যেভাবে শান্তি আসতে পারে আফগানিস্তানে
যেভাবে শান্তি আসতে পারে আফগানিস্তানে - ছবি সংগৃহীত
আফগানিস্তানে চলমান সহিংসতায় প্রতিদিনই মানুষ মরছে, সম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। চলতি ডিসেম্বরের প্রথম ১০ দিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ৩০ জন। তাদের মধ্যে সরকারি বাহিনীর সদস্য ২১। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে জালালাবাদ শহরে মালালাই মাইওয়ান্দ নামের এক নারী সাংবাদিককে কর্মস্থলে যাবার পথে তার গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার গাড়িচালক আহত হয়ে হাসপাতালে মারা যান।
আগের দিন ৯ ডিসেম্বর বলখ প্রদেশে সাতজন পুলিশ সদস্যকে রাস্তায় গাড়িসহ ধরে নিয়ে যায় অস্ত্রধারীরা রাজধানী কাবুলে ১২ ডিসেম্বর সিরিজ রকেট হামলা চালানো হয়েছে ।
আগের মাসে (২০২০-এর নভেম্বর) তালেবান হামলায় সরকারি বাহিনীর ২৪৪ সদস্য ও ২০০ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।
২৯ নভেম্বরের গজনি শহরে তালেবানের পরিচালিত এক ভয়াবহ হামলায় ৩১ জন সৈন্য নিহত এবং অপর ২৪ জন আহত হয়েছেন। একটি সামরিক গাড়ি চুরি করে নিয়ে তাতে বিষ্ফোরক বোঝাই করে সেনা ছাউনিতে পরিচালিত এ হামলাটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে তাতে কয়েকটি ভবনও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এখাবে প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও আহতের তালিকা।
এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানে যুদ্ধে ২০১৮ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত আমেরিকার ২,৩৭২ জন সৈন্য নিহত হয়েছে। এ সময়ে আফগান বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে ১৬,১৭৯ জন। তাছাড়া সহিংস হামলায় অমেরিকান সরকারের ২০,৩২০ জন কর্মচারী এবং ১,৭২৯ জন আমেরিকার বেসামরিক ঠিকাদারও আহত হয়েছেন।
বড় বেশি প্রয়োজন শান্তি
বছরের পর বছর ধরে অফগানিস্তানে চলছে যুদ্ধ-সংঘাত। হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু আর ধ্বংসস্তুপের মাঝে কাতরাচ্ছে আফগানিস্তান। তাই যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশটিতে এখন বড় বেশি প্রয়োজন শান্তি।
বাইরের সহযোগিতা নিয়ে গোষ্ঠী সঙ্ঘাতে লিপ্ত থেকে এত দিনে স্থানীয় শক্তিগুলো বুঝতে পারছে নিজেদের মধ্যে সমঝোতা খু্বই দরকার। আর সঙ্ঘাতের বিদেশী পক্ষ মার্কিনিরাও এখন ক্লান্ত। দীর্ঘ অমীমাংসিত যুদ্ধ আর টানতে চাইছে না মার্কিনিরা। কিছু যুদ্ধবাজ ছাড়া শান্তিপ্রিয় বিশ্বাসী চাইছে আফগানদের শান্তিতে থাকার সুযোগ দেয়া হোক।
প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ১৯৮০-এর দশকে আফগানিস্তানকে সোভিয়েত দখল মুক্ত করতে তালেবানের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করেছে। তারপর সময়ের পরিবর্তনে তালেবানের উৎখাত করতে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে আমেরিকা। ২০০১ সালে আমেরিকা তালেবানকে হটিয়ে দখল করে নেয় আফগানিস্তানকে। তারপর একটানা যুদ্ধ। তালেবানকে নির্মূল করতে পারেনি বিশ্বের শক্তিশালী আমেরিকার সেনা শক্তি ও তাদের সহযোগী ন্যাটো গোষ্ঠী। তালেবানের কারণে যে পাকিস্তানকে নানা সময়ে নানা সঙ্কট মোকাবেলা করতে হয়েছে সেই পাকিস্তানকেই এখন এগিয়ে আসতে হয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর মধ্যে সমঝোতা করার কাজে।
এ বছর সেপ্টেম্ববর মাসে পাকিস্তানের দূতিয়ালিতে দোহাতে অনুষ্ঠিত হয়েছে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যকার সমঝোতা বৈঠক। তার পরও থেমে নেই সঙ্ঘাত। যেকোনো সময় আরো ভয়াবহ রক্তপাত ঘটে যেতে পারে এমন আশঙ্কা নিয়ে আতঙ্কের দিন কাটাচ্ছে আফগান নাগরিকেরা।
পাকিস্তাননের দূতিয়ালি
এরকম উত্তপ্ত অবস্থার মাঝে গত নভেম্বরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশিকে নিয়ে কাবুল সফরে যান। সেখানে আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সাথে সাক্ষাত করে আশ্বাস দিয়েছেন আফগানিস্তানে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সঙ্ঘাত প্রশমন ও তালেবানের সাথে আপসরফা করতে যা করা সম্ভব পাকিস্তান তা করবে। পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরকারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের কাজটা আফগানিস্তানের রাস্তা ধরেই এগুচ্ছে।
কাবুল সফরকালে আফগান প্রেসিডেন্টের সাথে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইমরান খান উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সমঝোতা প্রচেষ্টা চলাকালেও সঙ্ঘাতের ঘটনা ঘটছে। এটা হতাশাব্যঞ্জক। এর আগে গত অক্টেবরে আফগান নেতা গুলবুদ্দিন হেকমাতিয়ার পাকিস্তান সরকারের অতিথি হয়ে ইসলামাবাদ সফর করেছেন। তার সশস্ত্র গ্রুপটি ২০১৬ সালেই অস্ত্রসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছে।
আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার ঘোষণা
এরই মাঝে আমেরিকা ঘোষণা করেছে মধ্য জানুয়ারি নাগাদ ট্রাম্প প্রশাসন বিদায় নেবার আগেই আফগানিস্তানে মোতায়েন ৪,৫০০ সৈন্যের অর্ধেকটা কমিয়ে আনা হবে। আমেরিকার এ সিদ্ধান্তে নাখোশ হয়ে ন্যাটো প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এভাবে দ্রুত সৈন্য হ্রাস করা হলে সঙ্ঘাত বৃদ্ধির আশঙ্কা থেকে যাবে। আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিনিরা।
ন্যাটো প্রধান বলেছেন, আমরা একটা কঠিন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে যাচ্ছি। আমাদের বাহিনী গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে মোতায়েন রয়েছে। ন্যাটো অংশীদারেরা কেউই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি দিন এখানে থাকতে চায় না। কিন্তু, তাড়াহুড়া করে সমন্বয়হীনভাবে এখান থেকে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে তার জন্য বেশি মূল্য দিতে হতে পারে।
ওদিকে পাকিস্তান অভিযোগ করেছে, আফগানিস্তানের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে নাশকতা চালাচ্ছে ভারত। তবে, আফগান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাৎক্ষণিকভাবেই সে অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
আফগানিস্তানে বর্তমানে একটি নির্বাচিত সরকার রয়েছে। আফগানদের নানা গোষ্ঠী ও গোত্রের প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত এ সরকার খুবই নাজুক ঐক্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। আর তালেবান গোষ্ঠী তো আশরাফ গনির সরকারকে বিরেধিতা করেই যাচ্ছে। কারণ তারাই ছিল একদা আফগান সরকারের ক্ষমতায়। তাদের হটিয়েই মার্কিনিরা আফগানিস্তানকে দখলে নিয়ে সম্পদ লুট করছে।
আফগানিস্তানে শান্তি স্থাপনের জন্য আফগান সরকার, তালেবান ও মার্কিন সরকার– এই তিন পক্ষ হচ্ছে প্রধান খেলোয়ার। তবে তাদের বাইরেও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলমান গোষ্ঠীগত সঙ্ঘাত ও বিদেশী হম্তক্ষেপ থেকে আফগানিস্তান রাতারাতি মুক্তি পাবে- তেমনটি সম্ভব নয়। তবে সমঝোতা ও শান্তি প্রচেষ্টার বাইরে কোনো বিকল্প সমাধানও দেখা যাচ্ছে না।
চটজলদি একটা সমাধানে পৌঁছানোর মতো একটি বাস্তবতা এখানে অনুপস্থিত। সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে মানিয়ে নিয়ে একটা সমঝোতা বের করা বেশ ধৈর্য ও কষ্টসাধ্য কাজ। যেন তেন প্রকার একটি সাময়িক সমঝোতার চেষ্টা হলে তা বরং উল্টা নতুন সঙ্ঘাতের কারণ হয়ে উঠতে পারে।
এদিকে পাকিস্তান তার দূতিয়ালিতে আফগান সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের একটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয়। আর এ কাজে আমেরিকাও পাকিস্তানের প্রতি সায় দিয়ে যাচ্ছে।
তবে এ ক্ষেত্রে আফগান সরকারকেই বেশি এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, দেশে শান্তি ফিরে এলে তাদেরই লাভ বেশি। আর সরকারের শরিক নানা গ্রুপ ও গোত্রের প্রতিনিধিদেরও এটা অনুধাবন করতে হবে যে দেশে শান্তি ফিরে এলেই তাদের নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা হবে।
তাছাড়া তালেবান যোদ্ধাদেরও বুঝতে হবে যে দু’দশক ধরে টানা যুদ্ধ চালিয়ে একটা কার্যকর সমাধানে এখনো পৌঁছানো যায়নি। তাই তাদের নিজ নিজ জনগোষ্ঠীর স্বার্থে, জনগণের জান-মাল রক্ষার্থে সঙ্ঘাতের বদলে সমঝোতার পথেই শান্তি খোঁজা উত্তম।
সকল পক্ষকে সন্তুষ্ট করে কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো নিঃসন্দেহেই একটি কঠিন কাজ। তবে তা অসম্ভব নয়। আফগান সরকার, তালেবান ও মার্কিনিদের তরফ থেকে প্রত্যেকেরই কিছু ছাড় দিয়ে হলেও একটি শান্তি চুক্তিতে উপনীত হওয়া খুবই জরুরি। আজকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আফগান জনগণকে তাদের স্বদেশে নির্বিঘ্নে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেঁচে থাকার সুযোগ দেয়া।