ইসলাম শিক্ষা বাদ দেয়ার প্রতিবাদী আন্দোলন, স্কুল পাঠ্যপুস্তক সংশোধনী আন্দোলন, রোহিঙ্গা মুসলিম নির্যাতন বিরোধী আন্দোলন, সুপ্রিমকোর্ট চত্বর থেকে থেমিস দেবির মূর্তি অপসারণ আন্দোলন, কাশ্মির-ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের দেশে দেশে মুসলিম নিপীড়ন বিরোধী আন্দোলন এবং সম্প্রতি ফ্রান্সে রাসূলের অবমাননার প্রতিবাদে দুর্বার আন্দোলনে অন্যতম ভূমিকা পালন করেন।
শোকবাণী : হেফাজত মহাসচিবের মৃত্যুতে হেফাজতে ইসলাম, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি গভীর শোক জানিয়েছেন এবং তার পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন ও শুভানুধ্যায়ীদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন।
আমিরে হেফাজত, হাটহাজারী মাদরাসার শায়খুল হাদিস ও শিক্ষা পরিচালক আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রাহ: দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও শীর্ষ একজন প্রবীণ আলেমে দ্বীন ছিলেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ইসলাম বিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে জোরাল প্রতিবাদ জানাতেন তিনি। বাতিলের সাথে কখনো আপস করেননি তিনি। লোভ-লালসা ও ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে থাকতেন আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী।
মাওলানা কাসেমীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তিনি ছিলেন একজন দক্ষ সংগঠক, অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে নিজ সংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমান স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে এই সাহসী নেতা শত নির্যাতন সহ্য করেছেন। তার সংগ্রামী ভূমিকা গণতন্ত্রকামী মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান বলেন, আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী ছিলেন আলেম-উলামা ও তৌহিদি জনতার প্রিয় রাহবার। তিনি সারা জীবন ইসলামের খেদমত করে গেছেন। তিনি দেশে ইসলামী শিক্ষার বিস্তার ও প্রসারে বিশেষ করে কওমি শিক্ষার বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তার শূন্যতা সহজে পূরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তার ভুল-ত্রুটিগুলো ক্ষমা করে দিয়ে তাকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।
এ ছাড়া খেলাফত মজলিসের আমির অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিব ড. আহমদ আবদুল কাদের, সম্মিলিত ইসলামী দলগুলোর কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ মাওলানা আবু তাহের জিহাদী, জয়নুল আবেদিন, মাওলানা জাফরুল্লাহ খান, মাওলানা মহিউদ্দীন রব্বানী, ড. মুফতি রহমান মাদানী, মাওলানা আহমদ আলী কাসেমী, মুফতি ফখরুল ইসলাম, মুফতি আবুল কাসেম কাসেমী, মুফতি মাসুদুর রহমান, মুফতি ফয়জুল্লাহ আশরাফী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা আতাউল্লাহ হাফেজ্জী, মহাসচিব মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজী, নায়েবে আমির মাওলানা মুজিবুর রহমান হামিদী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম, নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম শায়খে চরমোনাই, মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা ইউনুছ আহমাদ ও রাজনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক আশরাফ আলী আকন, জাতীয় ওলামা মাশায়েখ আইম্মা পরিষদ সভাপতি আল্লামা নূরুল হুদা ফয়েজী ও সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, জাতীয় শিক্ষক ফোরাম সভাপতি অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান, ইসলামী আন্দোলনের ঢাকা মহানগর দক্ষিণ সভাপতি মাওলানা মুহাম্মদ ইমতিয়াজ আলম ও সেক্রেটারি মাওলানা এ বি এম জাকারিয়া, উত্তর সভাপতি মাওলানা শেখ ফজলে বারী মাসউদ ও সেক্রেটারি মাওলানা আরিফুল ইসলাম,
জাতীয় তাফসির পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা আহমদ আবদুল কাইয়ূম, ইসলামী ঐক্যজোটের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মাওলানা আবুল হাসানাত আমিনী ও মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির আল্লামা ইসমাঈল নূরপুরী ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির ড. মাওলানা মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী ও সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মোস্তফা তারেকুল হাসান, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা: মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার ফরিদ উদ্দিন, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব লায়ন ফারুক রহমান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের একাংশের সভাপতি সাবেক ধর্মপ্রতিমন্ত্রী মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস, নির্বাহী সভাপতি মাওলানা মনসরুল হাসান রায়পুরী, সিনিয়র সহসভাপতি মাওলানা আব্দুর রহিম ইসলামাবাদী, মহাসচিব মাওলানা শেখ মুজিবুর রহমান, যুব জমিয়তের সভাপতি মুফতি রেদওয়ানুল বারী সিরাজী, খেলাফতে ইসলামীর মহাসচিব মাওলানা ফজলুর রহমান, নেজামে ইসলাম পার্টির আমির আল্লামা সারওয়ার কামাল আজিজি ও মহাসচিব মাওলানা মুসা বিন ইজহার এবং ঢাকা মহানগর আমির অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা আবু তাহের খান ও সাধারণ সম্পাদক মুফতি মাওলানা ফরহাদ আলম, বাংলাদেশ জনসেবা আন্দোলনের চেয়ারম্যান মুফতি ফখরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো: সিরাজুল ইসলাম ও সেক্রেটারি জেনারেল সালাহউদ্দিন আইউবী, রাবেতাতুল উম্মাহ বাংলাদেশের সভাপতি মাওলানা এনামুল হক মুসা ও সাধারণ সম্পাদক মাওলানা আজিজুর রহমান হেলাল মরহুমের রূহের মাগফিরাত কামনা ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করেন।