ডি-কাপলিং : চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের অস্ত্র!
ট্রাম্প - ছবি সংগৃহীত
ডি-কাপলিং। চীনের বিরুদ্ধে এই অস্ত্রেই শান দিচ্ছেলেন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের বাণিজ্যযুদ্ধে ‘চায়না ডি-কাপলিং’ এই প্রোগ্রামের আসল মানে কী? মানে হলো, চীনকে একঘরে করা। কিন্তু ‘একঘরে’ মানে? আমাদের গ্রামের একঘরে মানে ওর নুন, পানি বন্ধ করে দেয়া; আর ওর সাথে কেউ কোনো পণ্য বিনিময় করবে না যার ব্যবহারিক মানে ‘নো এক্সচেঞ্জ’-ওকে সমাজ থেকে বের করে দেয়া; যদিও সে আগের বাড়িতেই বসবাস করবে, তার পরেও। কেমন করে এটা ঘটানো সম্ভব হবে? কারণ, ওর সাথে পণ্য বিনিময় না করা মানে, ও যে লবণটা খাবে সেটাও তাকে নিজেই সমুদ্রের পানি জোগাড় করে শুকাতে হবে, না হয় লবণের খনি জোগাড় করতে হবে নিজেই। তাতে সমুদ্র হাজার মাইল দূরে বা লবণের খনি খুঁজতে পাকিস্তানের সিন্ধুতে যেতে হতে পারে। মূল কথায়, যা কিছু সে ভোগ করবে তার সবটার ‘উৎপাদক’ তাকে নিজেই হতে হবে। ‘নো এক্সচেঞ্জ’ কথার মানে তাই। এখান থেকেই ‘সমাজ’ কথাটার মানে কত বিশাল সে হুঁশ আসতে পারে আমাদের। আমরা যারা যারা পণ্য বিনিময় করি-জড়াই তারা এই কাজের মাধ্যমে আসলে একটা সমাজ গড়ে তোলে, অজান্তেই। সমাজ মানে তাই এক অর্থে পণ্য বিনিময়কারীদের সমাজ, পরস্পরকে স্বীকৃতি দেয়ার সমাজ। এমনকি এভাবে ‘আন্তর্জাতিক সমাজ’ও।
আর ঠিক এর উল্টাটাই হলো ‘জাতিবাদী সমাজ’। সে জন্য জাতি-রাষ্ট্র বা বিদেশবিরোধী কথাটার অর্থ এখানেই। তত্ত্ব অনুযায়ী এসব দেশে সবকিছুই নিজেরাই উৎপন্ন করার কথা। তত্ত্বীয়ভাবে বললে এরা আমদানি-রফতানি করতে অপছন্দ করে। সীমান্তে চীনের হাতে মার খেয়ে চীনা-পণ্য বয়কটের হুঙ্কার দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টাটা, চীনা পণ্যের আমদানি বেড়েছে। এটাই মোদির ‘আত্মনির্ভরশীল’ তবে ‘অলীক অর্থনীতি’। গত সপ্তাহে ভারতের নতুন পার্লামেন্ট বিল্ডিং নির্মাণ উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই আত্মনির্ভরশীল (তবে অলীক) অর্থনীতির গড়বেন বলে ‘চাপা মেরেছেন’।
তামাশার কথা হলো, ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছিলেন এমনই এক কল্পিত আমেরিকান জাতিবাদী অর্থনীতি গড়বেন বলে- ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নামে।
সেই ট্রাম্প বলতে চাইছেন, চীন চাক বা না চাক তিনি চীনকে একঘরে জাতিবাদী বানাবেন। তবে এটা হলো খায়েশের কথা। আর বাস্তবে সেটা আসলে উল্টা। তিনি চীনবিরোধী হতে চান এমন বুঝা না বুঝা উসকানি-চুলকানি যাদের আছে এ ধরনের দেশগুলোর একটা আমেরিকান প্রভাবাধীন জোট বানিয়ে চীনকে তা থেকে আলাদা করে দিতে চান। এমনই কল্পরূপের কিছু নমুনা হলো, ‘কোয়াড’ রাষ্ট্র গ্রুপ বা হবু ইন্দো-প্যাসিফিক উদ্যোগ ইত্যাদি।
আপাতত ট্রাম্পের হাত থেকে দুনিয়া বেঁচে গেছে, চায়না অথবা কোনো দেশকে ডি-কাপলিং করা দুনিয়াকে আর দেখতে হচ্ছে না। কারণ ট্রাম্প মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হেরে গেছেন। আর ব্লিঙ্কেনও দাবি করছেন, তিনি বুঝেছেন ডি-কাপলিং অবাস্তব। কিন্তু ধরা যাক, ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলে কী হতো?
এক কথায় বললে, সেটাই হতো সত্যিকার অর্থে ‘কোল্ড-ওয়ার ২’, যা নিয়ে অনেকে এর আগে আন্দাজে ঢিল মেরেছেন। চীন ও আমেরিকার ঝগড়া-সঙ্ঘাত মারাত্মক হলেই লিখে দিয়েছেন ‘কোল্ড-ওয়্যার ২’ আসছে। গত ১৯৫৩-৯১ সাল, এই সময়কালে দুনিয়াটাকে সোভিয়েত-আমেরিকা এ দুই ব্লকে ভাগ করে নেয়া হয়েছিল। কিন্তু শুধু দুই ব্লক-জোট রাষ্ট্রে দুনিয়া ভাগ করলেই সেটা কোল্ড-ওয়্যার বলে চালানোটা আনাড়িপনা হবে। তাহলে আর কী শর্ত লাগবে? সেটা হলো, যদি একটি ব্লক-জোট ‘গ্লোবাল বাণিজ্যে’ অংশ না নেয়। এটা বুঝা খুবই সহজ। যদি দেখা যায়, যাদের কোল্ড-ওয়্যারে জড়িয়ে যাওয়াকে দুই দেশ বা ব্লক বুঝাতে চাচ্ছি তাদের একটা ব্লক-জোট যদি শুরু থেকেই আইএমএফের সদস্যই না হয় অথবা আগে হয়ে থাকলে এখন সদস্যপদ ত্যাগ করে,। এই ত্যাগ করা মানে, ওসব রাষ্ট্র আর ‘গ্লোবাল বাণিজ্যে’ অংশ নিতে পারবে না। ঠিক এমনটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সোভিয়েত ব্লকের অনেক রাষ্ট্রের।
আইএমএফের জন্মের সময় ১৯৪৪ সালে আমেরিকার এক ব্রেটনউড হোটেলের ২২ দিনের সম্মেলনে সোভিয়েত ইউনিয়নের মানে, জোসেফ স্টালিনের প্রতিনিধি অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু এর জন্ম দলিল তৈরি করা সম্পন্ন হওয়ার পরে ফাইনাল সদস্যপদ নিয়ে যখন চাঁদা দিয়ে স্বাক্ষর করতে হয় তখন থেকে কোনো সোভিয়েত প্রতিনিধি আর উপস্থিত হননি। তাই সোভিয়েত ইউনিয়ন আইএমএফের সদস্য ছিল না। তবে পঞ্চাশের দশকে আইএমএফ ফাংশনাল হলে সোভিয়েত ব্লকের অনেক সদস্যই যেমন- পোল্যান্ড এর সদস্যপদ পেতে আবেদন করেছিল। তাতে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাংক উভয়েই অনুমোদন করলেও আমেরিকান প্রশাসনের আপত্তিতে তা বাতিল হয়ে যায়। অতএব সোভিয়েত ব্লক-জোটের সাথে আমেরিকার নেতৃত্বে বাকিদের কোনো গ্লোবাল বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল না। তাই পণ্য বিনিময় বাণিজ্য সম্ভব ছিল না।
কাজেই ট্রাম্পের স্বপ্ন অধরা হয়ে থাকার সম্ভাবনাই ছিল প্রচুর। তবু একালে বাইডেনের হবু প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, ডি-কাপলিং ‘অবাস্তব’ ও ‘কাউন্টার-প্রডাকটিভ’। কথাটা অনেক তাৎপর্যপূর্ণ; যদিও এর মানে বাইডেনের আমলে চীন ও আমেরিকার মাঝে আর কোনো সঙ্ঘাত থাকবে না তা একেবারেই সত্যি নয়। মূল বিষয়, একই গ্লোবাল বাণিজ্য সমাজে থাকছে কিনা। যদি থাকে, তবেই দুনিয়া ফান্ডামেন্টালি ঠাণ্ডা থাকবে!
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com